ভুতুমভগবান কাব্যগ্রন্থের নুন কবিতায় কবি জয় গােস্বামী চিরকাল-বঞ্চিত, অসহায়, অত্যাচারিত মানুষগুলির হয়ে সামান্য নুনের দাবি জানিয়েছেন সমগ্র সমাজের কাছে। সাধারণ ভাত-কাপড়ে, কোনােদিন মাত্রাছাড়া আবার কোনােদিন আধপেটা খেয়েই এদের দিন চলে যায় খুশিতে হেসেখেলে। অধিক কষ্ট ভুলে থাকতে মাঝে মাঝে বাপব্যাটায় এক হয়ে দুই বন্ধুর মতাে নেশা করে। শখ বা বিলাসিতার কোনাে অবকাশই নেই তাদের জীবনে। তবুও মাঝে মাঝে রাতদুপুরে বাড়ি ফিরে তারা যখন দেখে যে, তাদের শুকনাে ভাতে সামান্য নুনটুকুর ব্যবস্থাও নেই, তখনই প্রবল চিৎকারে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে তারা তাদের আর্তি প্রকাশ করে জানায়, আমাদের শুকনাে ভাতে লবণের ব্যবস্থা হােক। লক্ষণীয় এই কবিতায় কবি দুবার নুনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। একবার করেছেন অভাবের সূত্রে—“নুন নেই ঠাণ্ডা ভাতে, আর যখন দাবির কথা উঠেছে তখন ‘নুন-এর বদলে ব্যবহার করা হয়েছে লবণ শব্দটি। শ্রমজীবী দরিদ্র মানুষেরা যেহেতু তথাকথিত ভদ্র শাসক শ্রেণির কাছেই তাদের দাবি জানাচ্ছে, তাই দাবিপত্রের পােশাকি ভাষা মেনেই কবি ব্যবহার করেছেন ‘লবণ শব্দটি, যা মানুষের জীবনধারণের ন্যূনতম একটি উপাদান। তাই কবিতার নামকরণ যে যথার্থ হয়েছে, সে বিষয়ে কোনাে সন্দেহই নেই।
কবি জয় গােস্বামী তাঁর ভুতুমভগবান কাব্যগ্রন্থের নুন কবিতায় সমাজের শ্রমজীবী বঞ্চিত মানুষের জীবনযন্ত্রণা প্রকাশ করেছেন। অল্পেতেই খুশি হতে হবে জেনে এরা কঠোর পরিশ্রম করে সমাজের ভার বহন করে চলে। সাধারণ ভাত কাপড়েই এদের দিন চলে যায়। কোনাে শখ বা স্বপ্নবিলাসের স্থান নেই তাদের জীবনে।
মাঝে মাঝে দুঃখকষ্ট বা অভাব সহ্য করতে না পেরে সামাজিক সম্পর্কের বিন্যাস বদলে ফেলে বাপব্যাটা দু-ভাই মিলে মাঝে মাঝে গাঁজা বা নেশার বস্তুতে টান দেয় কিছুক্ষণের জন্য সবকিছু ভুলে থাকতে। আবার যেদিন একটু বেশি আয় হয়, সেদিন মাত্রাছাড়া বাজার করে ফেরে, সঙ্গে একটু শখ পূরণের জন্য কিনে আনে একটা গােলাপচারাও। কিন্তু স্থানাভাবের সংসারে সেটাকে কোথায় পোঁতা সম্ভব বা তাতে আদৌ ফুল হবে কি না, তা নিয়েও রয়ে যায় ঘাের অনিশ্চয়তা। আসলে গরিবের সমস্ত জীবনটাই দাঁড়িয়ে থাকে অনিশ্চয়তার ওপর। কিন্তু মাঝে মাঝে যখন সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করে বাড়ি ফিরে ঠান্ডা ভাতে সামান্য নুনের জোগানটুকু পায় না তারা, তখন রাগের মাথায় বাপব্যাটা মিলে সারাপাড়া মাথায় করে। আর তখনই দুঃখকষ্টের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া জীবনের বৃত্ত ভেঙে শােনা যায় সােচ্চার দাবি—শুকনাে ভাতের সঙ্গে কেবল লবণের প্রত্যাশা। এটুকু হলেই খেয়েপরে খুশিমনে হেসেখেলে তাদের দিন চলে যাবে।
গরিব, নিম্নবিত্ত শ্রেণির মুখপত্র হিসেবে কবি জয় গােস্বামী তাঁর রচিত ‘নুন কবিতায় শাসক তথা সমগ্র সমাজের কাছে এই দাবি জানিয়েছেন। কবি জানিয়েছেন বিলাপ করে লাভ নেই বলে গরিব মানুষেরা অল্পেতেই খুশি থাকার মন্ত্র শিখে নেয়। সাধারণ ভাত-কাপড়েই কোনােমতে তাদের দিন কেটে যায়। কঠোর খাটুনি খেটে তারা দু-বেলা অন্নবস্ত্রের প্রয়ােজন মেটায়। এদের কোনাে সঞ্চয় নেই, কোনাে শখ মেটানাের ক্ষমতা বা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেই। অসুখ হলে রােজগার বন্ধ থাকে বলে মহাজনের কাছ থেকে ধার করে কোনােক্রমে তারা সংসার চালায়। স্বল্প পরিসরে এরা নিজেদের প্রয়ােজন মেটায় এবং অতিকষ্টে দিন চালায়। কিন্তু প্রতিদিনের জীবনে এই সামান্য আয়ােজনটুকুও যখন তাদের জোটে না, তখনই তাদের মাথার ঠিক থাকে না। বাড়িতে অশান্তি করে, সারা পাড়ায় পৌঁছে দেয় তাদের ক্ষোভের আওয়াজ। এই চরম অভাব আর অসহায়তাই একসময় তাদেরকে উচ্চকণ্ঠ করে তােলে নিজেদের অধিকারের দাবির ঘােষণায়—“আমরা তাে সামান্য লােক/আমাদের শুকনাে ভাতে লবণের ব্যবস্থা হােক।” শাসক তথা সমগ্র সমাজের কাছে তাই এই গরিবদুঃখী মানুষের প্রতিনিধি কথকের একান্ত আবেদন, গরিব নিম্নবিত্ত মানুষদের প্রতিদিনের শুকনাে ভাতে অন্তত বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম প্রয়ােজনীয় লবণের ব্যবস্থাটুকু যেন করা হয়।
জয় গােস্বামী তার ‘নুন’ কবিতায় নিম্নবিত্ত মানুষদের জীবনযাত্রা এবং তাদের অসহনীয় দুঃখকষ্টের বর্ণনা দিয়েছেন। সেখানে দিন অতিবাহিত হয় অসুখে এবং ধারদেনাতে। কষ্টের মধ্যে কাটানাে জীবনেই থাকে খুশি খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা। বা বলা যেতে পারে, থেকে যায় খুশি খুঁজে নেওয়ার বাধ্যবাধকতা “আমরা তাে অল্পে খুশি, কী হবে দুঃখ করে?”- বোঝাই যায় যে দুঃখ করে কিছু লাভ নেই বলেই এই খুশি খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা। কিন্তু তাতে জীবনযাপনের যন্ত্রণাকে অস্বীকার করা যায় না। তাই তাকে ভুলে থাকার জন্য রাত্রে গঞ্জিকাতে টান দেওয়া চলে। অর্থাৎ নেশার ঘােরে ডুবে গিয়ে চলে বাস্তবকে ভুলে থাকার চেষ্টা। সাধারণ ভাতকাপড়ে কোনােরকমে কাটানাে এই জীবনে সুখস্বাচ্ছন্দ্যের কোনাে নিশ্চয়তা থাকে না। আর সে কারণেই সব দিন বাজার করাও তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না।
কোনােরকমে অতিবাহিত জীবনে নিয়মিত বাজারের কোনাে নিশ্চয়তা না থাকলেও যখন বাজার হয় তা হয়ে যায় মাত্রাছাড়া। নিম্নবিত্ত মানুষদের বেহিসেবি জীবনযাপনের প্রবণতাই এখানে স্পষ্ট হয়। এমনকি কোথায় পোঁতা হবে, তাতে ফুল হবে কি না—এসব না ভেবেই বাজার থেকে গােলাপচারাও কিনে আনে তারা।
জয় গােস্বামীর নুন কবিতায় নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনধারার প্রতীক হিসেবে কবিতার কথক চরিত্রটি বাড়িতে ফেরার পথে গােলাপচারা কিনে আনে। কিন্তু কোথায় সে চারা পোঁতা হবে বা তাতে ফুল হবে কি না— এসব প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসে। এইসব প্রশ্নকেই অনেক পরের কথা বলেছেন কবি।
নিম্নবিত্তের জীবনে অভাবের সঙ্গে অসুখের প্রতিদিনের বন্ধুত্ব। অনেক অপ্রাপ্তি আর হতাশা নিয়ে বেঁচে থাকার সেই জীবনে অল্পে খুশি’ হওয়াটাই নিয়তি। সাধারণ ভাতকাপড়ে অতিবাহিত সেই জীবনে মাঝে মাঝেই থাকে নেশার ঘােরে ডুবে থাকার আয়ােজন—“রাত্তিরে দু-ভাই মিলে টান দিই গঞ্জিকাতে।” এই অভাবের সংসারে প্রতিদিন বাজার হওয়াটাও সম্ভব নয়। কিন্তু নিম্নবিত্তের জীবনে যেহেতু কোনাে হিসাব কাজ করে না তাই যখন বাজার করা সম্ভব হয়, তা হয়ে যায় মাত্রাছাড়া। আর মনের গােপনে থেকে যায় জীবনের শৌখিনতাও। তাই সুযােগমতাে বাড়ি ফেরার সময় গােলাপচারাও কিনে আনা হয়। অদম্য শখের সামনে কঠিন বাস্তব গুরুত্ব পায় না। তাদের মনে থাকে না যে, গােলাপচারা লাগানাের মতাে সামান্য জায়গাও তাদের নেই। অথবা গােলাপচারায় ফুল ফোটানাের মত দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা বা ধৈর্যও তাদের নেই। জীবনযাপনে বেহিসেব এবং অসংযমই তাদের পরিকল্পনায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। অনেক পরের কথা বলে অপ্রিয় প্রশ্নগুলােকে সে দূরে সরিয়ে রাখে।
“হায় শৌখীন পুজারী”—‘শৌখীন পূজারী কে? তাকে ‘শৌখীন’ বলা হয়েছে কেন?
“জীবন-চুয়ানাে সেই ঘানি হতে” রূপকটির ব্যাখ্যা দাও।
“মুক্ত ভারতী ভারতে কই?” -ভারতী বলতে কাকে বােঝানাে হয়েছে? ভারতমাতার পরাধীনতার কথা কবি কীভাবে এই কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন?
“শান্তি-শুচিতে শুভ্র হল কি/রক্ত সোঁদাল খুন খারাব?” -‘রক্ত সোঁদাল খুন-খারাব’ বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন? এই রক্তাক্ত অধ্যায় কীভাবে সমাপ্ত হতে পারে বলে কবি মনে করেছেন?
“তবে তাই হােক।”—এক্ষেত্রে কবির অভীষ্ট কী?
“বাণীর কমল খাটিবে জেল।” -দ্বীপান্তরের বন্দিনী কবিতাটি অবলম্বনে মন্তব্যটির তাৎপর্য আলােচনা করাে।
নুন কবিতার মূল বক্তব্য সংক্ষেপে আলােচনা করাে।
নুন কবিতায় কবির যে জীবনবােধের প্রকাশ ঘটেছে তা উদ্ধৃতিযােগে আলােচনা করাে।
‘নুন’ কবিতার শিল্পসার্থকতা আলােচনা করাে।
“নিম্নবিত্তের নােনা চোখের জলের দিনলিপি নয়, জয় গােস্বামীর ‘নুন’ কবিতাটি শেষপর্যন্ত হয়ে উঠেছে লবণাক্ত সমুদ্রের গর্জন।” -ব্যাখ্যা করাে।
“চলে যায় দিন আমাদের অসুখে ধারদেনাতে” -এই চলে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে জীবনের কোন বিশেষ তাৎপর্যের দিকে কবি ইঙ্গিত করেছেন?
“মাঝে মাঝে চলেও না দিন” কবির এই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিত আলােচনা করাে।
“আমরা তাে এতেই খুশি; বলাে আর অধিক কে চায়?” -কবির এই মন্তব্যের মর্মার্থ আলােচনা করাে।
“সে অনেক পরের কথা। টান দিই গঞ্জিকাতে।” -মন্তব্যটির তাৎপর্য আলােচনা করাে।
“রাত্তিরে দু-ভাই মিলে টান দিই গঞ্জিকাতে/সব দিন হয় না বাজার; হলে হয় মাত্রাছাড়া” -উদ্ধৃতিটির মধ্য দিয়ে কোন জীবনসত্যের প্রকাশ ঘটেছে?
“কী হবে দুঃখ করে?কবির এই মন্তব্যের কারণ কী?
“করি তাে কার তাতে কী?” -মন্তব্যটির তাৎপর্য লেখাে।
“আমরা তাে অল্পে খুশি”—কোন্ প্রসঙ্গে বক্তা এ কথা বলেছেন? এই ‘অল্পে খুশি’ হওয়ার তাৎপর্য কী?
“আমরা তাে অল্পে খুশি” -বক্তা সত্যিই খুশি কি না আলােচনা করাে।
“বাড়িতে ফেরার পথে কিনে আনি গালাপচারা।” -অংশটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করাে।
“কিনে আনি গােলাপচারা” -গােলাপচারা কিনে আনলেও বক্তার জীবনচর্যার প্রকৃত স্বরূপ আলােচনা করাে।
“রাগ চড়ে মাথায় আমার, আমি তার মাথায় চড়ি” -রাগকে নিয়ন্ত্রণ না করে কবি তার মাথায় চড়ে কাকে কী বার্তা দিতে চান?
“আমি তার মাথায় চড়ি” -কে কার মাথায় চড়ে? পঙক্তিটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করাে।
“সে অনেক পরের কথা” -বক্তার কোন্ বিষয়কে কেন অনেক পরের কথা বলা হয়েছে?
“ফুল কি হবেই তাতে”—কোন্ ফুলের কথা এখানে বলা হয়েছে? এই সংশয়ের কারণ কী?
“মাঝে মাঝে চলেও না দিন”—দিন চলে না কেন? এর ফল কী হয়?
Leave a comment