প্রশ্নঃ নৈতিক সংকট বলতে কি বুঝ? সমকালীন বিশ্বে নৈতিক সংকটের কারণগুলো আলোচনা কর ৷ এর প্রতিরোধের উপায়সমূহ আলোচনা কর।
অথবা, নৈতিক সংকটের সংজ্ঞা দাও৷ নৈতিক সংকটের কারণ ও তার প্রতিরোধের উপায় আলোচনা কর।
ভূমিকাঃ নীতিবিদ্যার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নৈতিকতা বিষয়ক পাঠ। এই নৈতিকতা বিষয়ে পাঠ করতে গিয়ে নৈতিক সংকটের বিষটিও আলোচ্য বিষয় বস্তুতে অন্তর্ভুক্ত হয়। সমাজের সবাই চায় যে সমাজের প্রচলিত নিয়ম-কানুন শৃঙ্খলা অটুট থাকুক। কিন্তু তারপরও মানুষ অনৈতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়। ফলে নৈতিকতার সংকট দেখা দেয়। বর্তমানে সারা বিশ্বে নৈতিকতার সংকট একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা।
নৈতিকতার সংকটঃ নৈতিক সংকট বলতে বোঝায় নৈতিকতার অভাবকে। যদি কোনো সমাজে মানুষের মূল্যবোধ দূর্বল হয়ে পড়ে, মানুষ খুন, হত্যা, চুরি, ডাকাতি প্রভৃতি অপরাধমূরক কাজের সাথে জড়িয়ে পড়ে সামাজিক শৃঙ্খলা ও শান্তি উচ্ছন্নে যায় তখন সেখানে নৈতিক সংকট হয়েছে বলা যায় ৷
কোনো একটি সমাজে নৈতিকতার সংকট একদিনে বা কোনো একক কারণে সৃষ্টি হয় না। এর পেছনে পরিবার থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা রাজনীতি প্রভৃতির ভূমিকা এখানে কারণ হিসেবে কাজ করে। একটি শিশু জন্মের পর পরিবার থেকেই প্রথম শিক্ষা লাভ করে। এক্ষেত্রে শিশুর পরিবার যদি শিশুকে নৈতিকতার ভুল শিক্ষা দেয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা ব্যবস্থায় যদি নৈতিক গুণাবলি বিকাশের শিক্ষা না দেওয়া হয় বিভিন্ন বিষয়ে ভুল ও অন্যায় শিক্ষা দেওয়া হয়, অর্থনীতিতে যদি মন্দা অবস্থা বিরাজ করে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং নৈতিকতার অভাব থাকে তবে শিশুর মধ্যেও নৈতিকতার জ্ঞান প্রতিষ্ঠিত হবে না। সে অনৈতিক এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হবে। এবং সমাজে নৈতিক সংকট দেখা দিবে। তাই নৈতিকতার সংকট দূর করতে হলে পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে জীবনের সকল ক্ষেত্রে নৈতিক শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করা একান্ত প্রয়োজন।
নৈতিক সংকটের কারণঃ এমন কোনো সমাজই পাওয়া যাবে না যেখানে কম বেশি নৈতিক সংকট দেখা যায় না। নানা কারণে সমাজের মধ্যে নৈতিক সংকট লক্ষ করা যায়। সে সকল কারণে নৈতিক সংকট দেখা দেয় নিচে সেগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলোঃ
১. নৈতিক মানদণ্ড অনুসরণ না করাঃ সমাজে যে নৈতিক মানদণ্ড প্রচলিত রয়েছে মানুষের মধ্যে তা অনুসরণ না করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এই উপসর্গটি যে সমাজে বিদ্যমান সেখানে লক্ষ্য করা যায় যে, মানুষ নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য যে কোনো অর্থনৈতিক কাজ অবলীলায় করে চলে। নীতি বিজ্ঞান একে নীতি শূন্যতা বাদও বলা হয়।
২. সাংস্কৃতিক আগ্রাসনঃ পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির প্রতিযোগিতায় দুর্বল সংস্কৃতি মানুষকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে। পাশ্চাত্যের জীবন পদ্ধতি, পোশাক পরিচ্ছেদ, চলাফেরা ইত্যাদি সমাজ সমাজের বিদ্যমান নৈতিক মানদণ্ডের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ছে। ফলে নৈতিক সংকট দেখা দিচ্ছে।
৩. প্রযুক্তির অপব্যবহারঃ একবিংশ শতাব্দীতে এসে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি স্বাধীন হয়েছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। কিন্তু প্রযুক্তির অপব্যবহার যেমন- Cyber Crime এবং বিভিন্ন মারণাস্ত্র যেমন- পারমাণবিক বোমা, ক্ষেপাণাস্ত্র, সাবমেরিন, ট্যাঙ্ক, যুদ্ধবিমান ইত্যাদির আবিষ্কার পৃথিবীকে সংকটপূর্ণ করে তুলেছে। তাই বলা যায় প্রযুক্তির অপব্যবহার নৈতিক সংকটের ব্যাপকতা বৃদ্ধি করছে।
৪. ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার অভাবঃ বর্তমানে প্রতিযোগিতাপূর্ণ বিশ্বে মানুষ জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা করতে করতে মানুষ ধর্মীয় ও নৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়ছে। ফলে নৈতিক সংকট দেখা দিচ্ছে।
৫. ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থের প্রাধান্য ও সম্পদের অসম বণ্টনঃ সমাজে সবার জন্য সর্বাধিক কল্যাণের বদলে একটি বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। সমাজের অধিক সম্পদ বণ্টিত হচ্ছে মুষ্টিমেয় মানুষের মধ্যে এবং মুষ্টিমেয় সম্পদ বণ্টিত হয় অধিক মানুষের মধ্যে। এমত অবস্থায় বঞ্চিত ও শোষিত শ্রেণির কাছ থেকে নৈতিক আচরণ আশাকরন ভুল।
নৈতিক সংকট প্রতিরোধের উপায়ঃ বর্তমানে সারা বিশ্বের উদ্বেগের বিষয় হলো নৈতিক সংকট। তাই নীতিবিদগণ এটি দূর করার উপায় সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা ভাবনা করছে। যে সকল উপায়ে নৈতিক সংকট দূর করা যায় সেগুলো নিম্নরূপঃ
১. সাংস্কৃতিক আগ্রাসন প্রতিরোধঃ পশ্চিমা সংস্কৃতি বাধাহীন প্রবাহে তৃতীয় বিশ্বের সংস্কৃতি দিকগুলো হারিয়ে যাচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের সংস্কৃতি পশ্চিমা সাংস্কৃতির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। তাই সৃষ্টি হচ্ছে সংস্কৃতিক গ্যাপ। যেখান থেকে সৃষ্টি হচ্ছে সাংস্কৃতিক সংকট। সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বন্ধ করা গেলে নৈতিক সংকট কিছুটা দূর করা সম্ভব হবে।
২. প্রযুক্তির অপব্যবহার বন্ধ করাঃ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যেমন মানুষের জীবনকে স্বাচ্ছন্দ্য দিয়েছে তেমনি এর অপব্যবহার মানুষের জীবনকে করেছে সংকটপূর্ণ। Cyber crime, পর্ণোগ্রাফি, বিভিন্ন ধরনের মারাত্মক সব মরণাস্ত্রের আবিষ্কার ও তার যথেষ্ট ব্যবহার মানুষের মধ্যে নৈতিকার সংকট তৈরি করছে। তাই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহারের ক্ষেত্রে কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপ করা গেলে নৈতিক সংকট দূর করা সম্ভব হবে।
৩. ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার প্রসারঃ মানুষের মনে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সৃষ্টির ধর্মীয় শিক্ষার বিকল্প নেই। তাই ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার বিকল্প নেই। তাই ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার প্রসার ঘটানো গেলে নৈতিক সংকট দূর করা সম্ভব।
৪. পরিবারের ভেতরকার বন্ধন সুদৃঢ় করাঃ বর্তমানে পারিবারিক বন্ধন অনেক শিথিল হয়ে গেছে। পারিবারিক ভাঙন এখন অহরহ দেখা যাচ্ছে। যার ফলে নৈতিক সংকট তীব্র আকার ধারণ করছে। পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করা গেলে এই সংকট অনেকাংশে দূরীভূত করা সম্ভব হবে।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, পরবর্তীতে যত প্রতিযোগিতাপূর্ণ এবং গতিশীল হচ্ছে তত নৈতিক সংকট বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে এটি কোনো স্থায়ী সমস্যা নয়। উপরোক্ত ব্যবস্থাসহ সম্পদের সুষম বণ্টন, মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ ইত্যাদি ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে নৈতিক সংকটও দূর করা সম্ভব হবে।
Leave a comment