প্রশ্নঃ নীতিবিদ্যার স্বরূপ আলােচনা কর। কলা হিসেবে নীতিবিদ্যা আলোচনা কর।

অথবা, নীতিবিদ্যার স্বরূপ ব্যাখ্যা কর। নীতিবিদ্যা কি কলা নাকি বিজ্ঞান?

ভূমিকাঃ মানুষ বুদ্ধিবৃত্তি সম্পন্ন জীব। বুদ্ধিবৃত্তি মানব প্রকৃতির এমন একটা অপরিহার্য গুণ, যা মানুষকে কেবল অন্যান্য মানবেতর জীব থেকে পৃথকই করে না। বরং মানুষকে অন্যান্য মানবেতর জীব থেকে উচ্চতর আসনে অধিষ্ঠিত করে। মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। তাই মানুষ মানব জীবন সম্পকে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে। আর মানব জীবন সম্পর্কীয় গভীর চিন্তা-ভাবনার, ফল হিসেবে জীববিদ্যা নৃ-তত্ত্ব, শরীর-তত্ত্ব, মনােবিদ্যা, সমাজবিদ্যা ইত্যাদির আলােচনা দেখা যায়। এসব বিদ্যা মানব ক্রিয়ার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলােচনা করলেও মানব ক্রিয়ার একটা পূর্ণাঙ্গ বিবরণ আমাদের দিতে পারেনি। কিন্তু ব্যক্তির আনুসাঙ্গিক ক্রিয়াবলির বিচার-বিবেচনার দিককেই নৈতিক বলা হয়। মানব ক্রিয়ার একটা পূর্ণাঙ্গ বিবরণ পাওয়ার জন্য ব্যক্তির এই নৈতিক আচরণের গুরুত্ব অপরিসীম। মানব জীবনের নৈতিক আচরণের এই আলােচনা হচ্ছে নীতিবিদ্যা। নিম্নে নীতিবিদ্যার স্বরূপ ও কলা হিসেবে নীতিবিদ্যা আলােচনা করা হলাে-

নীতিবিদ্যার স্বরূপঃ নীতিবিদ্যার অর্থ পর্যালােচনা করলে দেখা যায় যে, নীতিবিদ্যা হলাে নৈতিক ও নৈতিকতা সম্পর্কীয় সমস্যা এবং অবধারণ বিষয়ক এমন একটা দার্শনিক চিন্তন, যা নৈতিক সূত্র বিশ্বাস ও অনুশীলনের তাত্ত্বিক আলােচনা করে। এ তিন ধরনের চিন্তনের আলােচনার প্রেক্ষিতে নীতিবিদ্যার স্বরূপকে বুঝার চেষ্টা করাই শ্রেয় বলে মনে করা হয়। নিম্নে এ সম্পর্কে আলােচনা হলাে-

১. বস্তুনিষ্ঠ বিজ্ঞানঃ বস্তুনিষ্ঠ বিজ্ঞানে বস্তুর উৎপত্তি, বিকাশ ইত্যাদি সম্পর্কে সঠিক ধারণা দেয়া হয়। মনােবিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান, পদার্থ বিজ্ঞান প্রভৃতি বিজ্ঞানকে বস্তুনিষ্ঠ বিজ্ঞান বলা হয়। মনােবিজ্ঞানে বিভিন্ন মানসিক প্রক্রিয়াগুলােকে বিশ্লেষণ করা হয় এবং এদের সাধারণ নিয়মাবলি আবিষ্কার করা হয়।

২. আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞানঃ আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান একটা আদর্শের মাপকাঠিতে বিষয়বস্তুর মূল্য নির্ধারণ করে নীতিবিজ্ঞানকে আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান বলা হয়। কারণ এ বিজ্ঞান পরমার্থের আদর্শের মানদণ্ডে মানুষের আচরণের মূল্য নির্ধারণ করে।

৩. ঐতিহাসিক চিন্তনঃ ঐতিহাসিক এক ধরনের মূলক অভিজ্ঞতা ভিত্তিক অনুসন্ধান রয়েছে যা নৃতত্ত্ববিদ ঐতিহাসিক মনােবিদ এবং সমাজবিদেরা মনে করেন। এ ধরনের অনুসন্ধানের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে নৈতিকতা সম্পর্কীয় ঘটনার বর্ণনা ও ব্যাখ্যা দেওয়া। নীতিবিদ্যা মানব জীবনের আচরণ সম্পৰ্কীয় বিজ্ঞান। এ সংজ্ঞায় বিজ্ঞান শব্দটির উপর গুরুত্বারােপ করে অনেক বর্ণনামূলক অভিজ্ঞতা ভিত্তিক অনুসন্ধানের উপর বিশেষভাবে জোর দেন বলে নীতিবিদ্যাকে বর্ণনামূলক অভিজ্ঞতা ভিত্তিক বিজ্ঞানের মত গণ্য করে নীতিবিদ্যার স্বরূপকে বুঝার চেষ্টা করেন।

৪. মানদণ্ডের প্রেক্ষিতে আচরণের মূল্যায়নঃ নীতিবিদ্যার কাজ আচরণের বিচারমূলক আলােচনা ও মূল্যায়ন করা। নীতিবিদ্যা জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে আলােচনা করে। পরম উদ্দেশ্য হলাে সাধারণত জীবনের পরম কল্যাণ নামে পরিচিত। নীতিবিদ্যা জীবনের পরম লক্ষ্য নিয়ে অনুসন্ধান করে। আদর্শনিষ্ঠ নীতিবিদ্যার আলােচনাতে বিভিন্ন ধরনের আদর্শনিষ্ঠ অবধারণ। যেমন- তােমার কাজটি করা উচিত, কাউকে আঘাত করা অন্যায় ইত্যাদি গঠন করা হয় এবং এগুলাের যথার্থতা নিরূপণের জন্য যুক্তি উপস্থাপন করা হয়। তাদের মতে নীতিবিদ্যা বর্ণনামূলক। অভিজ্ঞতা ভিত্তিক বিজ্ঞান নয়। বরং আদর্শনিষ্ঠ বিজ্ঞান।

৫. বিশ্লেষণধর্মী চিন্তনঃ নীতিবিদ্যার আলােচনায় বিশ্লেষণধর্মী, বিচারধর্মী চিন্তন ও পরিলক্ষিত হয়। সক্রেটিস তার বন্ধু ক্ৰিটোর প্রস্তাব প্রত্যাখান করার উদ্দেশ্য যেসব আদর্শনিষ্ঠ অবধারণ। যেমন- কাউকে আমাদের আঘাত করা উচিত নয়। এ গুলাের যৌক্তিকতা প্রশ্ন উত্থাপন করলে তা পরানীতি বিদ্যা সংক্রান্ত প্রশ্ন হয়ে থাকে। প্রাচীন গ্রিক দর্শনে সক্রেটিস যদিও মৌলিক কথা তুলে ধরেন এবং তার আলােচনাতে বিশ্লেষণী চিন্তনের বীজ পরিলক্ষিত হয়।

কলা হিসেবে নীতিবিদ্যাঃ নীতিবিজ্ঞানকে যদি ব্যবহারিক বিজ্ঞান হিসেবে আমরা গণ্য করতে না পারি, তবে তাকে আমরা কলাবিদ্যা হিসেবে মনে করতে পারি না। নীতিবিজ্ঞান একটি তাত্ত্বিক বিজ্ঞান। পরম কল্যাণের আলােকে উচিত-অনুচিত নিরূপণ করে নীতি বিজ্ঞান। নৈতিক গুণাবলি শেখায় না নীতিবিজ্ঞান। কামনা-বাসনা, ইচ্ছা, সাধুতা নীতিবিজ্ঞান আমাদের শেখায় না। তাই নীতিবিজ্ঞানকে কলাবিদ্যা বলা যায় না বরং তা আদর্শিক বিজ্ঞান।

হান্ডসন বলেন, “কলা কোনাে কাজকে সম্পাদন করার উদ্দেশ্যে ব্যবহারিক দক্ষতা নিদের্শাবলির একটা বিদ্যা। কলা আমাদেরকে কোনাে কিছু করতে শিক্ষা দেয়।”

ম্যাকেঞ্জি বলেন, “আচরণ একটা কলা নয়। আচরণের সারসত্তা কোনাে ইচ্ছা বা সংকল্পের মনােভাবের উপর নির্ভর করে। কোনাে বিশেষ ধরনের দক্ষতা আয়ত্বের উপর নির্ভর করে না। যে ব্যক্তি ন্যায় বা ভালােভাবে কাজ করতে পারে, সে ব্যক্তি ভালাে না। বরং যে ব্যক্তি ভালােভাবে কাজ করে, সে ব্যক্তি ভালাে। আচরণ কোনাে ক্ষমতা নয়। বরং অভ্যাস।”

উইলিয়াম লিলি বলেন, “তিনি ভালাে আচরণ ও নিপুণ কলা সম্পর্কে যে তুলনামূলক আচরণ করেন, তা থেকে দেখা যায় যে, যেহেতু ভালাে আচরণ ও নিপুণ কলার মধ্যকার সাদৃশ্যের বিষয়গুলাে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ, সেহেতু ভালাে জীবন যাপনকে কলা বলে বর্ণনা করলে কোনাে ক্ষতি নেই। নীতিবিদ্যা যদিও নৈতিকতা সম্পৰ্কীয় একটা তাত্ত্বিক বিজ্ঞান। যার প্রধান কাজ হচ্ছে নৈতিক নিয়ম প্রদানের পরিবর্তে আদর্শ বা মানের প্রেক্ষিতে আচরণের স্বরূপ নির্ধারণ করা, তথাপি কলার দিকটির গুরুত্বকে একেবারে অস্বীকার করা যায় না। কেননা, ভালাে বীজ যাপনকে কলা বলে বর্ণনা করলে কোনাে ক্ষতি নেই। এ দিক থেকে নীতিবিদ্যাকে একটা তাত্ত্বিক বিজ্ঞান বলে আখ্যায়িত করা হলেও এর কলার দিকটির গুরুত্বকে একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না।”

ম্যাকেঞ্জি ও লিলির যুক্তির সমালােচনাঃ লিলির মতে- চিত্রকর যেমন দীর্ঘকালীন, যত্নশীল অনুশীলনের মাধ্যমে অঙ্কন শিক্ষা করে তেমনি যা উচিত তা করতে আমরা শিক্ষা করি। আমরা স্বীকার করতে পারি সৌন্দর্যের প্রকৃত সম্পর্কে উপলব্ধি যেমন চিত্রকরের অঙ্কন সহায়তা করে, তেমনি নৈতিক নীতিগুলাের উপলব্ধি ভাললাত্বের অনুশীলনে সহায়ক হবে। কিন্তু সৎ আচরণ এবং চিত্রাঙ্কন উভয় ক্ষেত্রেই তাত্ত্বিক আলােচনার তুলনার অনুশীলনই অধিকতর সাফল্য নিয়ে আসে।

১. সৎ আচরণ এবং চিত্রাঙ্কন উভয়ই ক্রিয়া। যা প্রত্যক্ষভাবে বাহ্য জড়জগতে পরিবর্তন সূচনা করে। উভয়ের লক্ষ্য ক্রিয়া জ্ঞান নয়।

২. চারুকলার নিজেরেই সৌন্দর্য আছে, যা মহৎ কার্য। আমাদের মনে সুন্দর চিত্র জাগরিত করে। লিলির মতে, “সৎ আচরণ ও চারুকলার মধ্যে কয়েকটি অসাদৃশ্য ও বর্তমান।”

ম্যাকেঞ্জির মতে, “নীতিবিজ্ঞান আমাদের আচরণ শেখায় না। সৌন্দর্য বিজ্ঞানের সম্পর্ক চারুকলা নিয়ে আর তর্কবিজ্ঞান সঠিক চিন্তা করা শেখায়। তাই বলা যায়- নীতিবিজ্ঞান ও আমাদের আচরণ কলার নীতিগুলাে শিক্ষা দেয়। তিনি বলেন- এরূপ সিদ্ধান্ত করার বিরুদ্ধে সর্বপ্রধান যুক্তি হত্যা, আচরণের সারবস্তু কোনাে বিশেষ ধরনের দক্ষতার অধিকারী হওয়া নয়। আচরণের সারবস্তু হলাে ইচ্ছার মনােভাব।”

ম্যাকেঞ্জি আরাে বলেন- কাজের সত্যতার অস্তিত্ব আছে। ভালাে ডাক্তার সঠিক রোগ নির্ণয় করে সঠিক চিকিৎসা বলতে পারেন। সৎ ব্যক্তি সঠিকভাবে কাজ সম্পাদন করেন এবং সৎ ব্যক্তি কাজ করেন। সত্যবাদী আবার সত্য কথা বলেন। তাই সত্যতা ক্রিয়ার ব্যাপার। তিনি বলেন কোনাে আচরণের কলাবিদ্যা স্বীকার করা যুক্তিসঙ্গ নয়।

উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, মানুষের একটি নৈতিক জীবন আছে। তাই মানুষ ভালােমন্দ, একটি নৈতিক জীবন আছে। তাই মানুষ ভালােমন্দ, সদা-সৎ, ন্যায়-অন্যায়, নীতি-দুর্নীতি, পাপ-পুণ্য বিশ্বাস করে। এসব নৈতিক ধারণা আমরা আমাদের সামাজিক পরিবেশ থেকে লাভ করি। ভালাে আচরণ ও নিপুণ কলার মধ্যে যে সাদৃশ্য রয়েছে তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। নীতিবিদ্যা যদিও তাত্ত্বিক বিজ্ঞান। তারপরও কলার দিকটির গুরুত্বকে একেবারে অস্বীকার করা যায় না। ভালাে জীবন যাপনকে যদি কলা বলা হয় তাহলে ক্ষতি নেই। আর এ দিক থেকে নীতিবিজ্ঞান যদিও তাত্ত্বিক বিজ্ঞান তবুও এর কলার দিকটির গুরুত্ব রয়েছে।