এক: রাষ্ট্র অনাবশ্যক: নৈরাজ্যবাদীদের মতানুসারে রাষ্ট্র হল একটি অনাবশ্যক প্রতিষ্ঠান। মানবসমাজে রাষ্ট্র এমন কোন কাজ করে না, যা রাষ্ট্র না থাকলে সম্পাদিত হবে না। রাষ্ট্র দেশের প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করে এবং বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিহত করে। এই উদ্দেশ্যে রাষ্ট্র সামরিক বাহিনী সংগঠিত ও সংরক্ষণ করে। নৈরাজ্যবাদীদের অভিমত অনুসারে রাষ্ট্রের অস্তিত্বের অবসানের পরও এই একই কাজ আরও ভালোভাবে সম্পাদন করা সম্ভব হবে। রাষ্ট্র কর্তৃক নিযুক্ত ভাড়াটে সৈনিক বা বেতনভুক সৈনিকদের থেকে নাগরিকদের নিয়ে গঠিত সামরিক বাহিনী অনেক বেশি কার্যকর ও নির্ভরযোগ্য। সুতরাং দেশের প্রতিরক্ষার ব্যাপারেও রাষ্ট্রের ভূমিকা অপরিহার্য নয়। ক্রোপট্‌কিন মন্তব্য করেছেন: “Standing armies are always beaten by invaders who have historically been repulsed only by spontaneous uprising.” জোহারী তাঁর Principles of Modern Political Science শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “The state is superfluous as it does no good to the individuals. It perpetrates conditions of economic and social inequity and injustice as a result of which crimes take place.”

দুই: শিক্ষ স্বার্থে রাষ্ট্রের প্রয়োজন নেই: নৈরাজ্যবাদীদের মতানুসারে ইন-শৃঙ্খলা সংরক্ষণের জন্যও রাষ্ট্রের কোন প্রয়োজন নেই। নৈরাজ্যবাদী সমাজব্যবস্থা ন্যায়, স্বাধীনতা এবং জনসাধারণের স্বেচ্ছামূলক সহযোগিতার উপর প্রতিষ্ঠিত। এ রকম সমাজে রাষ্ট্রের কোন প্রয়োজন থাকবে না। পরিবেশই মানুষকে খারাপ করে, মানুষ প্রকৃতিগতভাবে খারাপ নয়। নৈরাজ্যবাদী সমাজে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কোন কর্তৃপক্ষের প্রয়োজন দেখা দেবে না। কারণ এ রকম সমাজব্যবস্থায় কোন ব্যক্তির মধ্যে অপর কোন ব্যক্তির অনিষ্ট করার প্রবণতা থাকবে না। আবার শিক্ষামূলক উদ্দেশ্যেও রাষ্ট্রের কোন দরকার নেই। বিদ্যমান সমাজব্যবস্থা বহুবিধ অন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত। এই সমাজেও অসংখ্য শিক্ষামূলক কাজকর্ম সম্পাদিত হয় স্বেচ্ছামূলক সংগঠনসমূহের দ্বারা। জনসাধারণের শিক্ষার স্বার্থে নৈরাজ্যবাদী সমাজে রাষ্ট্রের ভূমিকার কোন প্রয়োজন থাকবে না। তবে এক্ষেত্রে স্বেচ্ছামূলক সংস্থা ও সংগঠনসমূহের সংখ্যা বৃদ্ধি করা দরকার।

তিন: রাষ্ট্র শোষণমূলক ও পীড়নমূলক: নৈরাজ্যবাদীরা রাষ্ট্রের শ্রেণী-চরিত্রের বিষয়টি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। শ্রেণী-চরিত্রের কারণেই রাষ্ট্রের কর্তৃত্বের বিষয়টি প্রকট হয়ে পড়ে। রাষ্ট্র হল একটি শোষণমূলক ও পীড়নমূলক প্রতিষ্ঠান। শ্রমিকশ্রেণীর উপর শোষণ-পীড়ন কায়েম করার উদ্দেশ্যে পুঁজিপতি শ্রেণী এই প্রতিষ্ঠানটিকে ব্যবহার করে। যে সমস্ত সামগ্রী সকলের রাষ্ট্র সেই সমস্ত বিষয়াদি বা সামগ্রীর উপর একচেটিয়া কর্তৃত্ব কায়েম করে। জোড় তাঁর Introduction to Modern Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন: “The state as is exists today is used by the few as an instrument to protect their unjust monopolies of those things which rightly belong to all……until the state is replaced by some organisation other than the State, Capitalism and private property can never pass away.” এ প্রসঙ্গে ক্রোপটকিন তাঁর The Conquest of Bread শীর্ষক গ্রন্থে অর্থবহ আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন: “Individual appropriation is neither just nor serviceable. All belongs to all. All things are for all men, since all men have need of them, since all men have worked in the measure of their strength to produce them, and since it is not possible to evaluate everyone’s part in the production of world’s wealth…”

চার: অপরাধ বৃদ্ধির জন্য রাষ্ট্র দায়ী: নৈরাজ্যবাদীরা রাষ্ট্র-বিরোধী। এই রাষ্ট্র-বিরোধিতার মধ্যে প্রতিহিংসা বর্তমান। অনভিপ্রেত ও অপ্রয়োজনীয় বলে নৈরাজ্যবাদীরা রাষ্ট্রের বিরোধিতা করেন। সমাজে যাদের নিরাপত্তার প্রয়োজন অধিক, তাদের স্বার্থ সংরক্ষণে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা শোচনীয়ভাবে প্রকাশ পায়। রাষ্ট্রের অস্তিত্ব প্রয়োজনের অতিরিক্ত’ত বটেই, এমনকি অনিষ্টকরও বটে। রাষ্ট্র সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর। পুলিশ বাহিনী, আইন-আদালত, কারাগার প্রভৃতি রাষ্ট্রীয় হাতিয়ারসমূহ সমাজে অন্যায়-অবিচার প্রতিহত করার পরিবর্তে অন্যায়-অবিচারের প্রবণতা বৃদ্ধি করে। সমাজে অসাম্য-বৈষম্য ও অন্যায়-অবিচার অব্যাহত থাকার জন্য দায়ী হল রাষ্ট্রের ভূমিকা। নিরীহ-নিরপরাধ মানুষকে রাষ্ট্র তার ভূমিকার মাধ্যমে অপরাধীতে পরিণত করে এবং অপরাধীকে শাস্তি দেয় অপরাধের কারণে। রাষ্ট্র ন্যায়বিচারের ব্যবস্থা করতে পারে না। এই অবস্থায় একজন সাধারণ অপরাধী দাগী আসামীতে পরিণত হয়। কোকার তাঁর Recent Political Thought শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বলেছেন: “The inevitable tendency of state action is to degrade the moral and intellectual levels of those subject to its authority.” তিনি আরও বলেছেন: “In the words of Bakunin, despotism lies not in the form of the state but in its essence; and the most democratic devices are of no available whatever in modifying this essential character of the state.”

পাঁচ: রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ক্ষতিকর: নৈরাজ্যবাদীরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ক্ষতিকর দিকগুলির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। লর্ড আক্‌টন-এর মত তাঁরা এই ধারণায় আস্থাশীল যে ‘ক্ষমতা দুর্নীতিগ্রস্ত করে এবং চূড়ান্তক্ষমতা চূড়ান্তভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত করে। রাষ্ট্র কাজ করে ক্ষমতার মাধ্যমে। রাষ্ট্র কর্তৃক ক্ষমতার প্রয়োগ সেই সমস্ত ব্যক্তিকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে, যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে। যাদের উপর ক্ষমতা প্রযুক্ত হয়, তারা অপকৃষ্ট হয় এবং তাদের মানবিকতার হানি ঘটে। ক্ষমতা মানুষকে স্বার্থপর, নিষ্ঠুর, দুর্বিনীতি ও অমানুষ করে তোলে। ক্ষমতা সকল রকম নৈতিক মূল্যবোধকে নষ্ট করে দেয়। ক্ষমতার উপাদানসমূহ সামাজিক সংহতিকে বিপন্ন করে তোলে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা স্বার্থপর রাজনীতিকদের করায়ত্ত হয়ে যায়। এই ক্ষমতার প্রয়োগের পরিপ্রেক্ষিতে মানবসমাজ পরস্পর বিরোধী বিভিন্ন গোষ্ঠী, শ্রেণী ও জাতীয়তায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। রাজনীতিকদের প্রকৃতি প্রসঙ্গে জোড তাঁর Introduction to Modern Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “The politician, …..is wicked not because of his nature but because of his position, not because he is a man, but because he is a politician. No man and no body of men should, therefore, be entrusted with the governmental authority over their fellows.” The Quest of Bread: “This or that despicable minister might have been an excellent man, if power had not been given to him.”

ছয় : প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের বিরোধিতা: নৈরাজ্যবাদীরা প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের বিরোধিতা করেন। তাঁদের অভিমত অনুযায়ী প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার হল এক ধরনের প্রতারণামূলক ব্যবস্থা। প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠিত হয় কিছু অপেশাদার ব্যক্তিকে নিয়ে, স্বভাবতই এ রকম সরকার সুদক্ষ হতে পারে না। প্রকৃতপ্রস্তাবে প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার মোটেই প্রতিনিধিত্বমূলক নয়। কারণ কোন ব্যক্তি সম্যকভাবে এবং সম্পূর্ণভাবে জনসাধারণের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। কোন একজন প্রতিনিধি কোন একটি বিষয়ে তার মতামত ব্যক্ত করতে পারে; কিন্তু আইনসভার আলোচ্য সকল বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করতে পারে না। আবার কোন বিষয়ে আইনসভার সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি জনসাধারণের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। এই কারণে নৈরাজ্যবাদীরা উদারনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সমগ্র পরিকল্পনাকে বাতিল করে দেন। তাঁদের মতানুসারে প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা অবাস্তব। কারণ কেউ কারও মতের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থা সৃষ্টি করে কিছু পেশাদার রাজনীতিকের। এই সমস্ত পেশাদার রাজনীতিকরা নির্বাচকমন্ডলীর অজ্ঞতার সুযোগ নেয়। প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থায় আইনসভা অনভিজ্ঞ ও অদক্ষ মানুষে ভরে যায়। সাধারণের ইচ্ছা’ (General Will) ধারণাটি হল একটি অর্থহীন বোকামি। অন্তত জনপ্রতিনিধিরা বিষয়টিকে এ রকমই করে তোলে। জনপ্রতিনিধিরা হয় জানে না সাধারণ ইচ্ছা কাকে বলে, নতুবা তারা সাধারণ ইচ্ছার ধারণাটিকে ব্যক্তিগত স্বার্থে অপব্যবহার করে। নৈরাজ্যবাদীদের মতানুসারে গণতান্ত্রিক হোক বা না হোক, বিদ্যমান সরকার মাত্রেই খারাপ। কারণ সরকার সম্মতির জন্য পরোয়া না করে ব্যক্তি মানুষের উপর বাধ্যবাধকতা আরোপ করে। এই কারণে বিদ্যমান সরকার হল স্বাধীনতার শত্রু এবং যথার্থ স্বশাসনের পরিপন্থী। জোড় তাঁর Introduction to Modern Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: ‘Representative government is therefore, government by men who know just enough about everything to enable them to do everything badly, and not enough about everything to enable them to do anything well.”

সাত: নৈরাজ্যবাদীরা সকল রকম রাজনীতিক রাষ্ট্রের বিরোধিতা করেন। এ ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্রীদের সঙ্গে নৈরাজ্যবাদীদের পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। নৈরাজ্যবাদীরা সকল রকম সামাজিক বলপ্রয়োগের বিরোধিতা করেন। শিল্পসমাজকে পুনরায় সংগঠিত করার ক্ষেত্রে তাঁরা সংসদীয় উদ্যোগ-আয়োজনকে স্বীকার বা সমর্থন করেন না। নৈরাজ্যবাদীদের অভিমত অনুযায়ী শিল্প সংস্থা পুরোপুরি পরিচালিত হবে স্বেচ্ছামূলক স্বশাসিত গোষ্ঠী সমূহের দ্বারা।

আট: ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিরোধী: নৈরাজ্যবাদীরা ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিরোধী। প্রুধোঁ (Joseph Proudhon) তাঁর What is Property? শীর্ষক রচনায় ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে চৌর্য বলে মন্তব্য করেছেন। মানুষের দুঃখ-দুর্দশায় মূল কারণ হল ব্যক্তিগত সম্পত্তি। ব্যক্তিগত সম্পত্তির ভিত্তিতেই সমাজব্যবস্থায় ‘আমার-তোমার’ বোধের সৃষ্টি হয়। এবং এই ব্যক্তিগত সম্পত্তিবোধের পরিপ্রেক্ষিতে সমাজজীবনে ব্যক্তিবর্গের মধ্যে বিবাদ-বিসংবাদ ও সংঘাতের সৃষ্টি হয়। ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণার ভিত্তিতে পুঁজিবাদী ধ্যান-ধারণার সৃষ্টি হয়। ব্যক্তিগত সম্পত্তির ব্যবস্থায় পুঁজিবাদের বিকাশ ও বিস্তার ঘটে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সমাজের সংখাগরিষ্ঠ মানুষের উপর শোষণ-পীড়ন কায়েম হয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় অন্যায়-অবিচারের আধিক্য দেখা দেয়। এ ধরনের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় অসংখ্য মানুষের শ্রমের ফসল ভোগ করে মুষ্টিমেয় ব্যক্তি। তার ফলে দরিদ্ররা আর্থনীতিক বিষয়ে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। পুঁজিবাদের প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার পরিণামে যুদ্ধের অনুকূল পরিস্থিতি-পরিমন্ডলের সৃষ্টি হয়। সামাজিক ও আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে গতিহীনতার জন্য পুঁজিবাদের দায়িত্বকে অস্বীকার করা যায় না। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পরিণামে জনজীবনে বিবিধ বিচ্যুতি ও সীমাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে শ্রমজীবীদের অবস্থার অবনতি; কোন রকম কাজকর্ম যাদের করতে হয় না তাদের বৈভব ও বিলাস-ব্যসনের জীবনধারা ; অসংখ্য মানুষের দারিদ্র্য ও দুঃখ-দুর্দশা; সমাজে অপচয়ের আধিক্য; বিত্তবানদের অমিতব্যয়িতা; বেকারত্ব ও নীতিহীনতা প্রভৃতির কথা বলা যায়।

নয়: ধর্মের বিরোধিতা: নৈরাজ্যবাদীরা ধর্ম ও চার্চের বিরোধিতা করেন। তাঁরা কোন রকমের কর্তৃত্বকে স্বীকার বা সমর্থন করেন না। তাঁরা সকল রকম কর্তৃত্বের অবসানের কথা বলেন। বিশেষত নৈরাজ্যবাদীরা রাষ্ট্র, চার্চ, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও পুঁজিবাদীদের বিরোধিতা করেন। চার্চের কর্তৃত্বের কারণে জনজীবনে বিবিধ ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখা দেয়। ধর্ম মানুষকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন করে। পুঁজিপতি ও রাজনীতিক কর্তৃপক্ষের অন্যায় অবিচারের ব্যাপারে ধর্ম মানুষকে সহিষ্ণু করে তোলে। চার্চ হল সব সময়েই সম্পত্তিবানদের সুহৃদ। বিদ্যমান সমাজব্যবস্থায় অসাম্য-বৈষম্য বর্তমান। এ সব স্বীকার ও সহ্য করার ব্যাপারে চার্চ দরিদ্র মানুষদের শিক্ষা দেয়। ধর্ম মানুষের কাছে আফিমের নেশার মতই। চার্চ হল রাষ্ট্র ও পুঁজিপতিদের বন্ধু। ধর্ম দীন-দরিদ্রদের বিপথে পরিচালিত করে এবং বিদ্যমান ব্যবস্থায় নিজেদের নিয়তিকে মেনে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার জন্য ধর্ম গরীব মানুষের মনের উপর চাপ সৃষ্টি করে। ধর্মীয় সংগঠনসমূহ দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়। ধর্ম হল একটি অসৎ শক্তি। ধর্ম রক্ষণশীল ও প্রগতি-বিরোধী। ধর্ম বা চার্চের কর্তৃত্বের সম্পূর্ণ অবসান ব্যতিরেকে সামাজিক প্রগতি অসম্ভব। জোহারী তাঁর Principles of Modern Political Science শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “Kropotkin rejects religion on both scientific and natural ground. He says that religion is either a primitive cosmogony, a rude attempt at explaining nature, or it is an ethical system which, thought its appeal to the ignorance and superstition of the masses, elevates among them a tolerance of the injustices they suffer under the existing political and economic arrangements.”

দশ: নৈরাজ্যবাদ বলতে কেবলমাত্র একটি আর্থ-রাজনীতিক কর্মসূচীকে বোঝায় না। নৈরাজ্যবাদ হল আসলে সামাজিক বিন্যাসের একটি দর্শন। জনজীবনের সকল ক্ষেত্রেই এর প্রাসঙ্গিকতা পরিলক্ষিত হয়। অধ্যাপক জোহারী মন্তব্য করেছেন: “(It) is a philosophy of social arrangements applying to every activity of human beings-education, marriage, religion as well as work and order.”

এগার: নৈরাজ্যবাদী সমাজব্যবস্থা: নৈরাজ্যবাদীরা রাষ্ট্রহীন ও শ্রেণীহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার পক্ষপাতী। অভিন্ন রুচিসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ বিশেষ বিশেষ উদ্দেশ্যসমূহের জন্য পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। সমাজের প্রয়োজনীয় দ্রব্য-সামগ্রী উৎপাদনের উদ্দেশ্যে তারা পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতা করবে। কোন প্রতিযোগিতা থাকবে না, থাকবে স্বাধীন সহযোগিতা। গোষ্ঠী গড়ে তোলার জন্য কোন রকম বাধ্যবাধকতা থাকবে না। কোন রকম বলপ্রয়োগ ব্যতিরেকেই থাকবে স্বেচ্ছামূলক গোষ্ঠীসমূহ। কোন রকম সংঘাত থাকবে না, থাকবে পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা। নিজেদের উন্নয়ন ও বিকাশের জন্য সহায়ক পথে ব্যক্তিবর্গ নিজেদের গোষ্ঠীবদ্ধ করবে। সমগ্র সমাজের স্বার্থে প্রত্যেকে অপরকে সাহায্য করবে। অপ্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপ, নিয়ন্ত্রণ বা বাধ্যবাধকতা না থাকলে এ রকম পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা স্বাভাবিকভাবেই সম্ভব হবে। নৈরাজ্যবাদী সমাজে ব্যাপক বিকেন্দ্রীকরণ থাকবে। জোড় তাঁর Introduction to Modern Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: Anarchism is first and foremost a plea for decentralisation, both territorial and functional.” প্রথমে স্থানীয় ভাবে ছোট ছোট গোষ্ঠী গড়ে উঠবে। তারপর ছোট ছোট গোষ্ঠীগুলির মধ্যে সংহতির সুবাদে বৃহদাকৃতির গোষ্ঠীসমূহের সৃষ্টি হবে। সমগ্র দেশব্যাপী বৃহৎ গোষ্ঠীগুলির ক্ষেত্র পরিব্যাপ্ত থাকবে। গোষ্ঠীগুলি গড়ে উঠবে নীচ থেকে উপরের দিকে, উপর থেকে নীচের দিকে নয়। গোষ্ঠী-সমূহের মধ্যে বিবাদ-বিসংবাদের সৃষ্টি হলে সমঝোতার ব্যবস্থা করতে হবে। তবে নৈরাজ্যবাদী সমাজব্যবস্থা স্বেচ্ছামূলক ভিত্তিতে সংগঠিত বলে বাস্তবে কোন রকম বিরোধ না থাকাই সম্ভব। গোষ্ঠীগুলি হবে স্বাভাবিক ও সামঞ্জস্যপূর্ণ। স্বাভাবিক সম্প্রীতি ও সহযোগিতার চেতনা সমাজব্যবস্থায় বর্তমান থাকবে।

নৈরাজ্যবাদের সমালোচনা ও মূল্যায়ন

নৈরাজ্যবাদীদের বক্তব্য বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। সমালোচকরা নৈরাজ্যবাদের সমালোচনা প্রসঙ্গে বিভিন্ন যুক্তির অবতারণা করেছেন। এই সমস্ত যুক্তির মধ্যে কতকগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

(১) রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ অপরিহার্য: নৈরাজ্যবাদীরা রাষ্ট্রের পুরোপুরি বিলোপ সাধনের কথা বলেন। রাষ্ট্রের বিলোপ সাধন সম্পর্কিত ধারণা অবাস্তব, অসম্ভব ও অনভিপ্রেত। নৈরাজ্যবাদীরা রাষ্ট্রের বদলে স্বেচ্ছামূলক সংগঠনসমূহের উপর গুরুত্ব আরোপের পক্ষপাতী। কিন্তু স্বেচ্ছামূলক সংগঠনসমূহ রাষ্ট্রের সকল কাজকর্ম সম্পাদনে সক্ষম হবে না। সুস্থ ও স্বাভাবিক জনজীবনের স্বার্থে এমন কিছু কিছু কাজকর্ম আছে, যা সম্পাদন করা রাষ্ট্র ব্যতিরেকে অন্য কোন সংগঠনের পক্ষে সম্ভব নয়। সুতরাং স্বাভাবিক সমাজ জীবনের স্বার্থে কোন-না-কোন এক ধরনের কর্তৃপক্ষের অস্তিত্বের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা যায় না। অন্যথায় সমাজে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটবে। এবং সুস্থ সমাজজীবন অসম্ভব হয়ে পড়বে। এ বিষয়ে বার্ট্রান্ড রাসেল মন্তব্য করেছেন: “The state in spite of what anarchists urge seems a neces sary institution for certain purposes. Peace and War, Tariffs, regulation of sanitary conditions and of the sale of noxious drugs, the preservation of just system of distribution; these among others, are functions which could hardly be performed in a community in which there was no central government. The state, though at present a source of much evil, is also a means to certain good things, and will be needed so long as violent and destructive impulses remain.”

(২) ধ্বংসাত্মক মতবাদ: সমালোচকদের অভিযোগ অনুযায়ী নৈরাজ্যবাদীদের মতবাদ হল ধ্বংসাত্মক মতবাদ। উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য নৈরাজ্যবাদীরা পশুশক্তি ব্যবহারের ব্যাপারেও পিছপা হন না। নৈরাজ্যবাদীরা পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা ও সম্ভাব-সম্প্রীতির ভিত্তিতে এক সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার পক্ষপাতী। তবে তাঁরা হিংসা, হত্যা ও ধ্বংস সাধনের মাধ্যমে এ ধরনের সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু হত্যার নিষ্ঠুরতা ও ধ্বংসের ভয়াবহতার আতঙ্ক-আশঙ্কার পরিবেশ-পরিমণ্ডলের মধ্যে সম্প্রীতি ও সহযোগিতাপূর্ণ সমাজ গড়ে উঠতে পারে না। ধ্বংস সাধন, হিংসাত্মক কার্যকলাপ ও হত্যাকান্ডের অমানবিকতার মাধ্যমে ভালোবাসার সৃষ্টি সম্ভব নয়। নৈরাজ্যবাদীরা সমকালীন সমস্যাদির সমাধানের উদ্দেশ্যে যে সমস্ত উপায়-পদ্ধতি নির্দেশ করেছেন, তার ফলে সমস্যাসমূহ বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে এবং সংকটের সৃষ্টি হবে। এই কারণে সমালোচকরা নৈরাজ্যবাদীদের ধ্বংসাত্মক দর্শনের প্রবক্তা হিসাবে অভিযুক্ত করেন। জোহারী তাঁর Principles of Moderm Political Science শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বলেছেন: “The Methods of violence as suggested by revolutionary anarchists should not be appreciated. Violence begets violence. The teste of blood can never be forgotten. Those who once indulge in the acts of violence, develop a liking for it. It may be feared that a violent revolution would lead to bloodshed and destruction of public property. To adopt the path of violence is to tread the path of fire.”

(৩) আধুনিক সমাজে রাষ্ট্র দরকার: আধুনিক সমাজের সমস্যাসমূহ বহু, বিভিন্ন এবং অতিমাত্রায় জটিল প্রকৃতির। এই সমস্ত সমস্যার সম্যক সমাধানের স্বার্থে বিশেষ ধরনের বিচক্ষণতা সামর্থ্য আবশ্যক। স্বেচ্ছামূলক সংগঠনসমূহের সদস্যদের মধ্যে এ ধরনের সামর্থ্যের অস্তিত্ব আশা করা যায় না। রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ক্ষেত্রে অপরিহার্য প্রতিপন্ন হয়। মানুষ প্রকৃতিগতভাবে স্বার্থপর। মানুষের স্বার্থপরতার মোকাবিলার জন্য রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য।

(৪) কর্তৃত্ব ও স্বাধীনতা পরস্পর বিরোধী নয়: নৈরাজ্যবাদীদের অভিমত অনুসারে কর্তৃত্ব ও স্বাধীনতার মধ্যে মৌলিক বিরোধিতা বর্তমান। কিন্তু নৈরাজ্যবাদীদের এই ধারণা সঠিক নয়। প্রকৃত প্রস্তাবে কর্তৃত্ব ও স্বাধীনতার মধ্যে কোন রকম বিরেধিতা নেই। রাষ্ট্র ও সরকার না থাকলে স্বাধীনতা সুনিশ্চিত হতে পারে না। রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বই সমাজে স্বাধীনতাকে নিরাপদ ও নিশ্চিত করে। রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ব্যতিরেকে বলবান ও বিত্তবানেরাই স্বাধীনতা ভোগ করবে, সকলের স্বাধীনতা ভোগ সম্ভব হবে না। রাষ্ট্রহীন রাজত্বে ‘জোর যার মূলুক তার এই বন্য বিধান কায়েম হবে।

(৫) রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব সর্বক্ষেত্রে পীড়নমূলক নয়: নৈরাজ্যবাদী মতবাদে রাষ্ট্রের প্রকৃতি ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বকে পীড়নমূলক বলে অভিযুক্ত করা হয়েছে। নৈরাজ্যবাদীদের এই অভিযোগও অতিরঞ্জিত। রাষ্ট্রের কার্য সম্পাদনের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক উপায়-পদ্ধতির সঙ্গে সঙ্গে সহযোগিতামূলক পন্থা-পদ্ধতি অনুসৃত হতে দেখা যায়। সামাজিক পরিষেবামূলক কাজকর্ম সম্পাদনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ বলপ্রয়োগ করে না বা বাধ্যবাধকতা আরোপ করে না। এ রকম অনেক ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম পশুশক্তির প্রয়োগমুক্ত। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব সর্বক্ষেত্রে পীড়নমূলক নয়।

(৬) সাধারণভাবে বলা হয় যে, ব্যক্তি মানুষের নীতিবোধ নিজের থেকেই বিকশিত হয়। তবে রাষ্ট্রও মানুষের নীতিবোধের বিকাশে সাহায্য করতে পারে। রাষ্ট্র নীতিবোধ বিকাশের উপযোগী সহায়ক পরিবেশ পরিমণ্ডল গড়ে তুলতে পারে। এই কারণে বলা হয় যে, রাষ্ট্র ব্যতিরেকে মানুষের স্বতস্ফূর্ত বিকাশ সম্ভব নয়।

(৭) অবাস্তবতার সীমাবদ্ধতা: সমালোচকদের অভিযোগ অনুসারে নৈরাজ্যবাদ অবাস্তবতা দোষে দুষ্ট। নৈরাজ্যবাদী সমাজব্যবস্থার যে চিত্র চিহ্নিত হয়েছে তা বাস্তবে রূপায়িত করা এক রকম অসম্ভব। নৈরাজ্যবাদী সমাজের পরিকল্পনা যে সমস্ত ধ্যান-ধারণার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে তা জীবনের বাস্তবতার উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। নৈরাজ্যবাদীরা বিশ্বাস করেন যে বিভিন্ন ও বহুগোষ্ঠী সমন্বিত সমাজে সমন্বয় সামঞ্জস্য স্বাভাবিকভাবেই বজায় থাকবে। কিন্তু ও ধারণা বহুলাংশে কাল্পনিক। সমাজে বহু ও বিভিন্ন গোষ্ঠী থাকলে গোষ্ঠীসমূহের মধ্যে বিবাদ-সংঘাতের সৃষ্টি হবেই এবং সে ক্ষেত্রে তা নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। রাষ্ট্র ব্যতিরেকে স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচারিতায় পরিণত হয়। নৈরাজ্যবাদীরা যে সীমাহীন স্বাধীনতার কথা বলেন, তা বাস্তবায়িত করা সম্ভব নয়। গ্রে তাঁর The Socialist Tradition শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “The fundamental trouble with the anarchist is that though he may be highly intelligent, he has no sense. It follows that a fruitful discussion of anarchism is almost an impossibility. If they do not realise that have set their nest among the stars, no word of man will persuade them that their thoughts are moving in a world unreal and unrealisable. Anarchists are a race of highly intelligent and imaginative children who nevertheless can scarcely be trusted to look after themselves outside the nursery pen.”

(৮) মানবসভ্যতা ও রাষ্ট্র: সাধারণভাবে বলা হয় যে, মানবসভ্যতার বিকাশ এবং রাষ্ট্রের অস্তিত্ব পরস্পরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নৈরাজ্যবাদীদের অভিমত অনুযায়ী বর্তমান রাষ্ট্রের বিলোপ সাধন করতে হবে এবং রাষ্ট্রের জায়গায় অন্যান্য স্বেচ্ছামূলক সংগঠনসমূহের অস্তিত্বকে স্বীকার ও সমর্থন করতে হবে। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের মতই প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি হবে। এবং তা আসলে সরকারের পরিবর্তন হিসাবেই প্রতিপন্ন হবে। সভ্য সমাজজীবনে কোন না কোন ধরনের সরকারের অস্তিত্ব অপরিহার্য। অন্যথায় মানব সভ্যতার অগ্রগতি অসম্ভব। রাষ্ট্রই সভ্যতার অগ্রগতির উপযোগী পরিবেশে-পরিমন্ডল সৃষ্টি করে। রাষ্ট্র ব্যতিরেকে শান্তি ও প্রগতি অনিশ্চিত।

(৯) মানুষের অযৌক্তিক আচরণ: নৈরাজ্যবাদে মানুষের যুক্তিবাদিতার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। অথচ বিশ্বব্যাপী মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বিচার-বিশ্লেষণের সুবাদে জানা যায় যে, ব্যক্তি মানুষের আচার-আচরণের অযৌক্তিক উপাদান বা শক্তিসমূহের প্রভাব প্রতিক্রিয়া অধিক। মানুষের মধ্যে সহযোগিতামূলক প্রবণতার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক প্রবণতার প্রাধান্যকে অস্বীকার করা যায় না। অর্থাৎ নৈরাজ্যবাদীদের অনেক ধারণাই বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্করহিত। কোকার তাঁর Recent Political Thought শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “Most anarchist doctrines rest upon assumptions of the predominance of the social and co-operative, not the self-seeking and competitive instincts of man.”

গার্নার: নৈরাজ্যবাদের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে গার্নার-এর একটি মন্তব্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। গার্নার তাঁর Political Science and Government শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: ‘It is sufficient to say that the whole case of anarchism is defective, first, because it rests upon unfounded assumptions regarding the character of what they call ‘coercive government, and second, because the substitutes which they propose to take its place would prove wholy inadequate to meet the situation which exists in the complex societies of today. Their criticism of the state is not without some justification, but it is grossly exaggerated and any affective conceivable substitute would not be free the some objection.”

বহু বিরূপ সমালোচনা সত্ত্বেও রাষ্ট্রনীতিক চিন্তাজগতে নৈরাজ্যবাদী চিন্তাবিদদের সদর্থক অবদানকে অস্বীকার করা যায় না। নৈরাজ্যবাদী বক্তব্যের সমর্থনেও বিবিধ যুক্তির অবতারণা করা হয়। সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও নৈরাজ্যবাদের ইতিবাচক দিকগুলিকে উপেক্ষা করা যায় না।

(১) আধুনিককালে রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও কার্যাবলীর পরিধি অতিমাত্রায় প্রসারিত হয়েছে। এই অবস্থায় এক প্রবল প্রতাপান্বিত আমলাতন্ত্রের সৃষ্টি হয়েছে। জনজীবনের বিভিন্ন দিক বর্তমানে আমলারাই ব্যাপক ও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। আধুনিককালে রাজনীতিক ক্ষমতা আকারে প্রকারে বিশেষভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই প্রবণতার বিপদের দিকটিকে উপেক্ষা করা যায় না। এ বিষয়ে সকলের সতর্কতার প্রয়োজনীয়তার উপর নৈরাজ্যবাদে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।

(২) অপর কোন ব্যক্তির সম্মতি ব্যতিরেকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির উপর শাসন কায়েম করার কোন অধিকার কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের নেই। এই নীতিটির উপর নৈরাজ্যবাদীরা বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁদের আরও অভিমত হল যে, ন্যায় ও স্বাধীনতাকে সুনিশ্চিত করার জন্য বলপ্রয়োগের অবসান আবশ্যক। বলপ্রয়োগের ঘটনা ঘটলে ন্যায় ও স্বাধীনতা থাকতে পারে না। এ কথাও অস্বীকার করা যায় না।

(৩) নৈরাজ্যবাদে রাষ্ট্রকে দুর্বল করে স্বেচ্ছামূলক সংগঠনমূলক ও গোষ্ঠীসমূহকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এইভাবে নৈরাজ্যবাদীরা জনসাধারণের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগ আয়োজনের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এ ধরনের সহযোগিতা ও উদ্যোগ সামাজিক উন্নয়ন ও প্রগতির সহায়ক।

(৪) নৈরাজ্যবাদে শোষণ-পীড়ন, দুঃখ-দুর্দশা ও অন্যায় অবিচারের প্রবল বিরোধিতা করা হয়েছে। এই সমস্ত কিছুর অবসানের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। ধর্ম ও কুসংস্কারের নামে সমাজে মানুষের উপর শোষণ-বঞ্চনা চাপিয়ে দেওয়া হয়। নৈরাজ্যবাদে এ সব বিষয়ের প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। এ দিক থেকে বিচার করলে নৈরাজ্যবাদের গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না।

(৫) নৈরাজ্যবাদীরা ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও পুঁজিবাদের তীব্র বিরোধিতা করেন। আধুনিককালের সমাজব্যবস্থায় ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও পুঁজিবাদের ক্ষতিকর দিকগুলির প্রতি নৈরাজ্যবাদে সকলকে সতর্ক করা হয়েছে।

বস্তুত বর্তমানে রাজনীতিক ক্ষমতার প্রবল কেন্দ্রীভবনের প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। মানুষের জীবনধারা বর্তমানে বহুলাংশে যান্ত্রিক হয়ে পড়েছে। নৈরাজ্যবাদী দার্শনিকরা এ সবের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ জানিয়েছেন। নৈরাজ্যবাদে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং স্বেচ্ছামূলক সংগঠনসমূহের গুণাবলীর উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ছোট ছোট সামাজিক একক, আঞ্চলিকতাবাদ ও যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে সমর্থন করা হয়েছে। যথার্থ ন্যায় বিচার ও স্বাধীনতার উপর নৈরাজ্যবাদে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। জোেড় তাঁর Introduction to Modern Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “A complex inter weaving of associations with order everywhere and compulsion nowhere, forms the stuff of which an Anarchist society will be made. For Anerchy, as Mr. Lowes Dickinson puts it is not the absence of order, it is the absence of force.” জোহারী তাঁর Principles of Modern Political Science শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “The merit of anarchist theory should be traced not in their consistent attack on political authority and system of capitalism, it should be seen in their protection of the design of a future society which would be classless and stateless both.”