অ্যালান বল তাঁর Modern Politics and Government শীর্ষক গ্রন্থে নির্বাচনের কার্যাবলী সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। বলকে অনুসরণ করে নির্বাচনের কার্যাবলীকে ব্যাখ্যা করা যায়। আধুনিককালের রাজনীতিক ব্যবস্থায় নির্বাচনের কার্যাবলী বহু ও বিভিন্ন। নির্বাচনের এই সমস্ত কার্যাবলীকে নিম্নলিখিতভাবে বিন্যস্ত করা যায়।

(১) প্রতিনিধি বাছাই ও সরকারকে নিয়ন্ত্রণ: গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা হল বর্তমান বিশ্বের সর্বাধিক প্রচলিত শাসনব্যবস্থা। এখন অধিকাংশ দেশেই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রচলন পরিলক্ষিত হয়। আধুনিককালের এই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা হল প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র। এ হল পরোক্ষ গণতন্ত্র। এই ধরনের গণতন্ত্রের অন্যতম অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা। প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় নির্বাচনের ভূমিকা অপরিহার্য এবং বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনের মাধ্যমেই এখানকার এই শাসনব্যবস্থার নিরবচ্ছিন্নতা ও স্থায়িত্ব বজায় থাকে। প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচকদের পছন্দমাফিক প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার ও ক্ষমতা তত্ত্বগতভাবে স্বীকৃত ও সংরক্ষিত। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এই অধিকারের সার্থক প্রয়োগ বিভিন্ন শর্তের উপর নির্ভরশীল। পরোক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচকমণ্ডলীর কাছে তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দায়িত্বশীলতা এবং সরকারের উপর জনগণের চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত নীতি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এবং এক্ষেত্রে নির্বাচনের অবিসংবাদিত ভূমিকা সর্বজনবিদিত। এ বিষয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই। এ প্রসঙ্গে বল বলেছেন: “elections are the means by which the people choose and exercise some degree of control over their representatives.” নির্বাচন নির্বাচকদের পছন্দমত প্রতিনিধি বাছাই করার সুযোগ প্রদান করে। আবার বিগত নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের উপর নির্বাচক-মণ্ডলীর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার ক্ষেত্রে নির্বাচন হল একটি উপযুক্ত উপায়। এ বিষয়ে গণভোটের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে বলের অভিমত প্রণিধানযোগ্য। তিনি মন্তব্য করেছেন: “referenda on particular issues could give the electorate a more direct influence over the policies of their representatives. it cannot be claimed that the loss of referendum weakens governments.”

(২) প্রতিনিধিদের নিয়ন্ত্রণ: তত্ত্বগতভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের উপর নির্বাচকমণ্ডলীর নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়। কিন্তু বাস্তবে এই নিয়ন্ত্রণ বড় একটা কার্যকরী হয় না। নির্বাচিত হওয়ার পরেও প্রতিনিধিরা প্রদত্ত প্ৰতিশ্ৰুতি মত নীতি নির্ধারণ, আইন প্রণয়ন এবং তা প্রয়োগ করবেন, সে বিষয়ে কোন নিশ্চয়তা থাকে না। সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলকে প্রাক্‌-নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনেক সময় লঙ্ঘন করতে দেখা যায়। দ্বি-দল ব্যবস্থায় দুটি দলের মধ্যে রাজনীতিক পছন্দ সীমাবদ্ধ থাকে। বেশী বিকল্প থাকে না। এই অবস্থায় নিয়ন্ত্রণ কার্যকর করার জন্য পছন্দ প্রয়োগের সুযোগও বেশী থাকে না। তারফলে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের উপর অভিপ্রেত নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা ভোটদাতাদের পক্ষে অনেক সময় অসম্ভব হয়ে পড়ে। আবার বহু-দল-ব্যবস্থায় নির্বাচনোত্তর পর্যায়ে নির্বাচকমণ্ডলীর মতামত বা ইচ্ছাকে উপেক্ষা করে কোন কোন দল কোয়ালিশন সরকার গড়ে তোলে। বল বলেছেন: “Elections do not imply control over the policies the representatives will support once they are elected; even in two-party systems in which the elector chooses between two competing teams, this control is difficult, and multi-party systems that demand bargaining at parliamentary level to establish some form of coalition government, the election promises of the parties are likely to fall further into the background.”

(৩) রাজনীতিক সংযোগ সাধন: রাজনীতিক ক্ষেত্রে সংযোগ সাধনের ব্যাপারে নির্বাচন এক সক্রিয় বাহন হিসাবে কাজ করে। নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরকার এবং বিভিন্ন রাজনীতিক দলের সঙ্গে দেশবাসীর রাজনীতিক সংযোগ সাধনের এক ব্যাপক সুযোগের সৃষ্টি হয়। অন্য কোন রকম রাজনীতিক প্রক্রিয়া সূত্রে এই সুযোগ পাওয়া যায় না। সরকার নির্বাচনের সময় নাগরিকদের দাবি-দাওয়া ও অভাব-অভিযোগের প্রতি বিশেষভাবে মনোনিবেশ করে। এই সময় সরকারী নীতি ও কর্মসূচী সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করার ব্যাপারে সরকার সর্বতোভাবে উদ্যোগী হয়। নির্বাচনের প্রাক্কালে রাজনীতিক দলগুলিও তাদের নিজেদের কর্মসূচী ও কার্যপদ্ধতির দ্বারা জনগণকে প্রভাবিত করতে সক্রিয়ভাবে সচেষ্ট হয়। বল বলেছেন: “Elections in any political system are a form of political communication between governments and the governed means by which political decision-makers become sensitive to the electorate’s political demands, and in turn in a position to, ‘educate’ the electorate on important political issues.”

(৪) রাজনীতিক বিষয়ে অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি: রাজনীতিক বিষয়ে অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টির ব্যাপারে নির্বাচনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বলের অভিমত অনুসারে যে-কোন রাজনীতিক ব্যবস্থায় অধিকাংশ নাগরিকের রাজনীতিক কাজকর্মে অংশগ্রহণ করার একমাত্র উপায় হল এই নির্বাচন। এই নির্বাচন ব্যবস্থায় অংশগ্রহণের মাধ্যমেই ভোটদাতাদের মধ্যে এক পারস্পরিক চেতনার সৃষ্টি হয়। তা ছাড়া নির্বাচন প্রক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচকমণ্ডলীর মধ্যে সরকারী সিদ্ধান্তের জন্য এক ধরনের দায়বদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া নির্বাচন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বিভিন্ন রাজনীতিক কার্যকলাপের পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচকদের রাজনীতিক বৃদ্ধি পায় এবং বিচার-বুদ্ধির পরিপুষ্টি সাধিত হয়। বস্তুত এই সমস্ত ক্ষেত্রে নির্বাচনের প্রত্যক্ষভাবে সহায়ক এবং ইতিবাচক ভূমিকার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। বল বলেছেন: “Elections do provide for a bare minimum of political participation, perhaps the only act of participation for the vast majority of the government, and therefore create a feeling of belonging and a degree of responsibility for government decisions.” জনসাধারণের রাজনীতিক চেতনা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে নির্বাচনী রাজনীতিক প্রভাব-প্রতিক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ।

(৫) রাজনীতিক ব্যবস্থার বৈধকরণ: রাজনীতিক ব্যবস্থার বৈধতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়-পদ্ধতি হিসাবে বিবেচিত হয়। শাসক ও শাসন-পদ্ধতির বৈধকরণের ব্যাপারে নির্বাচন সহায়ক ভূমিকা পালন করে। সকল রাজনীতিক ব্যবস্থাতেই এ কথা সাধারণভাবে সত্য। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় নির্বাচনের মাধ্যমে বৈধ শাসক ও শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। আবার বৈপ্লবিক সরকার বা সামরিক একনায়কতন্ত্রও নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের শাসনের বৈধতা প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারে উদ্যোগী হন। নির্বাচনের মাধ্যমে বিদ্যমান রাজনীতিক ব্যবস্থা ও সরকারের প্রতি জনগণের সমর্থন ও আনুগত্য প্রকাশিত হয়। আবার নির্বাচন ব্যবস্থার মাধ্যমেই রাজনীতিক সংস্কৃতির তারতম্য যাচাই করা যায়। বল বলেছেন: “Elections are primarily a means of legitimising the right of the rulers to govern.”

(৬) সাধারণত বিশেষ কোন নীতি বা সমস্যাকে কেন্দ্র করে এখন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় না। অর্থাৎ অধিকাংশ নির্বাচনেই নির্বাচকমণ্ডলীকে বহু ও বিভিন্ন বিষয় ও সমস্যা সম্পর্কে বিচার-বিবেচনা করতে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। বল বলেছেন: “elections are rarely fought over one issue or even a precise group of issues. In Britain it is difficult to list the number of general elections that have been fought over one issue…..” এই কারণের জন্য নির্বাচকমণ্ডলীর পক্ষে বিশেষ কোন নীতির ভিত্তিতে বা সম্পূর্ণ সচেতনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করা সম্ভব হয় না।

(৭) সাম্প্রতিককালের নির্বাচনে নির্বাচকমণ্ডলীর নিয়ন্ত্রণ কতকাংশে হ্রাস পেয়েছে। এর পিছনে নানা কারণ বর্তমান। তবে এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল বর্তমানে দলীয় ব্যবস্থার ক্রমবর্ধমান প্রভাব প্রতিপত্তি। নির্বাচন ব্যবস্থাকে বর্তমানে রাজনীতিক দলের মতাদর্শ, প্রভাব-প্রতিপত্তি ও সদস্যসংখ্যা প্রসারের উপায় বা মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করা হয়ে থাকে। নির্বাচনে প্রার্থী মনোনীত করে রাজনীতিক দল। দলই দলীয় প্রার্থীদের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারকার্যের ব্যবস্থা করে। নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের ব্যাপারে নির্বাচক মণ্ডলীর কোন হাত থাকে না। এখন ভোটদাতারা দলের মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে বা বিপক্ষে কেবলমাত্র ভোট দিতে পারেন।

(৮) নির্বাচন পদ্ধতির মাধ্যমে জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছা অনেক সময় সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয় না। তা ছাড়া নির্বাচনী দুর্নীতি এ ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা হিসাবে প্রতিপন্ন হয়। বল ম্যাকেঞ্জীকে অনুসরণ করে বলেছেন: “…electoral systems may further distort’ the people’s choice and further more electoral corruption may add to this confusion.” ১৯৭২ সালে মার্কিন রাষ্ট্রপতির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠে। এবং ওয়াটারগেট কেলেংকারীকে কেন্দ্র করে মার্কিন রাষ্ট্রপতি নিকসনের পদত্যাগের ঘটনা ঘটে। আবার নির্বাচন পদ্ধতির সীমাবদ্ধতার জন্যও অনেক ক্ষেত্রে জনসাধারণের অভিমত যথাযথভাবে প্রকাশিত হয় না। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং এক-ভোটপত্র পদ্ধতির কথা বলা যায়। নির্বাচকমণ্ডলীর সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন না পেয়েও এই নির্বাচন পদ্ধতির মাধ্যমে কোন একজন প্রার্থী নির্বাচিত হতে পারেন।