ভূমিকাঃ নেতৃত্ব একটি শিল্প। পৃথিবীতে এই শিল্পের কুশলীর অভাব প্রচন্ড। নেতৃত্ব শব্দটি ছোট্ট কিন্তু ব্যাপক অর্থবোধক। এই ছোট্ট শব্দটির প্রায়োগিক গুরুত্ব এত বেশি যে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র কোনো কিছুই এর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করতে পারে না। যেকোনো সংগঠন, সমাজ বা রাষ্ট্রে সুষম উন্নয়ন ও এর ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছার কেবলমাত্র উপায় হলো একটি যোগ্য নেতৃত্ব।
নেতৃত্বের শ্রেণীবিভাগ (Classification of Leadership): নেতৃত্ব বহু ধরনের হতে পারে। যেখানেই জনগোষ্ঠী, সংগঠন, রাজনীতি প্রভৃতি বিদ্যমান সেখানেই ক্ষুদ্র বা বৃহৎ নেতৃত্ব অপরিহার্য। নেতৃত্বের ধরন-ধারণ ও প্রকৃতি কতিপয় সংশ্লিষ্ট অনিবার্য বিষয়ের উপর নির্ভরশীল বিধায় নেতৃত্বের মধ্যে শ্রেণীবিভাগ রয়েছে। নিচে নেতৃত্বের এ সকল শ্রেণীবিভাগ সম্পর্কে আলোচনা করা হলোঃ
একনায়কতান্ত্রিক নেতৃত্বাধীন (The Authoritarian Leadership): ব্যক্তির কর্তৃত্বের উপর একনায়কতান্ত্রিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত। নেতা কিভাবে সভা পরিচালিত হবে এবং সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে এ দুটি দিকই নির্দেশ করেন। এ পদ্ধতিতে নেতা একক শাসক হিসেবে কার্য পরিচালনা করেন এবং তার সহকর্মীরা সাধারণত তার অধীনস্থ থাকেন। তবে অধীনস্থ কর্মচারীরা তাদের গোষ্ঠী তৎপরতার অংশীদার বলে সাধারণত বিবেচিত হয় না। একনায়কতান্ত্রিক নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন ব্যক্তি অন্য কাউকেই তাঁর ক্ষমতার অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করেন না। তিনি তার সহকর্মীদের সাথে দায়িত্ব বণ্টন করে নিতে অপ্রস্তুত। তিনি মনে করেন যে, যদি তিনি তার সহকর্মীদের দায়িত্বের অংশীদার করেন তাহলে অধীনস্থ কর্মচারীদের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং তিনি ক্রমশ তার ক্ষমতা হারাবেন এবং ধীরে ধীরে এমন এক পরিস্থিতির উদ্ভব হবে যখন অধীনস্থ কর্মচারীরা আর তাঁকে নেতা হিসেবে মানবেন না যার ফলে তিনি তার অধীনস্থ কর্মচারীদের উপর নেতৃত্ব ক্ষমতা পরিচালনার উপর অত্যন্ত সজাগ থাকেন।
একজন একনায়কতান্ত্রিক নেতা বিশ্বাস করেন যে, উদ্দেশ্যেই উপায়কে সমর্থন দান করে। তিনি ব্যক্তিস্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেন না। বরং লক্ষ্য অর্জন করার পথে অন্যদেরকে ব্যবহার করে। কিন্তু প্রত্যেক মানুষকেই তাদের নিজেদের লক্ষ্য হিসেবে মনে করা উচিত, মাধ্যম হিসেবে নয় ৷ যদিও এ ধারণা একনায়কতান্ত্রিক নেতৃত্বের মতবাদের বিরোধিতা করে। একনায়কতান্ত্রিক নেতা অন্যদেরকে তার মাধ্যমে এবং হাতের পুতুল বলে মনে করেন এবং তার ব্যক্তিস্বার্থের উন্নয়নে অন্যদেরকে সুবিধাজনকভাবে ব্যবহার করে থাকেন।
তিনি আরো বিশ্বাস করেন যে, তার ধারণা সবসময়েই সঠিক এবং তিনি ভুল করতে পারেন না। নিজেকে তিনি একজন দক্ষ কর্ম পরিচালক এবং বিচার প্রতিষ্ঠার প্রবর্তক বলে জ্ঞান করেন। একনায়কতান্ত্রিক নেতা নিজ ধ্যান-ধারণায় অটল থাকেন এবং সর্বক্ষেত্রেই তার সিদ্ধান্তকে চূড়ান্ত হিসেবে গণ্য করেন। তাই তিনি তার দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতাকারীদের জুলুম করেন। তিনি না ভেবে তার সিদ্ধান্ত অধীনস্থদের উপর প্রায়ই না ভেবে অর্পণ করেন এভাবে তিনি তার সিদ্ধান্ত কার্যকর করার জন্য দমন উৎপীড়ন নীতির আশ্রয় গ্রহণ নেন।
সে সাংগঠনিক কর্মে গোষ্ঠী তৎপরতা ও অংশগ্রহণকে প্রশ্রয় দেন। সে ক্ষেত্রে সংগঠনের সদস্যগণ কোনরূপ যুক্তিবোধ দ্বারা পরিচালিত না হয়ে নেতার আদেশ পালন করে যাবেন। তারা মনে করেন যে, নেতা তাদের মতামতকে উপেক্ষা করেই সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যাবেন। বস্তুত এতে সংগঠনের সদস্য এবং নেতার মধ্যে এক প্রকার প্রভু-ক্রীতদাস সম্পর্ক বিরাজ করে।
একজন একনায়কতান্ত্রিক নেতা তার উদ্দেশ্য সাধনের জন্য কয়েকটি পদ্ধতি অবলম্বন করেন। পদ্ধতিগুলো হলোঃ
১। নেতার নির্দেশ ব্যতীত তার অনুসারীরা কোন সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা করতে পারে না।
২। একনায়কতান্ত্রিক নেতা প্রায়শই তার অনুসরণকারীদের কাজে বাধার সৃষ্টি করেন।
৩। তিনি স্বীয় ইচ্ছামত সভার আলোচ্য বিষয় নির্ধারণ করেন।
৪। সভার কার্য কিভাবে পরিচালিত হবে সে সম্পর্কে একনায়কতান্ত্রিক নেতা আদেশ ও নির্দেশ প্রদান করেন।
৫। কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের ক্রিয়াকলাপ এবং আচরণের ক্ষেত্রে তিনি বিশেষভাবে মনোনিবেশ করেন।
৬। যারা তার সর্বাধিক অনুগত একনায়কতান্ত্রিক নেতা কেবল তাদের প্রশংসা করেন ৷
৭। একনায়কতান্ত্রিক নেতা তার প্রশ্নের সঠিক উত্তর কি হওয়া উচিত সে সম্পর্কে পূর্বেই উত্তরদানকারীকে আভাস দিয়ে দেন।
৮। কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তিনি অনেক সময় অপ্রাসঙ্গিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে উৎসাহী হয়ে উঠেন।
৯ । তিনি বলপূর্বক অনুসারীদের উপর তার সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেন।
১০। তিনি তার খেয়ালখুশি অনুযায়ী অনুসারীদের মতামতকে অনুমোদন করেন বা নাকচ করে দেন।
গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব (Democratic Leadership):
এমন কতকগুলো কলাকৌশলের উপর একজন সর্বাত্মকবাদী নেতা নির্ভর করে যা মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধ করে দেয় এর বিপরীতে গণতান্ত্রিক নেতা অংশগ্রহণকারীদের যথেষ্ট মুক্তি ও স্বাধীনতা দেয়। একজন গণতান্ত্রিক নেতার সমস্যার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি থাকে ইতিবাচক। গণতান্ত্রিক নেতৃত্বে একনজর নিয়ন্ত্রণ না থেকে অনেক মানুষের নিয়ন্ত্রণ থাকে। এতে প্রত্যেক অংশগ্রহণকারী সংগঠনের একজন মূল্যবান সদস্য হিসেবে বিবেচিত হয়। এভাবে গণতান্ত্রিক নেতৃত্বে শ্রেণী সদস্যদের উপর স্বাধীনতার প্রভাব থাকে। গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের প্রয়োজন এ জন্য দেখা দেয় যে, এটি জনসাধারণকে কতিপয় নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে পরিচালিত করে। নেতার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং দৃষ্টিভঙ্গির একটি গুরুত্বপূর্ণ মূল্য রয়েছে। গণতান্ত্রিক নেতৃত্বদান সর্ব সময়ই স্বার্থক হয়।
অংশগ্রহণকারীদের উদ্যোগ প্রদর্শনের জন্য একজন গণতান্ত্রিক নেতা অনুমতি প্রদান করে । গণতান্ত্রিক নেতৃত্বে অংশগ্রহণকারীদের চিন্তাশীল, আবিষ্কারক এবং সৃষ্টিশীল হওয়ার জন্য অনুমতি দেয়া হয়। যদি তাদিগকে এরূপ হওয়ার জন্য অনুমতি না দেয়া হয় তাহলে তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণে দায়িত্ব অনুভব করবে না তাদের ব্যক্তিত্বের বিকাশ এবং উন্নতি সাধন করতেও সক্ষম হবে না।
যখন গোষ্ঠীর সদস্যরা অনুভব করে যে, তারা সিদ্ধান্তে অংশগ্রহণ করছে তাহলে সবচেয়ে ভাল ফল আশা করা যায়। কোন গণতান্ত্রিক নেতৃত্বদানে যে সিদ্ধান্তে পৌঁছা হয় তা কোন ব্যক্তির বা অংশগ্রহণকারীর ব্যক্তিগত বিজয় হিসেবে ধরা হয় না। কোন গণতান্ত্রিক নেতা তার গোষ্ঠীর সদস্যদের সাথে পূর্ব আলোচনা ব্যতীত কখনও চূড়ান্ত কথা বলতে পারেন না। এরূপে তার সর্বশেষ ক্ষমতা তার গোষ্ঠী সদস্যদের ভিতর নিহিত রয়েছে, তিনি যাদেরকে পরিচালনা করেন।
কিন্তু একজন সর্বাত্মকবাদী নেতা যোগাযোগকে স্বীয় কর্তৃত্ব হতে উদ্ভূত বলে মনে করেন এবং তা গোষ্ঠীর দিকে ধাবিত হয়। অংশগ্রহণকারী তাদের সমস্ত কিছু নেতার জন্য পরিচালনা করে। স্পষ্টত এ ধরনের যোগাযোগ কখনও স্পষ্টভাবে গোষ্ঠীর মধ্যে সংযোগ সাধনকারী হিসেবে কাজ করে না। ফলে দলগতভাবে কাজ কখনও উন্নত হয় না। কিন্তু গণতান্ত্রিক নেতৃত্বে অংশগ্রহণকারীদের সমস্ত কিছু নেতার দিকে পরিচালিত হয় না। পক্ষান্তরে, তাদের সমস্ত অবদান গোষ্ঠীর দিকে যায়।
গণতান্ত্রিক নেতা সর্বদা গোষ্ঠীর সদস্যদের কল্যাণের জন্য সতর্ক থাকেন। সদস্যগণ প্রকাশ্যভাবে তাদের সমস্যা আলাপ-আলোচনার অন্য স্বীকৃতি, অনুমোদন এবং সুযোগ-সুবিধা দাবি করে। কিন্তু অন্যদিকে একজন সর্বাত্মকবাদী নেতা, গোষ্ঠীর সদস্যদের ব্যক্তিগত অভাব পূরণের পথে বাধার সৃষ্টি করে। গণতান্ত্রিক নেতৃত্বদানের এ অবস্থা সম্পূর্ণ বিপরীত; এতে তাদের অংশগ্রহণকারীদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি যথাযথ মনোযোগ দেয়া হয়। তিনি সর্বদাই অংশগ্রহণকারীদের ইচ্ছা এবং তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা না করে তাদের এসব চাওয়ার প্রতি সর্বদা খেয়াল রাখেন। একজন গণতান্ত্রিক নেতা নৈতিক প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে থাকেন। একজন ভাল নেতার পরিচয় তার ব্যক্তিত্বের উপর নির্ভর করে। এটি এরূপে নৈতিক দায়িত্ববোধের সৃষ্টি করে। গণতান্ত্রিক নেতা কখনও ব্যক্তিত্বহীন হতে পারেন না।
গণতান্ত্রিক নেতা একটা মননশীলতার প্রতীক হিসেবে কাজ করেন। আর সেটা একটি গুণগত ব্যাপার যা একজন নেতার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত শক্তি হিসেবে নিহিত থাকে এবং যা তাকে সহজভাবে তার সহযোগীদের সাথে মিশতে সাহায্য করে।
অধুনা নেতৃত্বদানের অধ্যয়ন আমাদেরকে নির্দেশ দেয় যে, প্রেষণা এবং উৎপাদন নেতৃত্বদানের সাথে জড়িত যা প্রকৃতিগতভাবে গণতান্ত্রিক। এ তত্ত্বকে রেনসিস লিকার্ট (Rensis Likert) এবং ড্যানিয়েল কাট্জ (Daniel Katz) আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যান। তাদের মতে ঊর্ধ্বতন উৎপাদন পরিচালক বিষয়ের ব্যাখ্যা দান করেন কিন্তু আদেশ দান করেন না। এমনকি তিনি কর্মচারীদের সমস্যার প্রতি ব্যক্তিগতভাবে দৃষ্টি দান করেন; তিনি কর্মচারীদের উন্নতি বিধানে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে কর্মচারীদের উৎসাহ প্রদান করে থাকেন। রেনস্সি লিকার্ট এবং ড্যানিয়েল কাটজ্ লিখেছেন যে, “The individuals are more effectively motivated when they have some freedom in determining how their work should be performed. They respond more fully when treated as personalities.”
গোষ্ঠী সদস্যদের সমর্থন লাভের জন্য গণতান্ত্রিক নেতাগণ যে সকল কৌশল অবলম্বন করে থাকেন সেগুলো হলোঃ
(ক) তাদের নিকট ব্যক্তিগতভাবে গ্রহণযোগ্য হবার মাধ্যমে;
(খ) তাদের মধ্যে সহযোগিতা উন্নয়নের মাধ্যমে;
(গ) সমস্যার নির্ভরযোগ্য সমাধানের সাহায্য করার মাধ্যমে।
তত্ত্বাবধানকারী নেতৃত্ব (Supervisory Leadership): একনায়কতান্ত্রিক নেতৃত্বের কোমল রূপ তত্ত্বাবধানকারী নেতৃত্ব। একজন বাস্তবিক তত্ত্বাবধানকারী নেতা একনায়কতান্ত্রিক নেতার চেয়ে অধিকতর দয়াবান এবং বন্ধুভাবাপন্ন। তাকে অনেক সময় পিতৃতুল্য মনে করা হয়, কারণ তিনি তার দলীয় সদস্যদের সার্বিক কল্যাণ সাধনে নিয়োজিত থাকেন। তিনি কখনও নিজের স্বার্থ রক্ষায় ব্যাপৃত থাকেন না। তিনি দক্ষতা অর্জনের উদ্দেশ্যে আদেশ প্রদানের উপর সর্বোতভাবে নির্ভরশীল থাকেন। এটা তার নেতৃত্বের একমাত্র দুর্বলতা।
নেতা তত্ত্বাবধানকারী নেতৃত্বে সভার ব্যাপক আলোচনার ক্ষেত্রে এবং পদ্ধতিগত ক্ষেত্রে তার পরিকল্পনা ও পরিচালনায় নিয়োজিত রাখেন। তত্ত্বাবধানকারী নেতৃত্বকে একনায়কতান্ত্রিক নেতৃত্ব হতে কিছুটা পৃথক করে দেখা যায়। একজন একনায়কতান্ত্রিক নেতা ব্যক্তিগত কর্তব্য ও দায়িত্বে আস্থাবান। তিনি মনে করেন যে, তিনি দলীয় সদস্যদের অপেক্ষা অনেক যোগ্য এবং দক্ষ; দায়িত্ব বণ্টন করা নিতান্ত অপ্রয়োজনীয় এবং নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক। এতে দলীয় সদস্যদের সৃজনশীলতা, কর্মক্ষমতা এবং পারস্পরিক নির্ভরশীলতা রুদ্ধ হয়। পক্ষান্তরে, তত্ত্বাবধানকারী নেতৃত্বে নেতা দলীয় সদস্যদের সমস্যার প্রতি তার অভিমত ব্যক্ত করেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও সংগঠনের কাজে অংশগ্রহণকারী সদস্যদের উপদেশ ও প্রস্তাবকে উৎসাহ প্রদান করা হয় না।
ব্যক্তিস্বাধীনতার নেতৃত্ব (Laissez-faire Leadership): ব্যক্তিস্বাধীনতার নেতৃত্বে নেতার অনুসারীরা সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করে। তারা কোন নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। এতে নেতা তার অনুসারীদের ভিন্ন উপাত্ত এবং তথ্য সরবরাহ করে থাকেন কিন্তু সভার আলোচনায় তিনি কোনরূপ অংশগ্রহণ করেন না। তার অনুসারীগণ যখন তার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন তখনই কেবল তিনি কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মন্তব্য করেন নতুবা নয়। কোন বিষয়ে প্রশ্ন করা না হলে তিনি কদাচিৎ বক্তব্য প্রদান করেন। ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রবক্তা গোষ্ঠী অনানুষ্ঠানিক নেতৃত্ব গড়ে তুলতে আগ্রহী এবং তার নেতার নিকট হতে সাহায্য ও সহযোগিতা কামনা করেন। তারা নেতার অভিজ্ঞতা, দক্ষতা এবং কর্মকৌশলের উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল থাকে।
অনির্দেশিত নেতৃত্ব (Non-directive Leadership): কোন সমস্যা সমাধানের জন্য অনির্দেশিত নেতা গোষ্ঠী সদস্যদেরকে আহ্বান করেন। তিনি গোষ্ঠীর সদস্যদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবার ক্ষমতা দিয়ে থাকেন। এ সকল দিক বিবেচনা করলে অনির্দেশিত নেতৃত্বকে গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব বলে অভিহিত করা যায়। গণতান্ত্রিক নেতার ন্যায় অনির্দেশিত নেতাও একই উদ্দেশ্য অর্জন করতে সক্ষম হন, তবে তিনি উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য ভিন্ন কৌশল গ্রহণ করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে তিনি যে পন্থা অবলম্বন করেন তা পরোক্ষ এবং জটিল এরূপ নেতৃত্বের মূল ভিত্তি হচ্ছে এতে সদস্যবর্গ নিজেদের ক্ষমতা ও দক্ষতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকে। অনির্দেশিত নেতার একাধিক বৈশিষ্ট্য বা গুণ রয়েছে যা নিম্নরূপঃ
১। গোষ্ঠী সদস্যদের কর্মদক্ষতার উপর তার বিশ্বাস বা আস্থা বিরাজমান;
২। তিনি কোন বিষয়ে সদস্যদের প্রতি প্রশ্ন রাখেন এবং উক্ত প্রশ্ন সদস্যদের পুনরায় চিন্তা-ভাবনার সুযোগ প্রদান করেন;
৩। তার ব্যবহার অনানুষ্ঠানিক এবং বন্ধুত্বপূর্ণ;
৪। তিনি একজন উত্তম শ্রোতা কিন্তু তিনি কোন রায় প্রদান করেন না; তিনি উপদেশ প্রদান করেন এবং সমস্যাদির ব্যাখ্যা দান করেন;
৫। গোষ্ঠী সদস্যবৃন্দ যা বলেন তৎপ্রতি তিনি জাগ্রত দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখেন।
এভাবে অনির্দেশিত নেতা তার অনুসারীদের উপর গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেন এবং তাদের উপরই সকল প্রকার সমস্যা সমাধানের ভার ন্যস্ত করে থাকেন। এতে গোষ্ঠী সদস্যগণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণের সুযোগ লাভ করে থাকেন।
পরিবেশগত নেতৃত্বের ধারণা (Situational of Leadership): নেতৃত্বের সনাতন ধারণা একে ব্যক্তিগত, একনায়কতান্ত্রিক, অগণতান্ত্রিক এবং একটি নিষ্ক্রিয় গোষ্ঠীর প্রতি ধাবিত করে। নেতৃত্বের এ ধারণা বর্তমান যুগে অচল এবং অগ্রহণযোগ্য বলে প্রমাণিত। সাম্প্রতিক ধারণার পরিবর্তে পরিবেশগত ধারণার (Situational Conception) প্রসার ও বিকাশ ঘটেছে। পরিবেশগত নেতৃত্বের ধারণা অনুসারে নেতৃত্বের অর্থ হচ্ছে বিভিন্ন পরিবেশে বিভিন্ন প্রকার নেতৃত্ব কাম্য। ফলে কোন বিশেষ ধরনের নেতৃত্ব সর্বক্ষেত্রে এবং সর্বাবস্থায় কার্যকর হতে পারে না। নেতৃত্বের প্রয়োজনীয় উপাদানসমূহ স্থান-কালভেদে বিভিন্ন প্রকার। ডিল (Stogdill) নেতৃত্বের এ বিশেষ দিকটির উপর গুরুত্ব আরোপ করতে গিয়ে লিখেছেন, “Campus political leaders have been found socially adaptable but intellectually mediocre, campus editors are bright and selfconfident, but illadjusted socially; while university debators were exceptionally intelligent, but very insecure.” এ উভয় ধরনের নেতাই বিভিন্ন পরিবেশে বিভিন্ন গুণাবলিসম্পন্ন নেতা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওহিও অঙ্গরাজ্যে অনুষ্ঠিত নেতৃত্বের গবেষণা চারটি মৌল উপাদানের সাহায্যে বিভিন্ন পরিবেশে বিভিন্ন নেতার কর্মতৎপরতাকে ব্যাখ্যা করেছে। এগুলো নিচে আলোচনা করা হলোঃ
১। নেতৃত্ব হচ্ছে একটি সংস্কৃতিগত ধারণাঃ এটি কোন নির্দিষ্ট সমাজ ও গোষ্ঠীর সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। স্বৈরাচারী একনায়কতান্ত্রিক নেতা কোন বিশেষ সাংস্কৃতিক পরিবেশে সুদক্ষভাবে নেতৃত্ব দান করতে পারেন। কিন্তু অন্য কোন পরিবেশে নেতৃত্বদানে তাকে বহুবিধ সমম্যার সম্মুখীন হতে হয়।
২। ব্যক্তির মধ্যকার পার্থক্যসমূহঃ ব্যক্তির মধ্যকার পার্থক্যসমূহও নেতৃত্বদানের ক্ষেত্রে পার্থক্য সৃষ্টি করে। নেতৃত্বের ক্ষেত্রে গবেষণা এ বিশেষ দিকটির উপরও যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে। সমাজে মূলত দুই শ্রেণীর ব্যক্তিবর্গ দেখা যায়— নেতা এবং অনুসারীগণ। অনুসারীগণের ধ্যান-ধারণা, বিশ্বাস, আশা-আকাঙ্ক্ষায় পার্থক্য নেতৃত্বের ক্ষেত্রে পার্থক্য সৃষ্টি করে। নেতৃত্বের ক্ষেত্রে এ সকল মনস্তাত্ত্বিক উপাদান কিছুতেই উপেক্ষণীয় নয়।
৩। কর্মসমূহের মধ্যকার পার্থক্যসমূহঃ কর্মসমূহের মধ্যকার পার্থক্যসমূহও নেতৃত্ব নিয়ন্ত্রণ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওহিও অঙ্গরাজ্যের গবেষণা হতে জানা যায় যে- (ক) যখন কোন ব্যক্তি এক পদ হতে অন্য পদে স্থানান্তরিত হন এবং তাকে একই ধরনের কর্ম সম্পাদন করতে হয় তখন তিনি পূর্বের ন্যায়ই কর্ম সম্পাদন করে থাকেন। (খ) যখন কর্মে পার্থক্য ঘটে তখন তিনি তার পূর্ববর্তী অধিকর্তাকেই অনুসরণ করেন।
৪। সংগঠনসমূহের মধ্যকার পার্থক্যসমূহঃ সংগঠনসমূহের মধ্যকার পার্থক্যসমূহও নেতৃত্বকে প্রভাবিত করে। অবশ্য নেতৃত্বের উপর সংগঠনের প্রভাব নির্ণয় করা দুরূহ। ফ্লিইসম্যান (Fleishman) সামরিক সংগঠন এবং শিল্প সংগঠনের মধ্যকার পার্থক্য নির্ণয় প্রসঙ্গে বলেন, উভয় প্রকার সংগঠনের মধ্যে নেতৃত্বের ক্ষেত্রেই অধিক পার্থক্য দেখা দেয়, সংগঠনের ক্ষেত্রে নয়। অন্যদিকে, স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে, নেতাগণ তাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও পরিবেশেই সাফল্যের সাথে কর্ম সম্পাদন করতে পারেন। উইলিয়াম ই. জেইনস (William E. Jaynes) লিখেছেন, “Variation in performances is closely related to the type of position which an officer occupies than to the types of organization in which his position is located.”
রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও আমলাতান্ত্রিক নেতৃত্ব (Political Leadership and Bureaucratic Leadership): রাজনীতি ও রাজনৈতিক প্রশাসন ব্যবস্থায় বা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে দেশের সর্বস্তরের জনগণের কমবেশি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সম্পৃক্ততা থাকে। কিন্তু আমলাতন্ত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী, তাই তার ক্রিয়াকলাপও রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ থেকে ভিন্নধর্মী। ম্যাক্স ওয়েবারসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আমলাতন্ত্রের যে বৈশিষ্ট্য প্রদান করেন, তাতে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, আমলাতন্ত্র একটা গণবিচ্ছিন্ন স্থায়ী সংগঠন এবং যার ক্রিয়াকলাপ লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকেই পরিচালিত হয়।
জনগণের নেতা হিসেবে রাজনীতিবিদগণের নেতৃত্ব ক্রমশ বিকশিত হয়। দীর্ঘ সময় রাজনীতি চর্চা ও অভিজ্ঞতা, গণসম্পৃক্ততা, গণযোগাযোগ, গণসমর্থন প্রভৃতির মাঝে ধীরে ধীরে নেতা জন্মলাভ করে। নেতা তৈরি হয় না। যেমন করে একজন আমলা প্রশাসক তৈরি হয়। আমলা, প্রশাসক, প্রশিক্ষণ ও কাজের দক্ষতার ভিত্তিতে স্থায়ী ক্ষমতার পদসোপানের সর্বোচ্চ পর্যায়ে আরোহণ করার সুযোগ পান।
যথার্থই কোন প্রকার প্রশিক্ষণ দ্বারা রাজনৈতিক নেতা সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। তার উদাহরণ রয়েছে বিশ্বজুড়ে। তবে সর্ববিষয়ের মত এখানেও ব্যতিক্রম আছে। সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে অবশেষে একজন অনভিজ্ঞ ব্যক্তি অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদে পরিণত হতে পারেন। তবে এ ক্ষেত্রে আমলার সাথে রাজনীতিবিদের মৌলিক পার্থক্য অবশ্যই রয়ে যায়।
এটা অনস্বীকার্য যে, একই রকম শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও পরিবেশ পেলেই সবাই গান্ধী, নেহেরু, চার্চিল, লিংকন, মাও সেতুং, বা ফজলুল হক হতে পারেন না। নেতৃত্বের গুণাবলি মানুষ জন্মগতভাবে লাভ করে এবং পরবর্তীতে অবস্থা ও পরিবেশের প্রভাবে তা বিকশিত হতে থাকে। তবে এটা ঠিক যে, প্রকৃত ও যথার্থ শিক্ষা, প্রশিক্ষণ অভিজ্ঞতা লাভের মাধ্যমেই নেতৃত্ব পরিপূর্ণরূপে বিকশিত হয়।
এখানেই রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাথে আমলাতান্ত্রিক নেতৃত্বের যথেষ্ট পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। আমলাতান্ত্রিক নেতৃত্বকে পরিপূর্ণরূপেই শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতার সমন্বিত রূপ হিসেবে উল্লেখ করা যায়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহে আমলাতান্ত্রিক নেতৃত্ব রাজনৈতিক নেতৃত্ব দ্বারাই পরিচালিত হয়। একজন রাজনীতিবিদের বিচরণক্ষেত্র দেশব্যাপী । কিন্তু একজন আমলার কর্মপরিসর সীমিত, সীমিত আমলাতান্ত্রিক সংগঠন। আমলাতান্ত্রিক সংগঠনসমূহের লক্ষ্য নির্ধারণ করেন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং তা বাস্তবায়ন করেন আমলাতান্ত্রিক নেতৃবৃন্দ।
যেমনঃ বিশ্বব্যাপী সর্বক্ষেত্রে বর্তমানে নিত্য নতুন আবিষ্কার ও কলাকৌশল উদ্ভাবন চলছে। এ নতুন নতুন উদ্ভাবন প্রশাসনিক কাজের জটিলতাও বৃদ্ধি করে চলছে ক্রমাগত । প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আমলাতন্ত্র এ বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তি বিধায় তিনি এ সম্পর্কে রাজনীবিদকে অবহিত করেন এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করেন। আমলাতান্ত্রিক নেতা জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হন না- কিন্তু রাজনৈতিক নেতা নির্বাচনের একমাত্র মাধ্যম জনগণ। জনগণের কাছে আমলাতন্ত্রের দায়বদ্ধতার যেমন বালাই নেই, তেমনি অপরদিকে রাজনৈতিক নেতা তার সকল ক্রিয়াকলাপের জন্য জনতার কাছে দায়ী থাকেন। আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনের নেতৃত্ব রাজনৈতিক নেতৃত্বের অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতায় বিকশিত হয়।
কিন্তু রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনকে আলাদা করে তাদের কাজের পরিমাপ ও মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। কারণ রাজনৈতিক প্রশাসন ও আমলাতান্ত্রিক প্রশাসন একে অপরের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত। বর্তমানের গণতান্ত্রিক শাসনের ভিত্তি হলো দল ব্যবস্থা। দেশের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব এক এক সময় একেক দলের উপর অর্পিত হয়- তাতে আমলাতন্ত্রের ক্রিয়াকলাপের ধরন বা ধারা পরিবর্তিত হয় না। ক্ষমতায় যে দলই আসুক না কেন, তারাই সরকারের কর্মপন্থা, নীতি ও সংগঠনের উদ্দেশ্য নিরূপণ করে দেবেন। অর্থাৎ এ সকল কার্য সম্পাদনের অধিকারী কেবল রাজনীতিবিদগণই— কিন্তু এগুলোর রূপায়ন ও বাস্তবায়নে সক্রিয় সাহায্য ও সমর্থন যোগান প্ৰশাসনিক কর্মকর্তাগণ। একজন আমলাপ্রশাসক নির্বাহী হিসেবে পরিচিত এবং তার আচরণের বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নির্লিপ্ত থাকা এবং নিরপেক্ষতা রক্ষা করা। বাংলাদেশের মত রাষ্ট্রে এমন ধারণা ঔপনিবেশিক আমল থেকে চলে আসছে। তবে বিগত এক দশকে বাংলাদেশে আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনের এরূপ ভূমিকার বিপুল পরিবর্তন লক্ষণীয়। বর্তমানে আমলাতন্ত্র যেমন আর গোপন আর নিরপেক্ষ চরিত্র বজায় রাখছে না— তেমনি রাষ্ট্রের বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তারা সক্রিয় রাজনীতিতেও অংশগ্রহণ করছে। অনেক আগে তথা পাকিস্তান আমল থেকেই এ অঞ্চলের আমলাতন্ত্র সামরিক বাহিনীর সমর্থন ও সহযোগিতায় রাজনীতির নেপথ্যে থেকে ‘ডমিনেন্ট রোল’ পালন করছিল। পাকিস্তানের প্রথম সামরিক সরকারের আমলে এ সামরিক বেসামরিক আমলাগণ নেপথ্য থেকে সরাসরি ক্ষমতা লাভ করে। তারাই রাজনৈতিক নেতৃত্বকে উপেক্ষা ও অবজ্ঞা করে রাজনৈতিক প্রশাসনে আধিপত্য বিস্তার অব্যাহত রাখে। বাংলাদেশ সৃষ্টির পূর্ব পর্যন্ত পাকিস্তানের রাজনীতিতে এরূপ পরিস্থিতিই চলে আসছিল।
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের প্রাথমিক রাজনৈতিক জীবনে এর ব্যতিক্রম ঘটতে পরিদৃষ্ট হলেও পরবর্তীতে সামরিক শাসনের উত্থানের ফলে প্রায় পাকিস্তানি স্টাইলে এখানেও সামরিক বেসামরিক আমলাতন্ত্রের আধিপত্য সুস্পষ্ট। রাজনীতিতে বেসামরিক আমলার আধিপত্যের যে কারণগুলো পাকিস্তানের রাজনীতিতে পরিলক্ষিত হত, বাংলাদেশেও তার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। অর্থাৎ প্রায় অজ্ঞ, অনভিজ্ঞ, অল্পশিক্ষিত রাজনীতিবিদগণ আধুনিক বিশ্বের বহুমুখী অগ্রগতি সম্পর্কে প্রায় কোন কিছুই জানেন না। ফলে উন্নয়নের বহুমুখী অগ্রগতি সম্পর্কে প্রায় কোন প্রকার ধারণাই তাদের থাকে না। ফলে উন্নয়ন প্রশাসনের জন্য রাজনীতিবিদগণ বিশেষজ্ঞ আমলাদের উপর নির্ভরশীল থাকেন। তাছাড়া আমলাদের মধ্যে ঔপনিবেশিক মানসিকতাও বিভিন্ন কারণে ক্রমশ দূরীভূত হচ্ছে।
বর্তমানে আমলারা হচ্ছেন, বিশেষ করে উন্নয়নগামী রাষ্ট্রে উন্নয়নের প্রবক্তা। সমাজের উন্নয়ন ও আধুনিককরণে এরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। তাছাড়া রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে, অথবা রাজনৈতিক প্রশাসনের অবর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে আমলাগণই একাধারে নীতিনির্ধারক ও নীতি বাস্তবায়নকারীর ভূমিকা পালন করে চলেছে।
সাধারণভাবে একজন স্থায়ী চাকরিজীবী আমলাকে সর্বাত্মকবাদী নেতা বলা যেতে পারে। কারণ তিনি রুটিন মাফিক নিয়মকানুন কঠোরভাবে অনুসরণ করেন এবং সমাজের প্রতি ক্ষেত্রে এমন বিধান বাধ্যতামূলকভাবে প্রয়োগ করেন। তারা নিয়োগ লাভের পূর্বে রাষ্ট্রের আইনকানুনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের যে শিক্ষা লাভ করেন, যেখান থেকে তারা কদাচিৎ বিচ্যুত হন। অনেক সময় যুক্তিহীন আইনকানুনের প্রতিও ভারা নিয়মমাফিক এমন গভীর আনুগত্য প্রদর্শন করেন যা মানব সমাজের কল্যাণ সাধন করে না উপরন্তু তাদের এক ধরনের জটিল ও (Static) নিশ্চল সামাজিক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটায়। তাদের কাছে মানবিক গুণাবলির মূল্য খুবই সামান্য। আমলাপ্রশাসকের মনে সাধারণত এরূপ ধারণা বদ্ধমূল থাকে যে, একজন নেতা হচ্ছেন ক্ষমতাবান ব্যক্তি। ফলে তিনি ঊর্ধ্বতনের প্রতি আনুগত্যপূর্ণ এবং অধস্তনের নিকট প্রভুত্বপূর্ণ আচরণ প্রদর্শন করেন। অনেক সময় আমলাগণ অধস্তনের প্রতি অমানবিক আচরণ করতেও কুণ্ঠিত হন না- বরং কারণে অকারণে একজন আমলা তার অধস্তনকে দোষী সাব্যস্ত করে তাদের প্রতি অবজ্ঞাসুলভ ও বৈরী মনোভাবও প্রদর্শন করেন। আমলাতন্ত্রের এরূপ আচরণ গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ পরিপন্থী । অথচ এমনটাই সচরাচর পরিদৃষ্ট হয়।
অধুনা বিশ্বব্যাপী রাজনীতি থেকে স্বৈরতান্ত্রিক বা একনায়কতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটেছে বলা যায়। বর্তমানে প্রশাসনিক আচরণ কোন একজন সর্বাত্মক শাসকের আচরণ নয়, বরং বর্তমানে প্রশাসনিক আচরণ সামগ্রিক বা গোষ্ঠী আচরণের পর্যায়ভুক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। নেতৃত্বের ধারণায় গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যই প্রধান স্থান অধিকার করে আছে। আমলাতন্ত্রের ন্যায় কঠোর নিয়মনীতি ও শৃঙ্খলাজনিত শাস্তির নামে বর্তমানে কোন ঊর্ধ্বতন ব্যক্তি অধস্তনকে তার পদানত রাখতে পারে না। এ প্রক্রিয়ায় কোন অধস্তনকে জোরপূর্বক বশ্যতা স্বীকার করানো গেলেও তার মেয়াদ হয় স্বল্পস্থায়ী তাকে দীর্ঘস্থায়ী করা সম্ভব হয় না।
এখন জনগণ নানা কারণে অধিকার সচেতন হয়ে উঠেছে। দরিদ্র ও অনগ্রসর দেশগুলোর জনগণও অগ্রসর বিশ্ব সম্পর্কে সেখানকার জনগণের চাওয়া পাওয়া ও আবিষ্কার সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন। কোন কিছুর দোহাই দিয়েই এ জনতাকে এখন তার শক্তি প্রয়োগ করে দীর্ঘদিন নিয়ন্ত্রণে প্রয়োগ রাখা যায় না। তাদের ভিতরে ক্ষোভ ও অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠতে উঠতে একসময় তারা প্রতিবাদ মুখর হয়ে গণআন্দোলন গড়ে তোলে। চরমকর্তৃত্বধারী শাসককে যুথবদ্ধ জনতার এভাবে ক্ষমতাহীন করার ইতিহাস পৃথিবীতে অনেক আছে।
প্রশাসনের ফলাফল শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সর্বদাই হতাশাব্যঞ্জক ও প্রতিক্রিয়াশীল হতে হয়। একমাত্র গতিশীল ও গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের মাধ্যমেই সকল প্রকার সংগঠনের মধ্যে প্রাণের স্পন্দন জাগানো সম্ভব। প্রতিটি স্তরের কর্মকর্তা কর্মচারীদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা, পারস্পরিক যোগাযোগ ও সমঝোতা এবং উৎসাহ-উদ্দীপনার মাধ্যমেই তাদের নৈতিক মনোবল ও কর্মস্পৃহা বৃদ্ধি করা সম্ভব।
গণতান্ত্রিক মতবাদ স্বৈরতান্ত্রিক সংগঠনে প্রয়োগ করা সম্ভব বা সংগত নয়। কেননা কর্মচারীকেন্দ্রিক প্রশাসন ব্যবস্থা প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। কঠোর নিয়ন্ত্রণহীন প্রশাসনে নানা মতের বিকাশ ঘটায় সেখানে দ্বন্দ্ব ও মতানৈকের সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এমতাবস্থায় একদিকে যেমন কর্মউদ্দীপনা কমে যায় তেমনি নৈতিক মনোবলেরও অবনতি ঘটে। এ পরিস্থিতির যাতে উদ্ভব না হয়, তার জন্য নেতৃত্বকে বাস্তবভিত্তিক হতে হবে। অভিজ্ঞগণ মনে করেন, প্রশাসনে গণতান্ত্রিকতা থাকবে ঠিকই, তবে অভিজ্ঞ ও দক্ষ ব্যক্তির মতামতকে অবশ্যই মূল্যায়ন করতে হবে। দীর্ঘকালের অভিজ্ঞতায় যিনি যোগ্য নেতৃত্ব অর্জন করেছেন, কর্মক্ষেত্রের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তসমূহ তিনিই গ্রহণ করবেন। তার প্রণীত সিদ্ধান্তের উপর বিভিন্ন জনের মতামত আহবান করা যেতে পারে-কিন্তু সকলে মিলে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটিয়ে কোন নীতি প্রণয়ন করা কখনোই বাস্তবভিত্তিক নয়। আবার নেতাকেও অবশ্যই তার অধস্তনদের সমস্যা অত্যন্ত সহানুভূতির সাথে শ্রবণ করতে হবে। তাতে উভয় পক্ষের আন্তরিকতা ও সহযোগিতার ভিত্তি মজবুত হয়।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায়, শুধুমাত্র কঠোরতা অথবা শিথিলতা কোনটাই গণতান্ত্রিক বা যোগ্য নেতার বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। সংবেদনশীল, সুসামঞ্জস্যপূর্ণ, কঠিন কোমল মানসিকতা ও সর্বোপরি প্রকৃত দেশপ্রেমের অধিকারী ব্যক্তিই একজন প্রকৃত গণতান্ত্রিক নেতা হতে পারেন।
Leave a comment