রাজনীতিক উৎসাহ থেকেই ভোট প্রদান:
রাজনীতিক বিষয়ে উৎসাহ বা আগ্রহের আচরণগত অভিব্যক্তি হল ভোট প্রদান। মানুষ ভোট প্রদানে অনুপ্রাণিত হয় রাজনীতিক উৎসাহ থেকেই। এবং এই রাজনীতিক উৎসাহ সৃষ্টির নানা কারণ বর্তমান। এ প্রসঙ্গে পারিবারিক উত্তরাধিকার, ব্যক্তিগত প্রবণতা, রাজনীতিক দলের উদ্যোগ প্রভৃতির কথা বলা যায়। নির্বাচকমণ্ডলীর মধ্যে একটা অংশ আছেন যাঁরা রাজনীতিক বিচারে একেবারে অঙ্গীকারবদ্ধ। নির্বাচনে এই শ্রেণীর ভোটদাতারা নির্দিষ্ট রাজনীতিক দলের প্রতি তাঁদের অবিচল সমর্থন ব্যক্ত করেন এবং ভোট দেন। কিন্তু সকল ভোটদাতা রাজনীতিক দিক থেকে অঙ্গীকারবদ্ধ নয়। তাদের নির্বাচনী সিদ্ধান্ত বিভিন্ন বিষয়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। নির্বাচনী আচরণের নির্ধারক নির্ধারণের ব্যাপারে বিভিন্ন দেশে বহু সমীক্ষা সম্পাদিত হয়েছে। এই সমস্ত সমীক্ষা সূত্রে নির্বাচনী আচরণের নির্ধারক হিসাবে বহু ও বিভিন্ন উপাদানের পরিচয় পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে সামাজিক শ্রেণী, ধর্মীয় ও জাতিগত বৈশিষ্ট্য, নির্বাচকদের বয়স ও অভিজ্ঞতা, স্ত্রী-পুরুষ ভেদ, প্রার্থীর ব্যক্তিত্ব ও ভাবমূর্তি, রাজনীতিক ঐতিহ্য, শিক্ষাগত যোগ্যতা, গণসংযোগ ব্যবস্থা প্রভৃতি উপাদান হিসাবে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু নির্বাচনী আচরণের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারকারী এই সমস্ত উপাদানের কার্যকারিতার তুলনামূলক আলোচনা করা অনেক সময়েই অসম্ভব।
সাবেকী ও আধুনিক রাজনীতিক ব্যবস্থায় নির্বাচনী আচরণ:
নির্বাচনী আচরণের নির্ধারক সম্পর্কিত বিভিন্ন সমীক্ষায় নানা তথ্য ও তত্ত্বের সন্ধান পাওয়া যায়। তবে এক্ষেত্রে সাধারণভাবে বলা যায় যে সাবেকী রাজনীতিক ব্যবস্থায় এবং আধুনিক উন্নত রাজনীতিক ব্যবস্থায় নির্বাচনী আচরণ অভিন্ন প্রকৃতির হয়। না। সাবেকী ব্যবস্থা অশিক্ষা, নিরক্ষরতা, সেকেলে অনুন্নত গণ-সংযোগ ব্যবস্থা, সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি প্রভৃতি পরিলক্ষিত হয়। সাবেকী রাজনীতিক ব্যবস্থায় এই সমস্ত বৈশিষ্ট্য নির্বাচকদের রাজনীতিক চেতনার প্রসারের পথে প্রতিবন্ধক হিসাবে প্রতীয়মান হয়। তার ফলে ভোটদাতাদের মধ্যে রাজনীতিক ব্যবস্থা ও বিদ্যমান সমস্যাদি সম্পর্কে চেতনার বিকাশ ও বিস্তার ঘটে না। এই সমস্ত নির্বাচকদের নির্বাচনী আচরণ যথাযথ বিচার-বিবেচনার ভিত্তিতে যুক্তিসঙ্গতভাবে পরিচালিত হয় না। তাঁরা সাধারণত জাতিগত, গোষ্ঠীগত বা উপজাতীয় স্বার্থের সংকীর্ণ চিন্তাধারার দ্বারা পরিচালিত হন। অপরদিকে আধুনিককালের উন্নত রাজনীতিক ব্যবস্থায় নির্বাচকমণ্ডলীর মধ্যে রাজনীতিক চেতনার প্রসার পরিলক্ষিত হয়। তাঁরা ভোটপ্রদানের ক্ষেত্রে যুক্তিসঙ্গত বিচার-বিবেচনার দ্বারা পরিচালিত হন। আবার আধুনিক ও সাবেকী ব্যবস্থার সহাবস্থান পরিলক্ষিত হয় উন্নয়নশীল রাজনীতিক ব্যবস্থায়। তবে এ কথার অর্থ এই নয় যে উন্নত আধুনিক রাজনীতিক ব্যবস্থায় সকলের নির্বাচনী আচরণ সম্পূর্ণভাবে যুক্তিসঙ্গত বিচার-বিবেচনার দ্বারা পরিচালিত হয়। নির্বাচনী আচরণের ক্ষেত্রে সার্বিক যুক্তিনিষ্ঠা কোথাও পাওয়া যাবে না। নির্বাচকমণ্ডলীর একটি অংশের মধ্যে সংকীর্ণ আনুগত্যের অস্তিত্ব অল্পবিস্তর বর্তমান থাকে।
দলীয় আনুগত্য:
নির্বাচকগণ সব সময় বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের অনুপন্থী চিন্তা-চেতনার দ্বারা পরিচালিত হন না। সংকীর্ণ দলীয়, গোষ্ঠীগত ও ধর্মীয় স্বার্থও ব্যক্তির নির্বাচনী আচরণকে প্রভাবিত করে থাকে। তবে সাধারণভাবে বলা যায় যে মূলত দলীয় আনুগত্যের পরিপ্রেক্ষিতেই ব্যক্তির নির্বাচনী আচরণ নির্ধারিত হয়। আবার এই দলীয় আনুগত্যের বিষয়টি বিভিন্ন উপাদানের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। এই সমস্ত উপাদানের মধ্যে বল সামাজিক শ্রেণী, জাতিগত ও ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য, পেশা ও বয়সের তারতম্য প্রভৃতির উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। বল বলেছেন: “Voting behaviour is more easily explained by emphasising party loyalty, this loyalty being determined by various factors including social class and religion.”
সামাজিক শ্রেণীর ধারণা:
নির্বাচকদের নির্বাচনী অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে সামাজিক শ্রেণীর ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নির্বাচনী আচরণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে সামাজিক শ্রেণী হল এক অন্যতম প্রধান উপাদান। বল বলেছেন: “Class is an obvious factor in electoral behaviour, Peter Pulzer has confidently claimed: Class is the basis of British Party politics, all else is embellishment and detail.” সামাজিক শ্রেণীর সংজ্ঞা নির্ধারণ সহজ ব্যাপার নয়। এ বিষয়ে বিতর্কের অবকাশ আছে। এতদ্সত্ত্বেও চলে আসা ধারণা অনুসারে বলা যায় যে সামাজিক শ্রেণীবিন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি হল পেশা, আয় ও শিক্ষা। বলের অভিমত অনুসারে যেহেতু সামাজিক শ্রেণী নির্বাচকদের নির্বাচনী প্রাধিকারের ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ প্রতিপন্ন হয়, সেহেতু ব্যক্তিগত ও বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়নের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। বল বলেছেন: “There are, it is true, certain difficulties of defining social class, occupation, income and education are important criteria in classification but as regards class being a reliable guide to voters’ electoral preferences, objective and subjective (self-assigned class) assessments must be taken into account.”
সামাজিক শ্রেণী ও নির্বাচনী আচরণ:
পৃথিবীর সকল দেশেই ভোটদাতাদের নির্বাচনী আচরণের উপর সামাজিক শ্রেণীর অর্থবহ প্রভাব ক্রমশ বাড়ছে। এ বিষয়ে দ্বি-মতের অবকাশ নেই। ভোটপ্রদানের ক্ষেত্রে শ্রেণীগত বিন্যাসের ব্যাখ্যা থেকেই বিষয়টি স্পষ্টত প্রতিপন্ন হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিম্নবিত্ত শ্রেণীর নির্বাচকরা সাধারণত গণতন্ত্রী দল (Democratic Party)-কে ভোট দেয়। এ প্রসঙ্গে বল মন্তব্য করেছেন: “Social class is less significant in American elections than in Western Europe, yet people with lower incomes tend to support the Democratic Party.” আবার বিত্তবান মার্কিন নাগরিকরা সাধারণত সাধারণতন্ত্রী দল (Republican Party)-কে ভোট দেয়। ফ্রান্সেও শ্রমিক শ্রেণীর ভোট সাধারণত কমিউনিস্ট ও সোসালিস্ট পার্টির প্রার্থীরাই লাভ করেন। এ প্রসঙ্গে বলের অভিমত প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন: “Even in France,…the importance of social class is still underlined ;…de Gaulle’s was still lowest in the working class and highest among businessmen and shopkeepers.” আবার গ্রেট ব্রিটেনে শ্রমিক শ্রেণীর ভোটদাতাদের সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন শ্রমিক দল লাভ করে। কিন্তু শ্রমিক শ্রেণীর সমর্থন রক্ষণশীল দলও পায়। তবে ব্রিটেনের শ্রমিক শ্রেণীর ভোটদাতারা ক্রমশ বেশী সংখ্যায় শ্রমিক দলের প্রতি ঝুঁকছে। এ প্রসঙ্গে বলের অভিমত হল: “The National Opinion Poll findings on the October 1974 British general election showed that ‘class is strongly correlated with party.” সামাজিক শ্রেণী ও নির্বাচনী আচরণ সম্পর্কে স্বাধীনভাবে মন্তব্য করা হয় যে, নিম্নবিত্ত শ্রেণীর নির্বাচকরা ব্যাপক বৈপ্লবিক পরিবর্তনে উদ্যোগী রাজনীতিক দলকে অধিক মাত্রায় সমর্থন জানায়। বল মন্তব্য করেছেন: “…it is more likely that the lower the socio economic position of the elector, the more inclined is that elector to vote for parties committed to a greater degree of radical change…..” এই কারণের জন্য অধিকাংশ রাজনীতিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বঞ্চিত শ্রেণীর নির্বাচকরা সাধারণত কমিউনিস্ট, সামাজিক, গণতান্ত্রিক প্রভৃতি বামপন্থী রাজনীতিক দলগুলিকে সমর্থন জানায়।
ধর্মীয় ও জাতিগত উপাদান:
নির্বাচনী আচরণের উপর ধর্মের প্রভাবও অনস্বীকার্য। নির্বাচনী আচরণের উপর প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে জাতিগত ও ধর্মীয় উপাদানের ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বল বলেছেন: “Religious affiliation and race may account for more important determinants of voting behaviour in some political system.” এমনকি শ্রেণীগত বিন্যাসের পরিবর্তে জাতিগত বা ধর্মীয় বিচার-বিবেচনার ভিত্তিতে ভোটদাতাগণ পরস্পর-বিরোধী দলে বিভক্ত হয়ে পড়তে পারেন। অর্থাৎ ধর্মীয় বিবেচনার ভিত্তিতে ভোটদাতাদের মধ্যে মেরুপ্রবণতার সৃষ্টি হতে পারে। এ প্রসঙ্গে বল সমর্থনসূচক একাধিক উদাহরণ উল্লেখ করেছেন। উত্তর আয়ারল্যাণ্ডে সামাজিক শ্রেণী নির্বিশেষে ইউনিয়নিস্ট দল (The Unionist Party) প্রোটেস্ট্যান্টদের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট লাভ করে। ফ্রান্সে রক্ষণশীল দলসমূহ ক্যাথলিকদের সমর্থন লাভ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জাতিগত বিচারে সংখ্যালঘু ভোটদাতারা সাধারণত গণতন্ত্রী দলকে সমর্থন করে। কানাডা, বেলজিয়াম এবং দক্ষিণ আফ্রিকাতেও নির্বাচনী আচরণের উপর ধর্মীয় ও জাতিগত বিন্যাসের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। বল বলেছেন: “American ethnic minorities have tended to support the Democratic Party, and voting in Canada, Belgium and South Africa is still based on religious ethnic divisions.” বল আরও বলেছেন: “The American Presidential election of 1960 underlines the importance of religion,….religious affiliations may be seen in the British regional pattern of voting.”
ধর্মীয় উপাদানের সীমাবদ্ধতা:
ধর্মীয় বিচার-বিবেচনা রাজনীতিক আচার-আচরণকে প্রভাবিত করে। এ কথা ঠিক। কিন্তু একথা ঠিক নয় যে সকল নির্বাচকের নির্বাচনী আচরণকে ধর্মীয় উপাদান সামগ্রিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। এ সম্পর্কিত কোন সমীক্ষাতেই একথা প্রমাণিত হয়নি যে, ধর্মাবলম্বী সকল ভোটদাতা ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচনী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তবে ধর্মাবলম্বী মানুষের একটা অংশ যে ধর্মীয় বিচার-বিবেচনার ভিত্তিতে রাজনীতিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, সে বিষয়ে দ্বি-মতের অবকাশ নেই। বর্তমানে নির্বাচনী আচরণের উপর ধর্মীয় উপাদানের প্রভাব হ্রাস পেয়েছে। এর পিছনে নানা কারণ বর্তমান। এ ক্ষেত্রে কারণ হিসাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার বিকাশ ও বিস্তার; আধুনিকীকরণ, শিল্পায়ন ও নগরায়ণ; আধুনিক শিক্ষার প্রসার প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এখন সকল রাজনীতিক আচরণের উপর ধর্মের সাবেক প্রভাব আর নেই। বল মন্তব্য করেছেন: “However, the dividing line between class, religion and ethnic origin is not a firm one;…”
নারী-পুরুষ ও নির্বাচনী আচরণ:
নির্বাচনী আচরণ বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ধর্মের সঙ্গে নারী-পুরুষের বিচার-বিবেচনাও যুক্ত করা হয়। সাধারণভাবে বলা হয় যে মহিলারা সাধারণত ধর্মপ্রাণা হয়ে থাকেন। এবং এই কারণে মহিলাদের মধ্যে দক্ষিণপন্থী রাজনীতিক দলের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপনের প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। বল বলেছেন: “It has been claimed that women voters are more likely to be religious and therefore show a greater tendency to vote for right-of-centre parties.” তা ছাড়া বলা হয় যে নির্বাচনী আচরণের ক্ষেত্রে পুরুষদের তুলনায় মহিলারা অনেক বেশী রক্ষণশীল প্রকৃতির। এ ব্যাপারে ব্যাখ্যামূলক নানা কারণের কথা বলা হয়। কিন্তু কোন সমীক্ষাতেই এই কারণগুলি সন্তোষজনক প্রমাণিত হয়নি। বল এ প্রসঙ্গে সমস্যার কথা বলতে গিয়ে বলেছেন যে নির্বাচনী আচরণ নির্ধারক উপাদানগুলি পরস্পরের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত এবং পরস্পরের উপর নির্ভরশীল থাকতে পারে। সুতরাং স্বাধীন নির্ধারক হিসাবে এই উপাদানগুলিকে বিচ্ছিন্ন করার প্রয়াস থেকে গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে।
বয়স ও নির্বাচনী আচরণ:
নির্বাচনী আচরণের উপর বয়সের তারতম্যের প্রভাবের কথাও বলা হয়। সাধারণভাবে বলা হয় যে ভোটদাতাদের মধ্যে যাঁরা বয়সে প্রবীণ তাঁরা নির্বাচনী আচরণের ক্ষেত্রে সাধারণত রক্ষণশীল হন। অপরদিকে বয়সে নবীন নির্বাচকরা সাধারণত পরিবর্তনকামী রাজনীতিক ধারার সমর্থক হন। তবে নির্বাচনী আচরণ সম্পর্কিত এ ধরনের সিদ্ধান্ত সামগ্রিকভাবে সত্য এমন দাবি করা যায় না। এ ক্ষেত্রে ভোটদাতার বয়সের থেকে অধিক শক্তিশালী নির্বাচনী অভ্যাস গড়ে উঠার সময়কার প্রভাব। এই কারণে বল বলেছেন: “Age is a difficult factor to treat as an independent variable…..” নির্বাচনী আচরণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিশেষ কোন দলীয় মতাদর্শ ও কর্মসূচীর প্রতি গভীর আনুগত্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এই আনুগত্য অধিকতর দৃঢ় হয়। তার ফলে নির্বাচনী আচরণের উপর এই বিষয়টির প্রভাব বয়সের প্রভাবের থেকে অধিক হয়ে থাকে। বল বলেছেন: “….age may be less important that the strength of the voters attachment to a political party, and it is this allegiance that hardens with age.”
প্রার্থীর ব্যক্তিত্ব ও নির্বাচনী আচরণ:
ভোটদাতাদের নির্বাচনী চিন্তা-ভাবনাকে প্রভাবিত করার ব্যাপারে নির্বাচনী ব্যক্তিত্বের বিষয়টিও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। নির্দিষ্ট রাজনীতিক দলের প্রতি ভোটদাতাদের অন্ধ আনুগত্যের জন্য দলীয় প্রার্থীর গুণগত যোগ্যতার বিষয়টি গৌণ প্রতিপন্ন হয়। কিন্তু অনেক সময় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে বিশিষ্ট কোন ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি নির্বাচকদের মধ্যে তাঁর অনুকূলে দলীয় আনুগত্য পরিবর্তনের প্রবণতা সৃষ্টি করে। বল বলেছেন: “….the personality of candidates and issues may be factors in persuading the voter to change his party allegience.” এ প্রসঙ্গে বল ১৯৫২ এবং ১৯৫৬ সালে মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে আইসেনহাওয়ার (Eisenhower)-এর উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের অনুকূলে প্রবল সমর্থনের কথা বলেছেন।
অন্যান্য পরিবর্তনীয়:
নির্বাচনী আচরণের উপর প্রভাব বিস্তারকারী আরও অনেক উপাদানের কথা বলা হয়। এই সমস্ত উপাদান বা পরিবর্তনীয়ের (variables) মধ্যে নির্বাচনী কর্মসূচীর প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না। নির্বাচনের প্রাক্কালে রাজনীতিক দলগুলির নির্বাচনী ইস্তেহার ভোটদাতাদের নির্বাচনী ভাবনা চিন্তাকে প্রভাবিত করে। আবার সমকালীন গুরুত্বপূর্ণ কোন সমস্যা বা রাজনীতিক ঘটনাও নির্বাচনী আচরণের অন্যতম নির্ধারক হিসাবে কাজ করে। তা ছাড়া আঞ্চলিকতা, সাম্প্রদায়িকতা, জাত-পাতের চেতনা, ভাষা সমস্যা প্রভৃতিও এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। এ প্রসঙ্গে রাজনীতিক মতাদর্শের প্রভাবের কথাও উল্লেখ করা আবশ্যক। মূলত রাজনীতিক মতাদর্শ বিচার-বিবেচনার ভিত্তিতেই পরিণত ও সচেতন নির্বাচকরা নির্বাচনী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন। তবে রাজনীতিক দিক থেকে যাঁরা তেমন পরিণত নন, এরকম নির্বাচকদের কাছে দলীয় কার্যকলাপ, রাজনীতিক যোগাযোগ, আর্থনীতিক সমস্যা, আঞ্চলিক সমস্যা, রাজনীতিক নেতাদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি প্রভৃতি নির্বাচনী আচরণের নির্ধারক হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃত প্রস্তাবে ভোটদাতাদের নির্বাচনী সিদ্ধান্তকে অনেক সময় একাধিক উপাদান বা পরিবর্তনীয় একই সঙ্গে প্রভাবিত করে থাকে। এবং সাধারণত এরকম ঘটনাই ঘটে। সেক্ষেত্রে কোন একটি উপাদানের একক ভূমিকা সম্পর্কে সহজে কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না।
অঙ্গীকারহীন ভোটদাতা:
নির্বাচনী আচরণ সম্পর্কিত আলোচনার শেষের দিকে বল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা করেছেন। নির্বাচনী আচরণ সম্পর্কিত সমীক্ষার ক্ষেত্রে সাধারণভাবে প্রচলিত ধারণা হল যে, অধিকাংশ নির্বাচকের নির্বাচনী আচরণ মোটামুটি স্থির। অল্পকিছু সংখ্যক ভোটদাতার নির্বাচনী আচরণ পরিবর্তনশীল। এঁদের বলা হয় অঙ্গীকারহীন ভোটদাতা বা ‘floating voters’। অঙ্গীকারবদ্ধ ভোটদাতাদের মধ্যে সুদৃঢ় দলীয় আনুগত্য বর্তমান থাকে। কিন্তু অঙ্গীকারহীন ভোটদাতার মধ্যে তা থাকে না। সাবেকী উদারনীতিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে মনে করা হত যে এই সমস্ত অঙ্গীকারহীন ভোটদাতারা হলেন খোলা মনের, যুক্তিবাদী, বস্তুনিষ্ঠ এবং নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তহীন। কিন্তু কতকগুলি সমীক্ষার সিদ্ধান্ত বিপরীত। তদনুসারে এই সমস্ত ভোটদাতারা অঙ্গীকারবদ্ধ ভোটদাতাদের তুলনায় রাজনীতিক বিষয়ে কম সচেতন এবং রাজনীতিক কাজকর্মে অংশগ্রহণের ব্যাপারে নিরুৎসাহী। বল এ প্রসঙ্গে বাটলার এবং কিং (D. Butler and A. King) -এর The British General Election of 1996 শীর্ষক রচনাটির উল্লেখ করেছেন। এই বক্তব্য অনুসারে অঙ্গীকারহীন ভোটদাতারা সাধারণত বয়সে নবীন। তাঁরা সাধারণত নিম্ন-মধ্যবিত্ত এবং উচ্চস্তরের শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যেই অধিক সংখ্যায় থাকেন। রাজনীতিক দলের অঙ্গীকারবদ্ধ সমর্থকদের তুলনায় এই সমস্ত ভোটদাতাদের অধিকাংশ কম শিক্ষিত, সক্রিয় রাজনীতিতে কম উৎসাহী এবং জনসাধারণের স্বার্থ সম্পর্কিত বিষয়ে কম ধারণাযুক্ত। বল অঙ্গীকারহীন ভোটদাতা সম্পর্কিত উপরিউক্ত বক্তব্যকে স্বীকার করেননি। তিনি বলেছেন: “This view, that while the vast majority of electors are stable in their voting behaviour, elections are decided by a relatively small, ill-informed and disinterested minority has been challenged recently on two fronts.” অর্থাৎ বল এক্ষেত্রে দু’টি কারণ দেখিয়েছেন। (১) অঙ্গীকারবদ্ধ ভোটদাতাদের তুলনায় অঙ্গীকারহীন ভোটদাতারা কম শিক্ষিত বা কম রাজনীতি সচেতন নন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সম্পাদিত সাম্প্রতিককালের নির্বাচনী সমীক্ষা থেকে এ কথা প্রতীয়মান হয়। (২) কিছু সংখ্যক অঙ্গীকারহীন ভোটদাতাদের কারণেই নির্বাচনী ফলাফল পরিবর্তিত হয়ে যায় না। যা ভাবা হয় তার থেকে অনেক বেশী অনিশ্চয়তা নির্বাচনী আচরণের মধ্যে বর্তমান থাকে। গ্রেট ব্রিটেনের নির্বাচনী সমীক্ষা থেকে এই বিষয়টি স্পষ্টত প্রতিপন্ন হয়। অর্থাৎ মার্কিন ও ব্রিটিশ নির্বাচনী সমীক্ষা থেকে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে নির্বাচনী আচরণ নির্দিষ্ট বা স্থায়ী কোন বিষয় নয়। এবং অঙ্গীকারহীন ভোটদাতারাও ভালভাবেই রাজনীতি সচেতন ও পরিণত। বেনেউইক (R. J. Benewick) ও অন্যান্য কর্তৃক সম্পাদিত ব্রিটিশ সমীক্ষার প্রতিবেদনকে উদ্ধৃত করে বল বলেছেন: “The statistics on the recall of voting behaviour and the stability of voting behaviour indicate that the size of the floating vote is considerably greater than has been commonly thought…. Moreover the figures… indicate that a substantial proportion of the floating voters were well-in formed and interested in politics.”
নির্বাচনী আচরণ সম্পর্কিত আলোচনার সীমাবদ্ধতা:
প্রকৃত প্রস্তাবে নির্বাচনী আচরণকে প্রভাবিত করে এমন পরিবর্তনীয় (variable) বা উপাদান বহু ও বিভিন্ন অর্থাৎ বিভিন্ন প্রকৃতির নির্ধারকের দ্বারা নির্বাচনী আচরণ প্রভাবিত হয়ে থাকে। এই পরিবর্তনীয়গুলি আবার পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এবং পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। অনেক সময় কোন কোন পরিবর্তনীয় অব্যক্তভাবে কাজ করে। এই অবস্থায় নির্বাচনী আচরণের নির্ধারক নির্ধারণের জন্য বহু ও বিভিন্ন বিষয়ে নানা রকম তথ্যাদি সংগ্রহ করা আবশ্যক। এক্ষেত্রে সমীক্ষকদের আন্তঃসমাজবিজ্ঞানমূলক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হয়। এতদসত্ত্বেও প্রয়োজনীয় যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। তাপরিহার্য তথ্যাদির অপ্রতুলতার জন্য নির্বাচনী আচরণ সম্পর্কে কোন নির্ভরযোগ্য সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভবপর হয় না। সুতরাং যথেষ্ট সতর্কতা সত্ত্বেও নির্বাচনী আচার আচরণ ও নির্বাচনী আচরণের নির্ধারক সম্পর্কিত বিচার-বিশ্লেষণের সীমাবদ্ধতা অস্বীকার করা যায় না।
Leave a comment