প্রত্যক্ষ নির্বাচন

বর্তমানে গণতন্ত্র বলতে পরোক্ষ বা প্রতিনিধিমূলক গণতন্ত্রকে বোঝায়। এ ধরনের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রতিনিধি নির্বাচনের পদ্ধতিগত বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যাপারে দু’টি পদ্ধতি আছে। একটি হল প্রত্যক্ষ নির্বাচন পদ্ধতি এবং অন্যটি হল পরোক্ষ নির্বাচন পদ্ধতি। প্রত্যক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থায় ভোটদাতাগণ নিজেরাই সরাসরি নিজেদের প্রতিনিধিকে নির্বাচিত করেন। বর্তমানে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের আইনসভার নিম্নকক্ষের সদস্যগণ এই পদ্ধতিতেই জনগণের দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত হন। এ ধরনের নির্বাচন পদ্ধতি অত্যন্ত সহজ-সরল। এই পদ্ধতিতে নির্বাচকরা নির্দিষ্ট ভোটদানকেন্দ্রে এসে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে পছন্দমত একজনকে ভোট দেন। গণনায় সর্বাধিক সংখ্যক ভোটপ্রাপ্ত প্রার্থী নির্বাচিত হন। বর্তমানে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহে এই নির্বাচন পদ্ধতি অত্যন্ত জনপ্রিয়। ভারতে লোকসভা ও বিধানসভার সদস্য নির্বাচনে এই প্রত্যক্ষ নির্বাচন পদ্ধতি অনুসৃত হয়।

পরোক্ষ নির্বাচন

পরোক্ষ নির্বাচনে ভোটদাতাগণ প্রত্যক্ষভাবে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন না করে একটি মাধ্যমিক সংস্থা গঠন করে। সেই মাধ্যমিক সংস্থার নির্বাচিত সদস্যগণই চূড়ান্তভাবে প্রতিনিধি নির্বাচন করে। এই মাধ্যমিক সংস্থাটিকে সাধারণত নির্বাচক সংস্থা (Electoral College) বলা হয়। এ ধরনের নির্বাচন ব্যবস্থায় প্রতিনিধি নির্বাচনের চূড়ান্ত ক্ষমতা ভোটদাতাদের হাতে থাকে না; থাকে নির্বাচক সংস্থার সদস্যদের হাতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি এইভাবে নির্বাচিত হন। সেখানে কেবল রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচিত করার জন্য জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে একটি নির্বাচক সংস্থা গঠিত হয়। অনেক ক্ষেত্রে পৃথক নির্বাচক সংস্থা গঠন করা হয় না। আইনসভাই নির্বাচক সংস্থার দায়িত্ব পালন করে। ভারতের রাষ্ট্রপতি যে নির্বাচক সংস্থার দ্বারা নির্বাচিত হন তা গঠিত হয় সংসদের উভয় কক্ষের এবং রাজ্যের বিধানসভাসমূহের নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে।


প্রত্যক্ষ নির্বাচনের সুবিধা ও অসুবিধা

প্রত্যক্ষ নির্বাচনের সপক্ষে যুক্তি

(১) নির্বাচক ও নির্বাচিতদের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক: প্রত্যক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থার প্রধান গুণ হল এতে নির্বাচক ও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপিত হয়। তারফলে শাসক ও শাসিতের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি পায়। নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ জনসমর্থন লাভের আশায় জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও অভাব-অভিযোগের প্রতি নজর দেন এবং নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকেন। তাঁরা জনস্বার্থ বিরোধী কাজ করেন না। এইভাবে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।

(২) রাজনীতিক চেতনার বিস্তার: প্রত্যক্ষ নির্বাচন পদ্ধতি জনগণের রাজনীতিক চেতনা বৃদ্ধির সহায়ক। এ ধরনের নির্বাচন ব্যবস্থায় জনগণই সরাসরি ও সক্রিয়ভাবে প্রতিনিধি নির্বাচন করে। যথাযথভাবে প্রার্থী বাছাই করার জন্য জনগণকে সরকারী নীতি ও কাজকর্ম সম্পর্কে যথাসম্ভব ওয়াকিবহাল থাকতে হয়। তাছাড়া জনগণকে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনীতিক দলগুলির নীতি, আদর্শ ও কর্মসূচী বিচার-বিশ্লেষণ করতে হয় এবং সমকালীন সমস্যাদি ও তার সমাধান সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করতে হয়। তারফলে রাষ্ট্রনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের চেতনা ও আগ্রহ বৃদ্ধি পায়।

(৩) সরকারের স্থায়িত্ব: প্রত্যক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা জনগণকে রাজনীতিক ও শাসনসংক্রান্ত বিষয়ে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেয়। যে সরকার গঠিত হয় জনগণ তাকে নিজেদের সরকার বলেই মনে করে। জনগণের মধ্যে প্রবল উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। সরকার জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত সহানুভূতি ও সমর্থন লাভ করে। সরকারের সমস্যা ও সংকটে জনগণ সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করে। তারফলে সরকারের স্থায়িত্ব সুনিশ্চিত হয়।

(৪) দুর্নীতির আশংকা থাকে না: প্রত্যক্ষ নির্বাচনের পদ্ধতি দুর্নীতির আশংকা থেকে মুক্ত। এ ধরনের নির্বাচন ব্যবস্থায় বিপুল সংখ্যক নির্বাচককে অসৎ উপায়ে প্রভাবিত করা প্রায় অসম্ভব। এই কারণে দুর্নীতিমূলক প্রভাবের আশংকা বড় একটা থাকে না।

(৫) সুস্থ জনমতের সহায়ক: এ ধরনের নির্বাচন ব্যবস্থা জনমত গঠন ও প্রকাশের সহায়ক। রাজনীতিক দলগুলির কার্যকলাপ, নাগরিকদের প্রবল উৎসাহ-উদ্দীপনা এবং রাষ্ট্রনৈতিক বিষয়ে প্রচার ও আলাপ আলোচনার ফলে সুস্থ জনমত গঠিত ও প্রকাশিত হতে পারে।

প্রত্যক্ষ নির্বাচনের বিপক্ষে যুক্তি

(১) অযোগ্য ব্যক্তি নির্বাচিত হন: ভোটদাতাদের অধিকাংশ অশিক্ষিত ও অযোগ্য হলে, যোগ্য প্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা লোপ পায়। ফলে অযোগ্য ব্যক্তির দুর্বল প্রশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। বাস্তবে এই ঘটনাই ঘটে। কারণ জনসাধারণের অধিকাংশই অজ্ঞ, অশিক্ষিত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন। তারফলে আইনসভায় অযোগ্য প্রার্থীদের নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। 

(২) নৈতিক অধঃপতন: অনেক সময় অসৎ ও চতুর ব্যক্তিরা আবেগময়ী বক্তৃতা ও ছলাকলার মাধ্যমে জনমন জয় করে নির্বাচিত হন। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা পারস্পরিক কুৎসা রটনা এবং অন্যান্য অসদুপায় অবলম্বনে দ্বিধা করেন না। তারফলে প্রশাসনের নৈতিক মান অবনমিত হয়।

(৩) সৎব্যক্তিগণ এড়িয়ে চলেন: জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিরা প্রত্যক্ষ নির্বাচনের বিড়ম্বনার মধ্যে জড়িয়ে পড়তে রাজী হন না। প্রত্যক্ষ নির্বাচনের উত্তেজনা এবং দলীয় কার্যকলাপের তিক্ততা সৎ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এড়িয়ে চলেন। অতি সাধারণ বা নিম্নমানের ব্যক্তিরাই এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তাই জনসাধারণ যোগ্য বা বিজ্ঞ ব্যক্তির সেবা থেকে বঞ্চিত হয়।

(৪) ব্যয়বহুল: এ রকম নির্বাচনব্যবস্থা ব্যয়বহুলও বটে। এ ধরনের নির্বাচন পরিচালনার জন্য সরকারী ও বেসরকারী উভয় ক্ষেত্রেই বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়িত হয়। বিপুল সংখ্যক নির্বাচকের নির্বাচন পরিচালনার জন্য সরকারী তহবিলের উপর বেশ চাপ পড়ে। তা ছাড়া নির্বাচনী প্রচারের ব্যাপারেও রাজনীতিক দলগুলি এবং প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা মোটা টাকা খরচ করেন। এই খরচের অনেকটাই অপব্যয়। সংক্ষেপে এ ধরনের নির্বাচন ব্যবস্থায় সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ত্রুটিগুলি পরিলক্ষিত হয়।


পরোক্ষ নির্বাচনের সুবিধা ও অসুবিধা

পরোক্ষ নির্বাচনের সপক্ষে যুক্তি

(১) যোগ্য প্রার্থীর নির্বাচন: পরোক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থায় যোগ্য প্রার্থীর নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশী। কারণ এই ব্যবস্থায় জনসাধারণের হাতে নির্বাচনের চূড়ান্ত দায়িত্ব ন্যস্ত থাকে না। এই দায়িত্ব ন্যস্ত থাকে নির্বাচক সংস্থা (Electoral College) বা জনপ্রতিনিধিদের হাতে। এই মধ্যবর্তী নির্বাচক সংস্থার স্বল্পসংখ্যক যোগ্য ও বিজ্ঞ ব্যক্তিগণ চূড়ান্ত পর্যায়ে উপযুক্ত প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারেন। 

(২) দুর্নীতি, উত্তেজনা থেকে মুক্ত: পরোক্ষ নির্বাচনে দুর্নীতি, উত্তেজনা প্রভৃতির আশংকা বড় একটা থাকে না। এই নির্বাচন ব্যবস্থায় দুই স্তরে নির্বাচন হয়। প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হন চূড়ান্ত পর্যায়ে। এই চূড়ান্ত পর্যায়ের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন জনপ্রতিনিধিরা। তখন দলীয় প্রচার, দুর্নীতি, উত্তেজনা প্রভৃতি থাকে না। উচ্ছ্বাস, আবেগ, ভাবপ্রবণতা প্রভৃতি এই পর্যায়ের নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারে না। 

(৩) ব্যয়সংক্ষেপ ঘটে: পরোক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থা অপচয়মূলক নয়। প্রতিনিধি নির্বাচিত হয় চূড়ান্ত পর্যায়ে। তখন যাঁরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন তাঁরা অপেক্ষাকৃত বুদ্ধিমান ও শিক্ষিত। তাঁদের সংখ্যাও কম। তাই তখন অহেতুক অর্থ ব্যয় হয় না। তাই দাবি করা হয় যে পরোক্ষ নির্বাচনে ব্যয়সংক্ষেপ ঘটে। 

(৪) তা ছাড়া দলপ্রথার ত্রুটি-বিচ্যুতি পরোক্ষ নির্বাচন থেকে মুক্ত।

(৫) সর্বোপরি পরোক্ষ নির্বাচন পদ্ধতি সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে মুক্ত।

পরোক্ষ নির্বাচনের বিপক্ষে যুক্তি

(১) অগণতান্ত্রিক: পরোক্ষ নির্বাচন অগণতান্ত্রিক। সরাসরি প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে নাগরিকদের ক্ষমতা থাকে না বলে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার অর্থহীন হয়ে পড়ে। তা ছাড়া নির্বাচক সংস্থার সদস্যরা জনগণের পছন্দমত প্রতিনিধি নির্বাচিত করবেন এমন কোন নিশ্চয়তা নেই। 

(২) রাজনীতিক শিক্ষার বিস্তার ঘটে না: জনগণ এবং প্রতিনিধির মধ্যে নির্বাচন সংস্থার ব্যবধান থাকে বলে রাষ্ট্রনৈতিক ব্যাপারে জনগণ নিরুৎসাহ হয়ে পড়ে। সেইজন্য এই ব্যবস্থা রাষ্ট্রনৈতিক শিক্ষা ও চেতনা বৃদ্ধির পরিপন্থী। প্রত্যক্ষ নির্বাচনের ক্ষেত্রে জনগণের মধ্যে যে উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা যায়, পরোক্ষ নির্বাচনে তা থাকে না। পরোক্ষ নির্বাচনের ব্যাপারে জনগণের আগ্রহ ও উৎসাহের অভাব দেখা যায়। তার ফলে জনগণের রাজনীতিক শিক্ষা ও চেতনার বিকাশ ঘটে না।

(৩) স্বৈরাচারী সরকার: পরোক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থায় শাসক ও শাসিতের মধ্যে সহযোগিতা বা পারস্পরিক নির্ভরশীলতার সৃষ্টি হয় না। এতে শাসকের দায়িত্বশীলতা হ্রাস পায়; স্বৈরাচারের পথ প্রশস্ত হয়।

(৪) দলপ্রথার ত্রুটি: মধ্যবর্তী পর্যায়ের নির্বাচক সংস্থার সদস্যগণ চূড়ান্তভাবে প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে কার্যত দলীয় নেতৃত্বের দ্বারা পরিচালিত হন। ফলে দলপ্রথার ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়।

(৫) নির্বাচক সংস্থা বাহুল্য মাত্র: প্রাথমিক পর্যায়ে নির্বাচক সংস্থার সদস্য নির্বাচনের সময় নাগরিকগণচূড়ান্ত প্রতিনিধির কথা বিবেচনা করেই ভোট দেন। নির্বাচক সংস্থার সদস্যগণও ভোটদাতাদের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতিমত প্রতিনিধি নির্বাচন করেন। সুতরাং মধ্যবর্তী একটি নির্বাচক সংস্থা অনাবশ্যক এবং ব্যয় বাহুল্যমাত্র।

(৬) অযৌক্তিক: নাগরিকগণ প্রাথমিকভাবে নির্বাচক সংস্থায় যোগ্য সদস্য নির্বাচিত করতে পারলে, চূড়ান্তভাবে উপযুক্ত প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারবেন, এ ধারণা অযৌক্তিক।

(৭) দুর্নীতির আশঙ্কা: পরোক্ষ নির্বাচনে ব্যাপক দুর্নীতির আশঙ্কা থাকে। নির্বাচক সংস্থার স্বল্প সংখ্যক সদস্যদের উৎকোচের দ্বারা প্রলুব্ধ করে বা ভয় দেখিয়ে নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে দলগুলি চেষ্টা করতে পারে। তা ছাড়া দলগুলি অন্যান্য দুর্নীতিমূলক উপায় অবলম্বন করতেও দ্বিধা বোধ করেন না। দলীয় বা ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য নানাভাবে অর্থব্যয় করা হতে পারে।