প্রশ্নঃ নির্ভরশীলতা প্যারাডাইমের ঐতিহাসিক পটভূমি বর্ণনা কর।
অথবা, নির্ভরশীলতা প্যারাডাইমের ঐতিহাসিক পটভূমি আলোচনা কর।
ভূমিকাঃ আধুনিককালে কোনো রাষ্ট্রই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। টিকে থাকার প্রয়োজনে এক রাষ্ট্রকে অন্য রাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করে টিকে থাকতে হয়। বিশেষ করে প্রাচ্যের অনুন্নত রাষ্ট্রসমূহ পাশ্চাত্যের উন্নত রাষ্ট্রগুলোর ওপর অধিক হারে নির্ভরশীল। এ ধারণা থেকেই গড়ে ওঠেছে নির্ভরশীলতা প্যারাডাইম। এটি একটি নতুন তাত্ত্বিক মতবাদ গোষ্ঠী।
নির্ভরশীলতা প্যারাডাইমের প্রেক্ষাপটঃ নির্ভরশীলতা প্যারাডাইম মূলত ব্যাপকতা লাভ করে ষাটের দশকের পর থেকে। ষাটের দশকের আগে আধুনিকায়ন তত্ত্বে ব্যাপকতা ছিল। ফলে আধুনিকায়ন তত্ত্বের সমালোচনা শুরু হয়। এই সমালোচনা মূলত দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই গড়ে ওঠে নির্ভরশীলতা প্যারাডাইম যা এখন আধিপত্যশীল। কারণ, হেগেন, ফ্রাংক, এর মতে তাত্ত্বিকদের বিশ্লেষণমূলক আলোচনা থেকে নির্ভরশীলতা প্যারাডাইম গড়ে ওঠে।
গ্রিফিনের মতামতঃ গ্রিফিনের মতামত অনুযায়ী, অনুন্নত রাষ্ট্রগুলোর অনগ্রসরতার জন্য দায়ী মূলত ইউরোপ। কারণ ইউরোপিয়ানদের শোষণের কারণেই অনুন্নত রাষ্ট্রগুলো পিছিয়ে পড়েছে। সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক শাসনের কারণে পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্র এখনও অনুন্নত। অর্থাৎ ইউরোপীয় দেশগুলোর বিস্তারের কারণেই পৃথিবীতে অনুন্নত রাষ্ট্রগুলো তৈরি হয়েছে। অনুন্নত রাষ্ট্রগুলোকে শোষণ করে ধনী হয়েছে ইউরোপ।
ম্যাটস নাম এক মতবাদঃ ম্যাটস মাস-এর মতে, নির্ভরশীলতা শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বিচারযোগ্য নয়, একটি সমাজের মধ্যেও নির্ভরশীলতা থাকতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই আমরা দেখতে পাই, গ্রামাঞ্চল অপেক্ষা শহরাঞ্চল উন্নত। শহরে সবকিছু গড়ে ওঠে ও গ্রামাঞ্চল পিছিয়ে পড়ে। এভাবে সমাজের মধ্যে নির্ভরশীলতা পরিলক্ষিত হয়। গ্রামের মানুষ তাদের জীবন ও জীবিকার জন্য শহুরে লোকদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। শহর ক্রমান্বয়ে উন্নত হতে থাকে ও গ্রাম উন্নয়ন থেকে পিছিয়ে পড়ে।
রাউল প্রবিশ-এর মতবাদঃ নির্ভরশীলতা প্যারাডাইমের উৎপত্তিস্থল হলো রাউললো প্রবিশের রিপোর্ট। তিনি দেখান যে, বাণিজ্যের মাধ্যমে অনুন্নত দেশগুলো যে উন্নতি করেন তা না। কারণ অনুন্নত দেশগুলো সাধারণত কৃষিজ পণ্য রপ্তানি করে আর আমদানি করে শিল্পজাত পণ্য। ফলে অনুন্নত দেশগুলো আর নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। রাউল প্রবিশ দেখান যে, ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের ফলে আফ্রিকা ও এশিয়ার দেশগুলো পিছিয়ে নির্ভরশীলতা প্যারাডাইম বিকাশ লাভ করে।
ফ্রাংক-এর মতবাদ ফ্রাংক চিলির সমাজব্যবস্থার পর্যালোচনা করেন। তিনি বলেন যে, পুঁজিবাদের মাধ্যমে পৃথিবীর রাষ্ট্রসমূহ দু’ধরনের রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
(১) স্যাটেলাইট রাষ্ট্র;
(২) মেট্রোপলিটন রাষ্ট্র।
স্যাটেলাইট রাষ্ট্রসমূহ সাধারণত মেট্রোপলিটন রাষ্ট্র কর্তৃক শোষিত হয়। ফলে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে স্যাটেলাইট রাষ্ট্রসমূহ পিছিয়ে পড়ে ও মেট্রোপলিটন রাষ্ট্রসমূহের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। স্যাটেলাইট রাষ্ট্রসমূহ মূলত কৃষির স্যাটেলাইট রাষ্ট্রসমূহ মেট্রোপলিটন রাষ্ট্রসমূহের ওপর বিভিন্ন দিক দিয়ে নির্ভলশীল হয়ে পড়ে।
পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা পর্যালোচনা নির্ভরশীলতা তত্ত্ব অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। নির্ভরশীলতা প্যারাডাইম আলোচনায় আসার পর পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের পারস্পরিক অর্থনৈতিক সম্পর্কের বিভিন্ন দিক পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠছে। মেট্রোপলিটন ও স্যাটেলাইট রাষ্ট্রের যে ধারণা নির্ভরশীলতা প্যারাডাইম থেকে পাওয়া যায় তার বাস্তবতা আমরা বর্তমান পৃথিবীতে পাই। স্বাভাবিকভাবেই আমরা দেখতে পাই যে, এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি বিভিন্ন দিক দিয়ে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর ওপর নির্ভরশীল। এটাই নির্ভরশীলতা প্যারাডাইমের মূল বক্তব্য।
Leave a comment