প্রশ্নঃ “নির্বাচকমণ্ডলী সরকারের চতুর্থ অঙ্গ”— আলোচনা কর।
অথবা, নির্বাচকমণ্ডলী বলতে কী বুঝ? নির্বাচকমণ্ডলীকে কেন সরকারের চতুর্থ অঙ্গ বলা হয়? আলোচনা কর।
অথবা, নির্বাচকমণ্ডলীকে সরকারের চতুর্থ অঙ্গ বলা হয় কেন? বর্ণনা কর।

ভূমিকাঃ “নির্বাচকমণ্ডলী কার্যত সরকারের একটি স্বতন্ত্র ও অত্যন্ত প্রভাবশালী শাখা” [অধ্যাপক গেটেল]। গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচকমণ্ডলী একটি অপরিহার্য অঙ্গ। নির্বাচকমণ্ডলীকে বাদ দিয়ে একনায়কতান্ত্রিক শাসন নিশ্চিতভাবে পরিচালিত হতে পারে, কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি নির্বাচকমণ্ডলী। প্রাচীন কালে জনগণ শাসনকার্যে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতো। কিন্তু বর্তমানে বিশাল আয়তন বিশিষ্ট রাষ্ট্রে জনগণ প্রত্যক্ষভাবে শাসন কাজে অংশগ্রহণ করতে পারে না। তাই তারা প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচন করে এবং প্রতিনিধিরা আইন ও শাসন বিভাগীয় কাজে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। তাই দেখা যায়, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় নির্বাচকমণ্ডলীর গুরুত্ব অপরিসীম।

নির্বাচকমণ্ডলীকে সরকারের চতুর্থ অঙ্গ বলার কারণসমূহঃ সরকারের তিনটি অঙ্গ যথাঃ আইন, শাসন ও বিচার বিভাগ। কিন্তু নির্বাচকমণ্ডলীর গুরুত্ব বিচারে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একে সরকাঃরের চতুর্থ অঙ্গ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তিনটি বিভাগ যেমন সরকার পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণে স্বতন্ত্র ও বিশেষ ভূমিকা পালন করে, তেমনি নির্বাচকমণ্ডলীও অসামান্য দায়িত্ব পালন করে থাকে। আধুনিক রাষ্ট্রে নির্বাচকমণ্ডলীর গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। অনেক লেখক একে সরকারের এক স্বতন্ত্ৰ বিভাগ বলে মন্তব্য করেছেন। ডব্লিউ. এফ. উইলোবি, জে. ডব্লিউ. গার্নার, আর. জি. গেটেল প্রমুখ চিন্তাবিদ এ মতের সমর্থক।

আর. জি. গেটেল বলেন, “নির্বাচকমণ্ডলী কার্যত সরকারের একটি স্বতন্ত্র ও অন্যতম প্রভাবশালী বিভাগ, কারণ এর বিস্তৃত ক্ষমতা আছে এবং তা সরকারি ব্যবস্থায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষরূপে প্রযোজ্য।” রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডব্লিউ. এফ. উইলোবি, নির্বাচকমণ্ডলীকে সরকারের চতুর্থ অঙ্গ হিসেবে গণ্য করেছেন। তার মতে, নির্বাচকমণ্ডলী দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার একটি শাখা বা অঙ্গই নয় বরং এটার কতিপয় সুস্পষ্ট, সুনির্দিষ্ট ও স্বতন্ত্র কার্যও রয়েছে। এভাবে নির্বাচকমণ্ডলী সরকারের এক স্বতন্ত্র ও গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে পরিণত হয়েছে। তাই নির্বাচকমণ্ডলীকে সরকারের চতুর্থ বিভাগ বলে গণ্য করলে তা অতিরঞ্জিত হবে না বলে অনেকে মনে করেন। যেসব গুরুত্বপূর্ণ কারণে নির্বাচকমণ্ডলীকে সরকারের চতুর্থ অঙ্গ বলা হয় তা নিম্নে আলোকপাত করা হলোঃ

১. আইন প্রণয়ন বা নীতিনির্ধারণঃ প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে নির্বাচকমণ্ডলী আইন প্রণয়ন ও পরিবর্তনে সরাসরি অংশগ্রহণ করে থাকে। তাছাড়া প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থায়ও নির্বাচকমণ্ডলীর চাহিদার প্রেক্ষিতেই আইন প্রণয়ন ও পরিবর্তিত হয়ে থাকে। নির্বাচকমণ্ডলী আইনসভার সদস্যদের নির্বাচন করে থাকে। আইনসভায় জনগণের জন্য কল্যাণকর আইন প্রণয়নের সময় নির্বাচকমণ্ডলী আইনসভার সদস্যদেরকে প্রভাবিত করতে পারে। তাছাড়া সরকারের নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে নির্বাচকমণ্ডলী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে থাকে। তাই নির্বাচকমণ্ডলীকে সরকারের চতুর্থ অঙ্গ বলা হয়।

২. জনমত গঠনঃ নির্বাচকমণ্ডলী তাদের ভোটাধিকার প্রদানের পাশাপাশি রাজনৈতিক অংশগ্রহণে ও যোগাযোগের মাধ্যমে কোন সরকারের পক্ষে কিংবা বিপক্ষে এবং কোন বিশেষ উদ্যোগ বা নীতির পক্ষে কিংবা বিপক্ষে প্রয়োজনীয় জনমত গঠনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সরকার যদি জনগণের স্বার্থবিরোধী কোন কাজ করে বা সরকার যদি স্বৈরাচার হয়ে উঠে তাহলে নির্বাচকমণ্ডলী সরকারের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করে এর পতন ঘটায়। এজন্য নির্বাচকমণ্ডলীকে সরকারের চতুর্থ অঙ্গ বলে আখ্যায়িত করা হয়৷

৩. প্রতিনিধি প্রত্যাহারঃ কোন কোন দেশে নির্বাচকমণ্ডলীর জনপ্রতিনিধি প্রত্যাহারের ক্ষমতা রয়েছে। এ ক্ষমতার মাধ্যমে নির্বাচকমণ্ডলী কোন নির্দিষ্ট কর্মকর্তাকে সরকারি পদ থেকে অপসারণ করতে পারেন। নির্বাচকমণ্ডলী রাষ্ট্রে এ পদ্ধতির মাধ্যমে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই নির্বাচকমণ্ডলীকে সরকারের চতুর্থ অঙ্গ বলা হয়।

৪. সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে মতামতঃ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণয়ন ও সংশোধনে নির্বাচকমণ্ডলী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এখানে নির্বাচকমণ্ডলীর মতামতের উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণয়ন ও সংশোধন করা হয়। নতুন কোন সংবিধান গ্রহণ করার পূর্বে নির্বাচকমণ্ডলীর মতামতের প্রাধান্য প্রতিফলিত হয়। এজন্য নির্বাচকমণ্ডলীকে সরকারের চতুর্থ অঙ্গ বলা হয়ে থাকে।

৫. সরকারের অপরিহার্য অঙ্গঃ আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচকমণ্ডলী সরকারের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। এজন্য অনেকে নির্বাচকমণ্ডলীকে সরকারের অপরিহার্য অংশ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তাছাড়া কোন কোন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী নির্বাচকমণ্ডলীকে সরকারের চতুর্থ বিভাগ হিসেবে গণ্য করেন।

৬. জাতীয় সমস্যার সমাধানঃ রাষ্ট্রে জাতীয় সমস্যার সৃষ্টি হলে সে মুহূর্তে নির্বাচকমণ্ডলী সরকারের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এমনকি ঐ সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারকে চাপ দেয়। সরকার চাপের মুখে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সমর্থ হয়।

৭. সরকার ও জনগণের সেতুঃ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচকমণ্ডলীর দৃষ্টিভঙ্গি সরকারের কার্যক্রম ও জনগণের আশা- আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটায়। যার ফলে সরকার ও জনগণের মধ্যে সেতু সৃষ্টি হয়। সরকার ও জনগণের মধ্যে সুষ্ঠুভাবে যোগাযোগ করে দেয়ার জন্য নির্বাচকমণ্ডলীকে সরকারের চতুর্থ অঙ্গ বলা হয়ে থাকে।

৮. প্রতিনিধি নির্বাচনঃ নির্বাচকমণ্ডলীর প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের প্রতিনিধি নির্বাচন। অনেক রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রধান নির্বাচকমণ্ডলীর দ্বারা নির্বাচিত হন। হিউমস অ্যান্ড মার্টিনের অভিমত অনুসারে প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের শর্তই হলো যে, জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগে ইচ্ছামতো প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারে। তাই নির্বাচকমণ্ডলীকে সরকারের চতুর্থ অঙ্গ বলা হয়৷

৯. সরকারের স্বৈরাচারিতা রোধ এবং জনস্বার্থ রক্ষাঃ নির্বাচকমণ্ডলী তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও জনমত গঠনের দ্বারা সরকারের স্বৈরাচারিতা রোধ করে, এবং জনস্বার্থ রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে প্রবৃত্ত হয়। সরকার স্বৈরাচারী কাজ করলে নির্বাচকমণ্ডলী তাতে বাধা প্রদান করে সরকারের ক্ষমতা সীমিত করে। তাই একে সরকারের চতুর্থ অঙ্গ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

১০. সরকার গঠন ও শাসনকার্যে অংশগ্রহণঃ আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচকমণ্ডলী ভোট প্রদানের মাধ্যমে সৎ ও উপযুক্ত প্রতিনিধি নির্বাচন করে সরকার গঠন ও শাসনকার্যে অংশ নেয়। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল যদি জনমতের বিরুদ্ধে কোন কাজ করে তাহলে নির্বাচকমণ্ডলী এর সমালোচনা করে প্রতিবাদ করতে পারে। সরকার গঠন ও শাসনকার্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার জন্য নির্বাচকমণ্ডলীকে সরকারের চতুর্থ অঙ্গ বলা হয়।

১১. জনগণের সার্বভৌমত্ব রক্ষাঃ নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটাধিকার প্রয়োগ ও দেশের নীতিনির্ধারণে জনমত গঠন কিংবা যৌক্তিক প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে জনগণের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সরকার যদি জনস্বার্থবিরোধী কোন স্বৈরাচারী কাজে লিপ্ত হয়, তখন নির্বাচকমণ্ডলী সরকারের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলে তা প্রতিহত করে। এজন্য নির্বাচকমণ্ডলীকে সরকারের চতুর্থ অঙ্গ বলা হয়।

উপসংহারঃ উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহে নির্বাচকমণ্ডলীর কার্যাবলি ও গুরুত্ব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকার গঠনের প্রথম পদক্ষেপ নির্বাচন থেকে শুরু করে সরকার পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণ এবং সরকারের পরিবর্তন ও পতন ঘটানোর ক্ষেত্রে নির্বাচকমণ্ডলী অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী। তাই এ ক্ষমতার বিবেচনায় নির্বাচকমণ্ডলীকে সরকারের চতুর্থ অঙ্গ বলে আখ্যায়িত করা যায়। বিশেষ করে প্রতিনিধিত্বশীল সরকার ব্যবস্থায় নির্বাচকমণ্ডলীকে সরকারের চতুর্থ অঙ্গ হিসেবে গণ্য করা অধিকতর যুক্তিসংগত।