ন্যাশনাল থিয়েটার-এর পত্তন হয় ১৮৭২-এর ৭ই ডিসেম্বর ‘নীলদর্পণ’ অভিনয়ের মধ্য দিয়ে। বস্তুত ১৮৬৮তে স্থাপিত বাগবাজার এমেচার থিয়েটারই ন্যাশনাল থিয়েটারে পরিণত হয়েছিল। এটিই বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে প্রথম সাধারণ রঙ্গালয়। জাতীয়তাবাদী ভাবধারা ও ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছিল ‘ন্যাশনাল’ নামটির মধ্য দিয়ে। ফলে রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে এবং বাংলা নাটকের ক্ষেত্রে ন্যাশনাল থিয়েটার এক ভিন্ন মাত্রা এবং নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল নিঃসন্দেহে।

কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় কয়েক মাসের মধ্যেই দলাদলি অন্তর্দ্বন্দ্ব ইত্যাদি কারণে ন্যাশনাল থিয়েটার বন্ধ হয়ে যায়। ১৮৭২-এর ৭ই ডিসেম্বর স্থাপিত হয়ে ১৮৭৩-এ ৮ই মার্চ ন্যাশনাল থিয়েটারের দলবদ্ধ শেষ অভিনয় হয়।

এরপর ন্যাশনাল থিয়েটার দুটি দলে বিভক্ত হয়ে যায়। গিরিশচন্দ্র, ধর্মদাস সুর, মহেন্দ্রলাল বসু প্রমুখেরা রইলেন আদি নামের ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’ দলে। দ্বিতীয় দলটির নাম হল ‘হিন্দু ন্যাশনাল থিয়েটার’। এই দলের নেতৃত্ব দিলেন অর্ধেন্দু শেখর মুস্তাফি, সঙ্গে রইলেন অমৃতলাল, নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখেরা। কিন্তু দুটি দলই কোনোক্রমে এক বৎসর অভিনয় চালিয়ে যায়।

কিন্তু ধর্মদাস নগেন্দ্রনাথ-অমৃতলাল প্রমুখেরা রঙ্গমঞ্চের অভাবে অস্থির হয়ে পড়েছিলেন।

শেষপর্যন্ত তাঁরা ভুবনমোহন নিয়োগীর মালিকানায় নতুন নাট্যদল গঠন করলেন। নাম দেওয়া হল গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার। ১৮৭৩ এর ৩১শে ডিসেম্বর গ্রেট ন্যাশনালের সূচনা হয় ‘কাম্য কানন নাটকের মধ্য দিয়ে। কিন্তু ১৮৭৪-এর শেষ দিকে ম্যানেজার ধর্মদাস সুরের সঙ্গে মালিক ভুবনমোহনের বিরোধ উপস্থিত হয়। ধর্মদাসের পরবর্তী ম্যানেজার নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও মতভেদ ঘটায় নগেন্দ্রনাথ দল ছেড়ে ‘গ্রেট ন্যাশনাল অপেরা কোম্পানী’ নামে নতুন দল গঠন করেন। ১৮৭৫-এ গ্রেট ন্যাশনাল দল ধর্মদাস, অর্ধেন্দুশেখরের নেতৃত্বে ভারতভ্রমণে বের হয়। কয়েকমাস পরে তারা ফিরে এলে আর্থিক ব্যাপারে মনোমালিন্য তুঙ্গে ওঠে। ধর্মদাসকে সরিয়ে দিয়ে ভুবনমোহন কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায়কে রঙ্গমঞ্চটি ইজারা দেন। কৃষ্ণধন রঙ্গালয়ের নাম দেন ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল থিয়েটার’। অন্যদিকে ধর্মদাস সুর বেরিয়ে গিয়ে ‘দি নিউ এরিয়ান’ বা ‘লেট ন্যাশনাল থিয়েটার’ নামে অভিনয় চালাতে থাকেন।

কিন্তু কৃষ্ণধন থিয়েটারী ব্যবসা চালাতে না পারায় ভুবনমোহন আবার থিয়েটার নিয়ে নিলেন। আবার তার নাম হয় ‘গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার’। এবার ম্যানেজার উপেন্দ্রনাথ দাস, ১৯৭৫-এর ডিসেম্বর থেকে এখানে অভিনয় শুরু হয়। কিন্তু ‘গজদানন্দ ও যুবরাজ’, The police of Pig and Sheep’ প্রভৃতি উপেন্দ্রনাথ লিখিত প্রহসনগুলিতে ব্রিটিশ প্রশাসনকে ক্রমাগত আঘাত করায় বড়লাট নর্থব্রুক নাট্যনিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে এক অর্ডিন্যান্স জারি করেন এবং ১৮৭৬-এর ডিসেম্বর মাসেই নাট্যনিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করেন। ফলে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের অভিনয় ধারা ব্যাহত হল। উপেন্দ্রনাথ, অমৃতলাল, সুকুমারী, অর্ধেন্দুশেখর দল ছেড়ে বা অভিনয় ছেড়ে চলে গেলেন ভুবনমোহনও মামলায় সর্বস্বান্ত হলেন। ১৮৭৭-এর অক্টোবর পর্যন্ত কোনক্রমে পুরোনো নাটকগুলি অভিনয়ের মধ্য দিয়ে গ্রেট ন্যাশনাল অস্তিত্ব রক্ষা করেছিল।

এরপর গিরিশচন্দ্র ঘোষ গ্রেট ন্যাশনালের ইজারা গ্রহণ করেন। তিনি আবার ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’ নামটিকে ব্যবহার করতে থাকেন। কিন্তু ১৮৭৭-এর ৩০শে নভেম্বর থিয়েটারের মালিকানা হস্তান্তরিত করলেন গিরিশচন্দ্র। শেষ পর্যন্ত ১৮৮০ তে প্রতাপচাঁদ জহুরি নিলামে থিয়েটার কিনে নিলেন এবং ন্যাশনাল থিয়েটার নাম দিয়েই অভিনয় চালাতে লাগলেন। ন্যাশনাল থিয়েটার হয়ে উঠলো পুরোপুরি বাণিজ্যিক থিয়েটার। নামটি ছাড়া এখানে ন্যাশনাল থিয়েটারের ভাবাদর্শগত ঐতিহ্য বজায় থাল না। গিরিশচন্দ্র এখানে ম্যানেজার হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন। ১৮৮৩-তে মতান্তরের ফলে গিরিশচন্দ্র প্রতাপচাদের ন্যাশনাল থিয়েটার ছেড়ে গুমুর্খরায়ের অর্থে ও বিনোদিনীর সহায়তায় স্টার থিয়েটার গড়ে তুললেন। ১৮৮৫ পর্যন্ত প্রতাপচাঁদ ন্যাশনাল থিয়েটার চালান। পরে ভুবনমোহন নিয়োগী আবার এই থিয়েটারের ভার গ্রহণ করেন। ১৮৮৬-র ৩রা জুলাইয়ের পর মামলায় ন্যাশনাল থিয়েটার শেষ হয়ে গেল। স্টার থিয়েটার কর্তৃপক্ষ ন্যাশনাল থিয়েটার বা গ্রেট ন্যাশনালের বাড়িটি কিনে নিয়ে পুরোনো বাড়ি ভেঙে নতুন করে গড়ে তুললেন মিনার্ভা থিয়েটার। এর সঙ্গেই ‘ন্যাশনাল’ নামচিহ্নিত থিয়েটারের অস্তিত্ব সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।