ভূমিকা: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ন্যায় সম্পর্কিত আলোচনা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং তাত্ত্বিক বিচারে তাৎপর্যপূর্ণ। রাষ্ট্রতত্ত্বের পরিপ্রেক্ষিতে ন্যায়-ধারণার আলোচনা অপরিহার্য। রাষ্ট্র হল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কেন্দ্রীয় বিষয়। রাষ্ট্র ও সরকারের যথার্থ উদ্দেশ্য ও চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসাবে ন্যায়বিচারের কথা বলা হয়। রাষ্ট্র ও সরকারের পরিপ্রেক্ষিতে ন্যায়বিচার হল সর্বকালেই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের কার্যাবলী ন্যায়সঙ্গত হওয়া আবশ্যক। তা ছাড়া সরকারের আইন-আদালতের মাধ্যমে ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত হওয়া দরকার।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তাত্ত্বিক আলোচনা আদর্শমূলক। যে-কোন আদর্শমূলক আলোচনায় ন্যায়বিচার বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তত্ত্বগত আলোচনায় অধিকার, স্বাধীনতা, সাম্য, আইন প্রভৃতি ধারণার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। সকল সভ্য ও সংগঠিত সমাজব্যবস্থায় উপরিউক্ত ধারণাগুলি বিশেষ মূল্যবোধযুক্ত। এই সমস্ত ধারণার মূল্যবোধের মধ্যে সাযুজ্য সম্পাদন করা দরকার। তা হলেই সংশ্লিষ্ট সমাজব্যবস্থার সংগঠন সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত হওয়া যাবে। বিভিন্ন রাজনীতিক মূল্যবোধের মধ্যে ন্যায়-ধারণার মাধ্যমেই সমন্বয় ও সংশ্লেষ সাধিত হয়। বার্কার তাঁর Principles of Social and Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “Justice is the reconciler and synthesis of political values it is their union in an adjusted and intregrated whole: it is, in Aristotle’s words, ‘what answers to the whole of goodness…. being the exercise of goodness as a whole….towards one’s neighbour.” এই কারণে অধিকার, স্বাধীনতা, সাম্য, আইন প্রভৃতি রাজনীতিক ধারণা আলোচনার পরই ‘ন্যায়’ সম্পর্কে আলোচনা করা আবশ্যক।
ন্যায় ধারণার অর্থ ও প্রকৃতি
ন্যায় বিচারের ধারণা জটিল: ন্যায় বিচারের ধারণাটি বিশেষভাবে জটিল। ‘ন্যায়’ বলতে কী বোঝায়। তা সহজে বলা সম্ভব নয়। অবশ্য এ কথা রাজনীতিক তত্ত্বের যে-কোন ধারণা সম্পর্কে সাধারণভাবে সত্য। বিশেষত আদর্শমূলক প্রকৃতি বিশিষ্ট প্রতিটি রাজনীতিক তত্ত্বের ক্ষেত্রে এ কথা খাটে। এই কারণে ন্যায় সম্পর্কে সর্বজনগ্রাহ্য একটি সাধারণ সংজ্ঞার অবতারণা অসম্ভব প্রতিপন্ন হয়। অনেকেই সাধারণভাবে মনে করেন যে ন্যায়বিচারের অর্থ সম্পর্কে তাঁদের সম্যক ধারণা আছে। কিন্তু আসলে অধিকাংশ ধারণাই ভাষাভাষা, পরিষ্কার নয়। হ্যারল্ড পটার এ প্রসঙ্গে তাঁর The Quest of Justice শীর্ষক রচনায় মন্তব্য করেছেন: “Most men think that they understand the meaning of justice but in fact, their notions prove to be vague.” ন্যায় হল এক বিমূর্ত ধারণা। এবং এই ধারণা ও তার বাস্তব অভিব্যক্তির মধ্যে সামঞ্জস্য সাধন দুরূহ হয়ে পড়ে। যেমন পূত-পবিত্র নৈতিক ধারণার ভিত্তিতে ন্যায়বিচারের কথা বলা হয়ে থাকে, কিন্তু অভিজ্ঞতার মানদণ্ডে তার বাস্তবায়ন কার্যত অসম্ভব। আবার দেশ-কাল-পাত্র ভেদে ন্যায় ধারণার ক্ষেত্রে পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। সর্বোপরি ন্যায় সম্পর্কিত ধারণা হল গতিশীল বা পরিবর্তনশীল। কালের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সম্পর্কিত ধারণার পরিবর্তন হতে দেখা যায়। ন্যায় সম্পর্কিত অতীতের ধারণা এবং আধুনিক ধারণার মধ্যে ব্যবধান অনস্বীকার্য। একসময় যা ন্যায় বলে প্রতিষ্ঠিত থাকে, অন্য সময়ে তা অন্যায় বলে প্রতিপন্ন হয়।
নৈতিক ধারণা: সাধারণভাবে ন্যায় বলতে ন্যায়পরায়ণতা বা ন্যায্যতাকে বোঝায়। এ হল যুক্তিসঙ্গত বা যথাযথতা বা ঔচিত্য। যা ভুল, অন্যায় ও অসঙ্গত, ন্যায় বিচার হল তার বিপরীত। ন্যায়, নির্ভুল, যুক্তিসঙ্গত প্রভৃতি ধারণার সঙ্গে সততা ও নৈতিকতা সংযুক্ত। স্বভাবতই ন্যায় হল মূলত একটি নৈতিক ধারণা। ন্যায়-ধারণার মধ্যে আদর্শবোধ ও বিশুদ্ধতা বর্তমান। ন্যায় হল চরম সত্য, বিশুদ্ধতা ও পরিপূর্ণতার প্রতীক।
ন্যায়বিচারের ধারণা গতিশীল: নৈতিক ধারণা হিসাবে ন্যায় সম্পর্কিত ধারণা গতিশীল। সর্বকালের জন্য কোন স্থির-নিশ্চল ধারণা নয়। মানুষের নীতিবোধ ও আদর্শবোধ বদলায়, সামাজিক সচেতনতার পরিবর্তন ঘটে। স্বভাবতই ন্যায় ধারণারও পরিবর্তন ঘটে। কালের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ বদলায়। এই পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে ন্যায় সম্পর্কিত ধারণায় পরিবর্তন সূচিত হয়। কয়েক শতাব্দী আগে যা ন্যায়সঙ্গত বলে সমাজজীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল, আজ তা অন্যায় হিসাবে সামগ্রিকভাবে নিন্দিত। মানবসভ্যতার ইতিহাসে ক্রীতদাস প্রথা এক সময় সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। এই প্রথার সঙ্গে ন্যায়বিচারের কোন বিরোধ ছিল না। কিন্তু আধুনিককালে সভ্য সমাজব্যবস্থায় ন্যায়বিচারের মানদণ্ডে এ রকম যে-কোন প্রথা নিন্দনীয় অপরাধ বিশেষ।
ন্যায় ধারণার সম্পর্কে বার্কারের ব্যাখ্যা:
ব্যুৎপত্তিগত অর্থে ‘ন্যায়’ শব্দটির উৎপত্তি ল্যাতিন শব্দ ‘Jus’ থেকে। অধ্যাপক বার্কার এক্ষেত্রে ‘Jus’, ‘Justus’, ‘Justitia’ – এই তিনটি শব্দের উল্লেখ করেছেন। এই শব্দগুলির অর্থ হল সংযুক্ত করা, খাপ খাওয়ানো। সুতরাং ‘ন্যায়’ হল একটি বন্ধন বা বন্ধন সূত্র। এ হল মানবিক সম্পর্কের এক সংগঠিত ব্যবস্থার মধ্যে মানুষের সঙ্গে মানুষের সংযোগ সাধন। আবার একটি সমন্বিত মূল্যবোধের ব্যবস্থায় ন্যায় মূল্যবোধের সঙ্গে মূল্যবোধের সামঞ্জস্য বিধান বা সংযোগ সাধন করে। সংগঠিত মানবিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বহু ও বিভিন্ন মূল্যবোধের স্বীকার করা হয়। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে স্বাধীনতা, সাম্য, সৌভ্রাতৃত্ব প্রভৃতি রাজনীতিক মূল্যবোধের কথা বলা যায়। সকল আইনব্যবস্থাতেই এই সমস্ত মূল্যবোধ বর্তমান। তবে বিভিন্ন সময়ে এই মূল্যবোধগুলি বিভিন্ন মাত্রায় বর্তমান থাকে। এই সমস্ত রাজনীতিক মূল্যবোধের মধ্যে পারস্পরিক দাবি পরিলক্ষিত হয়। এই সমস্ত পারস্পরিক দাবির মধ্যে প্রতিষ্ঠিত এক ধরনের বিন্যাস ও পুনর্বিন্যাসের প্রক্রিয়া প্রবহমান থাকে। সাম্যের দাবির সঙ্গে স্বাধীনতার দাবিকে খাপ খাওয়াতে হয়। আবার স্বাধীনতা ও সাম্যের দাবির সঙ্গে সহযোগিতার দাবির সামঞ্জস্য সাধন করতে হয়। ন্যায়-ধারণাই বিভিন্ন রাজনীতিক মূল্যবোধের মধ্যে সংযুক্তি ও সমন্বয় সাধন সম্পাদন করে। সুতরাং ‘ন্যায়’ হল রাজনীতিক মূল্যবোধের মধ্যে সংশ্লেষ বা সাধনকারী এক ধারণা। ‘ন্যায়’ হল যাবতীয় রাজনীতিক মূল্যবোধের এক ঐক্যবদ্ধ ও অখণ্ড রূপ। বার্কার বলেছেন: “Justice is the reconciler and the synthesis of political values: it is their union in an adjusted and integrated whole….” সুতরাং ন্যায় হল এক সম্পূর্ণ মূল্যবোধ। এই মূল্যবোধের মধ্যে অন্যান্য রাজনীতিক মূল্যবোধের সমাবেশ বা সমন্বয় ঘটেছে। ন্যায়-ধারণার দ্বারা অন্যান্য মূল্যবোধগুলি নিয়ন্ত্রিত হয়। রাজনীতিক মূল্যবোধসমূহের পারস্পরিক দাবির মধ্যে সমন্বয় সাধন এবং পারস্পরিক সংঘাতের ক্ষেত্রে মীমাংসা করা হয় ন্যায়-ধারণার মানদণ্ডে। যা সঠিক এবং সঙ্গত সেই সম্পর্কে সাধারণ এবং নিয়ন্ত্রণমূলক ধারণা হল ‘ন্যায়। মানুষ রাষ্ট্রীয় আইনের মধ্যে ন্যায়ের প্রতিফলন প্রত্যক্ষ করতে চায় এবং ন্যায়ের মানদণ্ডে আইনের ন্যায্যতা যাচাই করতে চায়। ন্যায়সঙ্গততা প্রতিপন্ন করার পরিপ্রেক্ষিতে আইনের সঙ্গে ব্যক্তিবর্গের সংযোগ-সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এবং ব্যক্তিকে আইন মানতে বাধ্য করা হয়। বার্কার বলেছেন: “We acknowledge that justice will justify law to us, we admit that, in virtue of this justification, it finally ties and obliges us to law.”
Leave a comment