সেকালে বাংলাদেশে চিত্রকলা চলত দুটি ধারায়—পটুয়া শিল্প ও পোশাকি শিল্প। পটুয়াশিল্পের পাশাপাশি চলত পোশাকি শিল্প। পোশাকি শিল্প বলা হত ‘পালপার্বণের শিল্প’কে। পটের ছবি ছিল আটপৌরে ছবি। আর পালপার্বণের শিল্প বলতে বোঝাত দেবমূর্তি, প্রতিমা। এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য যথেষ্ট। পোশাকি শিল্পে’ সংস্কারক্রিয়া থাকে, থাকে আড়ম্বর, প্রসাধন যাকে এককথায় বলা হয় ‘মণ্ডনকলা বা Ornamentation পোশাকি শিল্প ছিল সুসংস্কৃত ও অভিজাত। বৈদেশিক ঐতিহ্য ছিল তার নির্ভরক্ষেত্র।
পোশাকি শিল্পের আঙ্গিক ছিল স্বতন্ত্র। পোশাকি ছবিতে ভারতবর্ষের চিত্রশিল্পীরা প্রমাণ করে গেছে যে সূক্ষ্ম কারুকার্যের ক্ষেত্রে, শিল্পকে নিখুঁত করে রূপদানের ক্ষেত্রে, পালিশ করে চকচকে করে তোলার ক্ষেত্রে পোশাকি শিল্পীর দক্ষতা ছিল সুপ্রচুর। পোশাকি চিত্র রচনার ক্ষেত্রে ভারতীয় শিল্পীর দক্ষতা ছিল সর্বস্বীকৃত। শৌখিনতা ও শিল্পগত কারুকৃতি সৃষ্টির ক্ষেত্রে এই সব শিল্পীদের প্রচেষ্টার কোনো তুলনা ছিল না। সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এই ধরনের শিল্প সৃষ্টিতে চাকচিক্য, আড়ম্বর ও নিখুঁত রুপদান অধিকমাত্রায় ছিল। শিল্পীর দল পালিশ করার কাজে নেমে পড়ে, শিল্পকে নিখুঁত করার দিকে তাদের মনোযোগ ছিল অসাধারণ। এই ‘পোশাকি শিল্প’কে বলা চলে সুসংস্কৃত শিল্প। শিল্পের ইতিহাসে দেখা যায় শিল্পীদের নিখুঁত করার কাজের নেশা বড়ো কম ছিল না। এতে ছবির অন্তরঙ্গের কিছু ক্ষতি হল। অর্থাৎ আঙ্গিকের দিকে শিল্পীর নজর বেশি হওয়ায় ভাবের দিকে দৈন্য এসেছে। সংস্কার করার সাধনায় মেতে উঠে পোশাকি শিল্প এতই এগিয়ে যেতে লাগল যে কোনো পথ রইল না। উদাহরণ দিয়ে বলা যায় যে শিল্পী এমন আঙুর এঁকেছে, সে আঙুর এতই নিখুঁত যে পাখি উড়ে এসে লুব্ধ হয়ে ক্যানভাস ঠুকরেছে। এই অবিকল প্রকৃতিগত প্রতিফলন শেষ পর্যন্ত শিল্পীকে নেশায় মত্ত করে তোলে।
দাবাখেলার খেলোয়াড়রা যেমন খেলার নেশায় মেতে উঠে সব ভুলে যায়, তারপর আর পথ খুঁজে পায় না, তেমনি পোশাকি শিল্পের শিল্পীরা আঙ্গিকের সাধনায় মেতে ওঠে। শিল্পকে নিখুঁত করার চেষ্টায় মেতে ওঠে। শেষপর্যন্ত পথ খুঁজে পায় না। শেষ পর্যন্ত দাবাড়ু খেলার ছক লন্ডভন্ড করে দেয়। যে চাল এতদিন দিয়ে এসেছে, সে চাল ফিরিয়ে নিতে চায়। পোশাকি শিল্পের মধ্যে তাই অবক্ষয় নেমে আসে। আজকের ইউরোপীয় শিল্পে তাই ভাঙনের খেলা শুরু হয়েছে। তাই আধুনিক ইউরোপীয় শিল্পে ভাঙনের রূপ প্রত্যক্ষ। লেখক মনে করেন, “ওঁরা যদি গোড়া বেঁধে খেলতে শিখত তাহলে এ অবস্থা নিশ্চয় হত না।” এই উক্তির মধ্যে দিয়ে পোশাকি শিল্পেরও ট্র্যাজেডির পরিচয় ধ্বনিত হয়েছে। লেখকের এই উক্তি চিন্তার গভীরতায় যথার্থ। কারণ লেখকের মনে যে চিত্রশুদ্ধির ধারণা আছে সেই ধারণার বশে তিনি পটুয়া শিল্পের ঘরোয়া ভাব ও সহজ-সরল অনাড়ম্বর দিকের বর্ণনা করেছেন। পাশাপাশি পোশাকি শিল্পের আড়ম্বরতা ও নিখুঁত আঙ্গিকের সাধনা এত বিপরীত যে মনে হয় আপাতদৃষ্টিতে এর গুরুত্ব অসাধারণ। নাগরিক সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে দেশে দেশে যখন ‘metropoli tan’ culture এগিয়ে যায়, তখন পোশাকি শিল্পের বিস্তার ঘটে। ইউরোপে, এই একই ঘটনা ঘটেছে। পটুয়াশিল্পের মতো দেশজ শিল্প শেষ পর্যন্ত অবহেলার অন্ধকারে হারিয়ে যায়। কারণ মানুষের আকর্ষণ ‘formal perfection’ বা আঙ্গিকগত পূর্ণতার দিকে। আঙ্গিকগত পূর্ণতার পরিচয় যে শিল্পে বর্তমান, রসিক ততই সেই শিল্পের দিকে অগ্রসর হয়। পোশাকি শিল্পের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। কিন্তু এই আড়ম্বরপনা ও বাহ্যরুপের চর্চা যে শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হতে বাধ্য তার সংবাদ পাওয়া যায় ইউরোপীয় শিল্পের ইতিহাসে। লেখকের বিচার ও পর্যালোচনা এই দিক থেকে সার্থক। লেখক শিল্পের রস ও ভাবকে যখন গুরুত্ব দেন, তখন তাঁর পথে সৃজনশীল শিল্পের দিকে গুরুত্ব দেওয়া স্বাভাবিক। আলোচ্য প্রবন্ধে লেখক সৃজনশীল শিল্পের দিকে মনোযোগ দিয়েছেন। এই কারণে লেখক পোশাকি শিল্পের ব্যর্থতার সঙ্গে পটুয়া শিল্প বা সৃজনশীল শিল্পের গুণপনার কথা বর্ণনা করেছেন।
Leave a comment