Edgar Allan Poe রচিত ‘Leigia’ গল্পটির প্রভাব নিশীথে গল্পটির উপর পড়েছে বলে কেউ কেউ মনে করেছেন। ড. সুখময় মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, “এই গল্পটি পড়ে রবীন্দ্রনাথ তার মূলভাবটুকু নিয়ে খুঁটিনাটি বিষয়ে নিজের স্বাভাবিক প্রবণতা অনুযায়ী পরিবর্তন সাধন করে ‘নিশীথে’ গল্পটি রচনা করেছেন বলে মনে হয়।….পো এবং রবীন্দ্রনাথের স্রষ্টামানসের মূলধর্মের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে, তাই ‘নিশীথে’ ‘লিজিয়া’র মত রোমাঞ্চকর গল্প হয় নি, তার মধ্যে কবিকল্পনার ইন্দ্রজাল ও বর্ণাঢ্য ভাবঘন পরিবেশই প্রধান হয়ে উঠেছে।”
অধ্যাপক প্রতাপনারায়ণ বিশ্বাস রবীন্দ্রনাথের ‘নিশীথে’ এবং এডগার অ্যালান পো’র ‘লিজিয়া’ গল্প বিশ্লেষণ করে দু’টির মধ্যে আশ্চর্য মিল লক্ষ্য করেছেন এবং রবীন্দ্রনাথ কুম্ভিলক প্রবৃত্তির শিকার হয়েছেন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
‘নিশীথে’ গল্পের নায়ক দক্ষিণাচরণ গল্পের মূল কথক, যদিও গল্প শুরু করা হয়েছে একজন ডাক্তারের জবানীতে যার কাছে নায়ক মূল কাহিনীটি বলছেন। দক্ষিণাচরণের প্রথম স্ত্রী গৃহিণী হিসাবে ‘অতি দুর্লভ’, গম্ভীর শান্ত প্রকৃতির, স্বল্পভাষিণী। একটি মৃত সন্তান প্রসবের পর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন ; দক্ষিণাচরণ অসুস্থ স্ত্রীর সেবা করতে লাগলেন। দীর্ঘদিন রোগভোগের পর দু’জনেই বুঝলেন রোগ সারবার নয়। বায়ু পরিবর্তনের জন্য দক্ষিণাচরণ স্ত্রীকে এলাহাবাদে নিয়ে গেলেন। সেখানে হারাণ ডাক্তারের মেয়ের সঙ্গে দক্ষিণাচরণের ঘনিষ্ঠতা দেখে দক্ষিণাচরণের স্ত্রী একদিন বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করলেন যাতে দক্ষিণাচরণ ডাক্তারের মেয়ে মনোরমাকে বিয়ে করে সুখী হতে পারেন। দক্ষিণাচরণ মনোরমাকে বিয়ে করে তাঁর বরানগরের বাগান বাড়িতে নিয়ে এলেন, কিন্তু তাঁরা সুখী হতে পারলেন না। মনোরমার মনের মধ্যে কোথায় যেন একটা খটকা লেগেছিল। সে হাসত না, গম্ভীর হয়ে থাকত, দক্ষিণাচরণের প্রেমালাপের চেষ্টায় সাড়া দিত না। দক্ষিণাচরণ বরাবরই মদ্যপায়ী ছিলেন, তাঁর মদের নেশা আরো বেড়ে গেল। একদিন সন্ধ্যাবেলায় মনোরমাকে আদর করার চেষ্টা করতেই হঠাৎ কে যেন হেসে উঠল। তিনি মূর্ছিত হয়ে পড়ে গেলেন। পরে মনোরমা তাঁকে বোঝাল ওটা একঝাক হাঁসের পাখা নেড়ে উড়ে যাওয়ার শব্দ। আর একদিন পদ্মানদীর নির্জন তীরে মনোরমাকে চুম্বন করার সময়ে কে যেন বলে উঠল—‘ও কে, ও কে, ও কে।’ রাত্রে মশারির পাশ থেকে ঘুমন্ত মনোরমার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল—’ও কে, ও কে, ও কে গো।’ দক্ষিণাচরণ বিছানা থেকে উঠে আলো জ্বালতেই মশারি কাঁপিয়ে বোট দুলিয়ে সেই ছায়ামূর্তির বিকট হা হা হাসি অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
পো-র ‘Leigia’ গল্পের নায়কই কথক। ‘লিজিয়া’ নায়কের প্রথম স্ত্রী-রূপে, গুণে, বংশগৌরবে, পাণ্ডিত্যে অতুলনীয়, কিন্তু শাস্ত—’Outwardly calm, over placid’। নায়কের প্রতি লিজিয়ার গভীর ভালোবাসা, কিন্তু নায়ক মনে করে যে এই ভালোবাসা unworthily bestowed’। দক্ষিণাচরণ বলছেন—“তাঁহার সমস্ত প্রেম….আমার এই অযোগ্য প্রাণটাকে যেন বক্ষের শিশুর মতো দুই হস্তে ঝাপিয়া ঢাকিয়া রাখিয়াছিলেন।’ পো-র নায়কও বলছেন— Without Leigia I was but as child groping benighted’। লিজিয়া অসুস্থ হয়ে পড়ল এবং কিছুদিন পরে মারা গেল।
লিজিয়ার মৃত্যুর পরে নায়ক ইংল্যান্ডে একটি পুরনো abbey বা মঠ কিনলেন এবং সোনালী চুল, নীলনয়না বিয়ে করে সেখানে নিয়ে এলেন। কিন্তু এ বিয়ে সুখের হল না। Rowena নায়কের মধ্যে একটা তীব্র বিষণ্ণতা লক্ষ্য করে তাকে ভালোবাসতে পারল না, এড়িয়ে চলতে লাগল। ইতিমধ্যে নায়ক আফিমের নেশা ধরেছেন। কিছুদিনের মধ্যেই Rowena-র অসুস্থতা দেখা দিল; চারপাশে যেন কি সব অস্পষ্ট শব্দ, কে যেন চলে ফিরে বেড়াচ্ছে। নায়ক কিন্তু এসব শব্দ শুনতে পাচ্ছেন না। Rowena-র রাগ বাড়তেই লাগল। একদিন সে বলল — পর্দায় যেন কিসের ফিস্ ফিস্ শব্দ, যেন কেউ নিঃশ্বাস ফেলছে। নায়ক তাকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন এসব বাতাসের শব্দ। কিন্তু Rowena হঠাৎ মূৰ্চ্ছিত হয়ে পড়ল। নায়ক তাড়াতাড়ি ডাক্তারের পরামর্শ মত একটু মদ গেলাসে ঢেলে Rowena-র মুখের কাছে ধরলেন, যে নিজেই কিছুটা সামলে নিয়ে গ্লাসটা ধরল। কিন্তু যেই গ্লাসটা তুলে ঠোঁটে লাগাতে যাবে কোথা থেকে যেন উজ্জ্বল লাল রঙের তিন চারটে বড় বড় ফোঁটা গ্লাসের মধ্যে পড়ল। এই বিষাক্ত মদ খাওয়ার পরেই Rowena-র অবস্থা দ্রুত খারাপের দিকে গেল এবং কয়েকদিন পরে সে মারা গেল। নায়ক সারারাত Rowena-র মৃতদেহের পাশে বসে রইলেন এবং সমস্ত রাত ধরে দেখলেন Rowena-র শবদেহের মধ্যে লিজিয়ার বেঁচে ওঠার ব্যাকুল চেষ্টা—একবার করে মৃতদেহের মধ্যে প্রাণের স্পন্দন ও উত্তাপ ফিরে আসছে, পর মুহূর্তেই শরীর ঠাণ্ডা আর শক্ত হয়ে যাচ্ছে। রাত যখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে তখন Rowena-র মৃতদেহ বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে লিজিয়ার ঘন কালো চুলের রাশ আর কালো চোখের বন্যতা নিয়ে।
এডগার অ্যালান পো প্রায় একই বিষয় বা প্লট নিয়ে অনেক সময় একাধিক গল্প লিখতেন। প্রেম, মৃত্যু ও মৃত ব্যক্তির আবার প্রেমিকের কাছে ফিরে আসার এবং বেঁচে ওঠার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে পো তিনটি গল্প লিখেছিলেন—Leigia, Morella এবং Eleanora নিশীথে গল্পে রবীন্দ্রনাথ অন্য দুটি গল্পের উপাদানও নিজের গল্পে সন্নিবিষ্ট করেছেন। নিশীথে গল্পে স্ত্রীর শুশ্রুষা করার ব্যাপারে দক্ষিণাচরণের ক্লান্তির প্রসঙ্গটি ‘Leigia’ গল্পে নেই, আছে ‘Morella’-য়। অসুস্থ স্ত্রী যখন দক্ষিণাচরণকে আবার বিয়ে করতে বলেছিলেন তখন দক্ষিণাচরণ বেশ কাব্য করেই বলেছিলেন, ‘এ জীবনে আর কাহাকেও ভালোবাসিতে পারিব না। এ কথা ‘Leigia’ গল্পের নায়ক ‘Leigia’-কে বলেন নি বটে, কিন্তু ‘Eleanora’ গল্পের নায়ক ঠিক এই শপথই করেছেন Eleanora-র কাছে : ‘I would never find myself in marriage to any daughter of Earth-that I would in no manner prove recreant to her dear memory.’।
‘নিশীথে’ গল্পের মত পরাশ্রয়ী বা derivative গল্প রবীন্দ্রনাথ খুব কমই লিখেছেন। গল্পটি ‘Leigia-র এত ঘনিষ্ঠ এবং অক্ষম অনুকরণ যে পো-র গল্পের সঙ্গে তুলনায় মর্যাদা পাবারও অযোগ্য। ‘Leigia’ গল্পের তীক্ষ্ণ একাগ্রতা এবং তীব্রতা নিশীথে গল্পে আসে নি।” প্রতাপনারায়ণ বিশ্বাসের এই সমালোচনা যথেষ্ট যুক্তিবহ এবং খণ্ডন করা দুঃসাধ্য (রবীন্দ্রনাথের রহস্যগল্প ও অন্যান্য প্রবন্ধ : প্রতাপনারায়ণ বিশ্বাস)।
Leave a comment