রাত্রির কূহকে কল্পিত আশঙ্কার উন্মত্ততায় বিকার ও ব্যাধিগ্রস্ত দক্ষিণাবাবুর সংক্ষিপ্ত জীবন কাহিনির একটা চমৎকার রূপ নির্মাণ দেখা যায় ‘নিশীথে’ গল্পের কাহিনি বিন্যাসে। যা প্রধানত রাত্রির কুহেলিকাময় অন্ধকারে প্রতি রাত্রির দুঃসহ অভিজ্ঞতার অনুষঙ্গে বিবৃত। ডাক্তারের কাছে বলা এ কাহিনি স্বতন্ত্র মাত্রা পায় যখন মধ্যরাত্রির আতঙ্কিত দক্ষিণাবাবু উপায়ন্তর না দেখে ডাক্তারের শরণাপন্ন হন। প্রতিদিন কার এই ভীতিকর শিহরণ সৃষ্টিকারী প্রথমা পত্নীর আকুল কণ্ঠস্বরে ক্রমেই দক্ষিণাবাবুর মানসিক অবস্থা বিপর্যয়ের সম্মুখীন। এর ঘটনা জানা যেন রাত্রির অন্ধকারে সমর্পিত। অতীত স্মৃতিচারণায় দক্ষিণাবাবু মৃত পত্নীর কাহিনি বর্ণনা করেছেন অতীত জীবনের প্রেক্ষাপটে। তাই সে জীবন সূর্যরশ্মিতে আলোকোজ্জ্বল হতে পারে না। উত্তর কালে মনোরমার সঙ্গে দাম্পত্য জীবন কাহিনি মূলত অতীতের অনুভাবনায় রচিত। সুখী দাম্পত্য জীবনের শুরুতেই মৃত প্রথমা পত্নীর সেই আর্ত জিজ্ঞাসা তাঁকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে, তাই মনোরমাকে পেয়েও সে সুখী হননি। ফলে এ গল্পে কোনওরূপে বাস্তব জীবনচর্চার স্বরূপ ফুটে ওঠেনি। তাই বোধহয় লেখক পরম কৌশলে রাত্রির পটভূমিকা রচনা করে নিশীথে গল্পের প্রাণ প্রতিষ্ঠা ঘটিয়েছেন। রাত্রির নৈশব্দময় অন্ধকারে মানুষের নানা অসঙ্গতি মনোবিকলন ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াই তো সার্বিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে।
‘নিশীথে গল্পের আক্ষরিক অর্থ হল রাত্রির গল্প। দিনের অবসানে রাত্রির অন্ধকারে আতঙ্ক ও আশঙ্ক আচ্ছন্ন ভয়াল পরিবেশে এ গল্পের নায়কের পদচারণা। ‘আমি’ রূপী ডাক্তারের কাছে মধ্যরাতে দক্ষিণাবাবুর আগমন ও অসুস্থতা নিরসন কল্পে আপন অতীত জীবন কাহিনি অন্ধকারময় ডাক্তারের গৃহকোণে, ম্লান কেরোসিনের আলোয় বর্ণিত হয়েছিল। এই অতীত স্মৃতিচারণ মূলত অন্ধকারের আবেষ্টনে আবৃত, এবং গল্পের আঙ্গিকে বিশেষ মুহূর্তের ব্যঞ্জনা রাত্রিকালীন আকাশে বেশ তাৎপর্য বাহী হয়ে উঠেছে। যেমন—বকুলতলায় প্রস্তর বেদিকায় ঘনগন্ধপূর্ণ ছায়ান্ধকারে প্রথমা পত্নীর মিষ্টি দক্ষিণাবাবুর মিথ্যা ভাষণ : ‘তোমার ভালোবাসা আমি কোনও কালে ভুলিব না।” এলাহাবাদে বৈকালিক বেড়াবার ছলে গভীররাতে তাঁর বাসায় প্রত্যাবর্তন অন্ধকারময় জীবনের ইঙ্গিত বহন করে আনে, তারপর একদিন সন্ধ্যাবেলায় মনোরমা প্রথমা স্ত্রীকে দেখতে এলে—চিররুমা প্রথমা পত্নীর দীর্ঘবিশ্বাস, অন্ধকার গৃহ ও সামান্য আলোয় দ্বার প্রান্তে ভেসে ওঠা মানুষের অস্পষ্ট ছবি, আশঙ্কা আতঙ্ককে নিবিড়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করলো জিজ্ঞাসার দ্বিরুচারিত সংলাপে। অতঃপর অন্ধকারের মধ্যে বিষযুক্ত মালিশের ঔষধ খেয়ে প্রথমা পত্নীর আত্মত্যাগ, এসকল ঘটনা ক্রমের বিন্যাস পদ্ধতি চমৎকার রূপে ফুটে উঠেছে কেবলমাত্র রাত্রির সান্নিধ্যে।
গল্পের কাহিনি সূত্র দুটি—এক, উত্তম পুরুষে বর্ষিত আমি রূপী ডাক্তার একটি পক্ষ, দুই, দক্ষিণবাবু তাঁর প্রথমা স্ত্রী এবং মনোরমা কেন্দ্রিক গল্পের একটি প্রধান জগৎ। প্রথম স্ত্রীকে বাদ দিলে মনোরমা ও দক্ষিণাবাবুর জীবন কাহিনি অতিসংক্ষিপ্ত। তবে তাঁদের প্রেমালাপের সহজ স্বাভাবিক সুর মূর্ত না হয়ে উঠলেও সন্ধ্যাকালীন মনোরম পরিবেশে একটা চমৎকার মাত্রা পেয়েছে। শরতের সন্ধ্যায় বরানগরের বাগানবাড়িতে বেড়ানোর দৃশ্যে ঘনীভূত অন্ধকার তারায় আচ্ছন্ন আকাশ, তরুতলের ঝিল্লি, ধ্বনি মানসিকভাব সৃজনে যথেষ্ট সহায়ক হয়ে উঠেছে। এই প্রেমময় পরিবেশে তীব্র অন্ধকার অনেকটা অপসৃত হয়ে কৃষ্ণপক্ষের জীর্ণপ্রান্ত হলুদবর্ণের রাঙা চাঁদের আবির্ভাব বড়োই মধুময়, দক্ষিণাবাবুর মনে পড়লো প্রথমা পত্নীকে বলা সেই প্রলাপের কথা—“তোমাকে আমি ভালোবাসি, তোমাকে কোনও কালে ভুলিতে পারিব না।”—এ তো আত্মপ্রবঞ্চনায় উদ্ভাসিত। প্রতিদিন দিনেরবেলায় মুক্তিগ্রাহ্য প্রসঙ্গের অবতারণায় মন আশ্বস্ত হলেও চারিদিকে ব্যপ্ত অন্ধকারে আচ্ছন্ন রাত্রিতে দক্ষিণাবাবুর আশঙ্কাময় আতঙ্ক ঘনীভূত হতে লাগলো। এছাড়া বরানগরের বাড়ি ছেড়ে গঙ্গা ও পদ্মায় দাম্পত্য জীবনে সূর্যাস্তের স্বর্ণচ্ছায়া মিলিয়ে নির্মল চন্দ্রালোকে উদ্ভাসিত হওয়া, কিন্তু নদীতটের নিস্তরঙ্গ বেলাভূমি থেকে গণ্ডির স্তরে উচ্চারিত প্রথমা পত্নীর আর্ত জিজ্ঞাসু সংলাপ দক্ষিণাবাবুকে আরও গাঢ়তর অন্ধকারে প্রোথিত করল।
গল্পের কথা শরীরেই ‘নিশীথে’র প্রাসঙ্গিকতা বিদ্যমান। প্রথম থেকেই রাত্রিকালীন প্রাকৃতিক প্রাঙ্গণে গল্পের ভাব ও কাহিনি বিমূর্ত হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে গল্পের শেষ পর্বের বর্ণনায় নিশীথকালীন পরিবেশ মানুষের মনকে কী প্রবলভাবে আবিষ্ট করতে পারে তার পরিচয় পাওয়া যায়। বোটে ঘুরতে থাকা শেষ পর্বে যে ধ্বনি দক্ষিণাবাবুর অন্তরকে আচ্ছন্ন করেছিল তা রাত্রির বিচিত্র অভিজ্ঞতা ভীতিসঙ্কুল জীবনকে স্পষ্ট করে তুলেছে। বিছানা শ্রান্ত শরীরে মনোরমা যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তখন সন্ধ্যাকালীন প্রথমা মৃতা পত্নীর ব্যাকুল জিজ্ঞাসা তাঁকে মনোবিকারে পরিণত করল—“রাত্রে বিছানায় আসিয়া শুইলাম… তখন অন্ধকারে কে একজন আমার মশারির কাছে দাঁড়াইয়া সুষুপ্ত মনোরমার দিকে একটিমাত্র দীর্ঘশীর্ণ অস্থিসার অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া যেন আমার কানে কানে অত্যন্ত চুপি চুপি অস্ফুট কণ্ঠে কেবলই জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল—ওকে, ওকে, ওকে গো ?” দেশলাই জ্বালাবার সঙ্গে সঙ্গে ছায়ামূর্তি মিলিয়ে গেল, আর ঘর্মাক্ত শরীরের রক্ত হিম করে দিয়ে সেই হাসি অন্ধকার রাত্রির ভিতর দিয়ে যেন কান্নার পার হয়ে লোক-লোকান্তরের পথে পাড়ি দিল, আলো নিভিয়ে শোবার পর আবার সেই অবরুদ্ধ স্বরের জিজ্ঞাসা ধ্বনিত হতে থাকল। স্পষ্টত দিবালোকে এই ভয়ংকর শিহরণকারী পরিবেশে সৃষ্টি সহায়ক হবে না।
গল্পের মূল ঘটনা বৃত্ত অন্ধকারের আবর্তে রচিত হয়েছে, এই ঘটনাকে ঠিক ভৌতিক পর্যায়ে মেলা সমীচিন হবে না। কারণ এতো মানুষের অবচেতন ‘মনের বিকারগ্রস্ত রূপের অভিব্যক্তি। যা প্রত্যক্ষ মানব জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। তবে অস্বীকার করার উপায় নেই, যে অজানা জগতের রহস্যময়তা আমাদের জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত হয়েই থাকে, তাকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না। যে বিশেষ অনুভূতিকে নিশীথে গল্পে গল্পকার প্রকাশ করতে চেয়েছেন রাত্রিকালীন আবেষ্টনে তার স্বরূপ বৈশিষ্ট্য যথাযোগ্য ভাবে বিন্যস্ত হবার অবকাশ পেয়েছে। গল্পের কথা শরীরে, তা সত্যই অভিনব, আমি রূপী ডাক্তারের কাছে দক্ষিণাবাবু তাঁর ভয়ার্ত অনুভূতির কথা রাত্রিতে ব্যক্ত করেছেন, সামান্য কেরোসিনের একটুখানি অস্পষ্ট আলোয় দক্ষিণাবাবুর মুখ থেকে তাঁর প্রথমা স্ত্রী, মনোরমা এবং রাত্রির কুহকে কাল্পনিক শঙ্কার কথা শোনা গেল। ঘটনা রাত্রিতে সংঘটিত হয়েছে এবং তাঁর বর্ণনাও রাত্রিকালীন পরিবেশে—তাই রাত্রির ব্যঞ্জনাকে গল্পের ভাবনায় গভীরভাবে মুদ্রিত দেখা যায়।
সুতরাং বলতে হয় এ গল্পের প্রায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে দিনের পরিবর্তে রাত্রির পটভূমিকাই মুখ্য। আবার সেই দিন রাত্রিতেই দক্ষিণাবাবু উত্তম পুরুষে বর্ণিত আমি রূপী ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়েছেন। এভাবে একটি রাতকে কেন্দ্র করে আসন্ন রাতের মধ্যে গল্পের প্রতিপাদ্য ব্যঞ্জনাকে ছড়িয়ে দিয়ে গল্পকার অসামান্য শিল্পকৃতির পরিচয় দিয়েছেন। শুধু তাই নয় পরিবেশ ও পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে রাত্রি মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হয়ে গল্পের অন্তিম লগ্নে সকল চরিত্রের জীবনে রাত্রির নির্জনতা নিসঙ্গতা অর্থাৎ দুঃখময়তা বিষাদময়তা নেমে এসেছিল, যা বড়োই করুণ। তাই সব দিক দিয়ে বিচার করে নিশীথে গল্পে রাত্রিকালীন অবচেতন মনের অপরাধ জনিত বিকারগ্রস্ততাকে বড়ো করে তুলে গল্পের নামকরণের সার্থকতা প্রতিপন্ন করা হয়েছে। কাহিনি, চরিত্র, ব্যঞ্জনা রাত্রির পটভূমিকায় তাৎপর্যপূর্ণ বলে গল্পের নামকরণ সার্থক ও সুপ্রযুক্ত হয়েছে বলে মনে হয়।
Leave a comment