প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ কি?
পরোক্ষ বা প্রতিনিধিমূলক গণতন্ত্রে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই দেশের শাসনকার্য পরিচালনা করেন। নির্বাচিত হওয়ার পর প্রতিনিধিদের জনমতের অনুকূলে এবং সর্বসাধারণের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করার কথা। প্রতিনিধিমূলক গণতন্ত্রের এটাই স্বাভাবিক ব্যবস্থা। কিন্তু নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সব সময় নির্বাচক-মণ্ডলীর অভিমত অনুসারে কাজ করবেন তেমন কোন নিশ্চয়তা থাকে না। তাঁরা জনমত ও জনস্বার্থ-বিরোধী কাজও করতে পারেন। সেক্ষেত্রে স্বৈরাচারী প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে জনগণের করণীয় কিছুই থাকে না। জনগণকে পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। জনগণ পরবর্তী নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিকে অপসারিত করার সুযোগ পায়। অর্থাৎ নির্বাচনই হল নির্বাচকমণ্ডলী ও প্রতিনিধিদের মধ্যে একমাত্র যোগসূত্র। প্রতিনিধিমূলক গণতন্ত্রের এই অসুবিধা দূর করা দরকার।
দৃঢ় জনমত:
গণতন্ত্রকে জনমত পরিচালিত শাসনব্যবস্থা বলা হয়। গণতন্ত্রে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের জনমতের অনুবর্তী ভূমিকা পালন করতে হয়। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা জনমতকে উপেক্ষা করতে পারেন না। তাই বলা হয় যে, সুসংগঠিত ও দৃঢ় জনমতই জন-নিয়ন্ত্রণের উৎকৃষ্ট উপায়। জনমত গঠন ও প্রকাশের মাধ্যম হিসাবে সংবাদপত্র, সভা-সমিতি প্রভৃতি বিভিন্ন উপায় ও ব্যবস্থা আছে। জনগণ এই সমস্ত উপায়ের যথাযথ ব্যবহারের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।
নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ন্ত্রণের অন্যান্য উপায়:
নির্বাচকমণ্ডলী অন্যান্য উপায়েও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। (১) প্রত্যক্ষ নির্বাচন পদ্ধতির মাধ্যমে জন-নিয়ন্ত্রণ কার্যকর হতে পারে। নাগরিকগণ প্রত্যক্ষভাবে অর্থাৎ সরাসরি প্রতিনিধি নির্বাচন করলে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের উপর তাদের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি পায়। (২) গেটেলের মতানুসারে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কার্যকাল অতি দীর্ঘ বা অতি সংক্ষিপ্ত হওয়া অনুচিত। প্রতিনিধিদের কার্যকাল এমন হবে যাতে পুনর্নির্বাচনের জন্য তাদের মাঝে মাঝে জনগণের কাছে আসতে হবে। এইভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের উপর নির্বাচকমণ্ডলীর প্রভাব বজায় থাকতে পারে। (৩) নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের এলাকা নির্দিষ্ট হওয়া বাঞ্ছনীয়। অর্থাৎ প্রার্থী যে এলাকার অধিবাসী কেবল সেই নির্বাচনী এলাকা থেকেই প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন। তাহলে নির্বাচিত প্রতিনিধি ভবিষ্যতের কথা ভেবে জননিয়ন্ত্রণকে উপেক্ষা করবেন না।
নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা:
তবে বর্তমানে গণতন্ত্র বলতে প্রতিনিধিমূলক শাসনব্যবস্থাকে বোঝায়। (ক) এই পরোক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রতিনিধিরা নির্বাচনের সময় প্রদত্ত প্রতিশ্রুতিসমূহ পরবর্তী কালে প্রায়শই রক্ষা করেন না। অনেক সময় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের জনবিরোধী ভূমিকাতেও দেখা যায়। এই অবস্থায় নির্বাচকমণ্ডলীকে পরের নির্বাচন পর্যন্ত বাধ্য হয়ে অপেক্ষা করতে হয়। (খ) তা ছাড়া পরোক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণ প্রতিনিধি নির্বাচন ছাড়া শাসনকার্য পরিচালনায় অংশগ্রহণের তেমন কোন সুযোগ পায় না। (গ) আবার কোন কারণে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির হঠাৎ ও ব্যাপক কোন পরিবর্তন ঘটলে সেই অবস্থায় জনগণের মতামত অনুধাবন করা প্রতিনিধিদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় প্রতিনিধিদের সিদ্ধান্ত নির্বাচকদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার পরিপন্থী হওয়ার আশংকা থাকে। (ঘ) সর্বোপরি ক্ষমতাসীন হয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সংখ্যালঘুদের স্বার্থ ও সমস্যাদিকে এবং সাধারণের মতামতকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করতে পারে। প্রতিনিধিদের কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার উপযুক্ত কোন ব্যবস্থা বা ক্ষমতা জনগণের হাতে থাকে না। তাই কোন কোন প্রতিনিধিমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংবিধানে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের উপর নির্বাচকমণ্ডলীর নিয়ন্ত্রণ অটুট রাখার জন্য কয়েকটি বিশেষ ব্যবস্থার উল্লেখ দেখা যায়।
প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ:
বর্তমানে বিভিন্ন প্রতিনিধিমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রতিনিধিদের উপর নির্বাচকমণ্ডলীর নিয়ন্ত্রণের পন্থা-পদ্ধতি সংবিধানে বিধিবদ্ধভাবে স্বীকৃত হয়েছে। এগুলিকে প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ (Direct Democratic Check) বলা হয়। প্রতিনিধিমূলক গণতন্ত্রে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের স্বরূপ যথাসম্ভব বজায় রাখার জন্য বা জন-নিয়ন্ত্রণ কার্যকর করার জন্য প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণগুলি গ্রহণ করা হয়। এই সকল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রধানত চারটি :
-
(১) গণ-ভোট,
-
(২) গণ-উদ্যোগ,
-
(৩) গণ-অভিমত এবং
-
(৪) পদচ্যুতি।
(১) গণ-ভোট:
কোন বিশেষ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য বিষয়টিকে জনগণের কাছে পেশ করাকে গণ-ভোট বলে। এই পদ্ধতি অনুসারে দেশের আইন-সভা কর্তৃক রচিত আইনের খসড়া প্রস্তাব নির্বাচকমণ্ডলীর কাছে উপস্থিত করতে হয়। নির্বাচকমণ্ডলীর সিদ্ধান্ত অনুসারে বিলটির ভাগ্য নির্ধারিত হয়। আইনের প্রস্তাবটি নির্বাচকমণ্ডলীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ অনুমোদন না করলে চূড়ান্তভাবে আইন প্রণীত হয় না। এই পদ্ধতির মাধ্যমে নির্বাচকগণ আইনসভার কার্যাবলী বিচার-বিবেচনা করার এবং আইনসভার স্বেচ্ছাচারিতা রোধ করার সুযোগ পান। সুইজারল্যাণ্ডের ন্যায় কিছু কিছু দেশে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি অনুসৃত হতে দেখা যায়।
বাধ্যতামূলক ও ঐচ্ছিক গণ-ভোট: গণ-ভোট দু’ধরনের হয়: (ক) আবশ্যিক বা বাধ্যতামূলক গণ ভোট (Obligatory Referendum) এবং (খ) ঐচ্ছিক গণ-ভোট (Optional Referendum)। যে সকল ক্ষেত্রে আইনসভাকে সকল আইনের খসড়া প্রস্তাব জনগণের সম্মতির জন্য পেশ করতে হয় তাকে বাধ্যতামূলক গণ-ভোট বলে। কোন্ কোন্ বিষয়ে গণ-ভোট গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক সংবিধানে তা নির্দিষ্ট করা থাকে। সাধারণত সাংবিধানিক আইনের সংশোধন, অর্থ সংক্রান্ত কোন আইন বা গুরুত্বপূর্ণ কোন সাধারণ আইন প্রণয়নের ব্যাপারে গণ-ভোট বাধ্যতামূলক হয়। অপরপক্ষে, যে ক্ষেত্রে কোন আইনের খসড়া প্রস্তাবকে নির্দিষ্ট সংখ্যক ভোটদাতার আবেদনক্রমে গণ-ভোটে পেশ করতে হয় তাকে ঐচ্ছিক গণ-ভোট বলে। অনেক ক্ষেত্রে আইনসভার একাংশ বা প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ এ ধরনের গণ-ভোটের দাবি উত্থাপন করতে পারে। সাধারণ আইনের ক্ষেত্রে ঐচ্ছিক গণ-ভোটের ব্যবস্থা থাকে। সুইজারল্যাণ্ডের শাসনব্যবস্থায় এই উভয় ধরনের গণ ভোটের ব্যবস্থা আছে।
(২) গণ-উদ্যোগ:
নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ জনগণের অভিপ্রেত কোন আইন প্রণয়নকে যদি উপেক্ষা করে থাকেন তাহলে ভোটদাতাগণ নিজেরাই এ বিষয়ে উদ্যোগী হতে পারেন। যে পদ্ধতির মাধ্যমে এটা সম্ভব তাকে গণ-উদ্যোগ বলা হয়। শাসনতান্ত্রিক নির্দেশ অনুসারে নির্দিষ্ট সংখ্যক নির্বাচক কোন বিশেষ বিষয়ে আইন-প্রণয়নের জন্য আইনসভাকে অনুরোধ জানায়। একে গণ-উদ্যোগ বলে। সুইজারল্যাণ্ডের সংবিধানে গণ-উদ্যোগের ব্যবস্থা আছে।
গণ উদ্যোগের প্রকারভেদ: গণ-উদ্যোগ দুধরনের হতে পারে: (ক) বিধিবদ্ধ বা সুসংবদ্ধ গণ-উদ্যোগ (Formulated Initiative) এবং (খ) অসংবদ্ধ গণ-উদ্যোগ (Unformulated Initiative)। নির্বাচকগণ নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে কোন আইনের সম্পূর্ণ খসড়া প্রস্তাব প্রস্তুত করলে তাকে সুসংবদ্ধ গণ-উদ্যোগ বলে। অপর দিকে, আইনের খসড়া প্রস্তাব অসম্পূর্ণ হলে তাকে অসংবদ্ধ গণ-উদ্যোগ বলা হয়। এক্ষেত্রে নির্বাচকমণ্ডলী অসম্পূর্ণ খসড়াটি সম্পূর্ণ করার জন্য আইনসভাকে অনুরোধ করে। গণ-উদ্যোগের মাধ্যমে রচিত আইনের খসড়া প্রস্তাবকে আইনে রূপান্তরিত করার জন্য আইনসভা গণ-ভোটের ব্যবস্থা করে। গণ ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থনে অনুমোদিত হলে প্রস্তাবটি আইনে পরিণত হয়; তা না হলে তা বাতিল হয়ে যায়। সুইজারল্যাণ্ডে গণ-উদ্যোগের ব্যবস্থা আছে।
(৩) গণ-অভিমত:
গণ-অভিমত বলতে জনগণের আদেশকে বোঝায়। গুরুত্বপূর্ণ কোন রাষ্ট্রনৈতিক বিষয়ে জনগণের সিদ্ধান্ত জানার জন্য বিষয়টিকে জনসমক্ষে উপস্থাপিত করা হলে তাকে গণ অভিমত বলা হয়। সাধারণত কোন স্থায়ী রাজনীতিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্দেশ্যে গণ-অভিমতের ব্যবস্থা করা হয়। তবে এখন সার্বভৌম শক্তির পরিবর্তনের প্রয়োজন হলে সে বিষয়ে গণ-অভিমত গৃহীত হয়ে থাকে। জনগণের সার্বভৌমিকতার স্বীকৃতিই হল এই পদ্ধতির তত্ত্বগত ভিত্তি। গণ- ও গণ-অভিমতের মধ্যে পার্থক্য হল এই যে রাজনীতিক বিচারে গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয়ে জনগণের মতামত হল গণ-অভিমত। কিন্তু গণ-ভোট গৃহীত হয় সাধারণত আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত প্রস্তাব সম্পর্কে। আপ্পাডোরাই বলেছেন: “The plebiscite, like the referendum, is a vote of the people on a matter referred to them; but unlike it, it is a vote on some important public question rather than on a law.” সাধারণত জাতিগত সংখ্যালঘুর ভাগ্য নির্ধারণ বা কোন একটি অঞ্চল কোন্ রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হবে তা নির্ধারণের জন্য গণ-অভিমত গ্রহণ করা হয়ে থাকে। ভারত বিভাগের প্রাক্কালে আসামের শ্রীহট্ট জেলার ভাগ্য নির্ধারণের উদ্দেশ্যে গণ-অভিমত গ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এরশাদ তাঁর পদে অধিষ্ঠিত থাকা-না-থাকার ব্যাপারে ১৯৮৫ সালে গণ-অভিমতের ব্যবস্থা করেছিলেন।
(৪) পদচ্যুতি— প্রত্যাবর্তনের নির্দেশ:
নির্বাচকমণ্ডলীর হাতে এক গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হল পদচ্যুতি। কোন নির্বাচিত প্রতিনিধির কাজকর্ম সন্তোষজনক না হলে সেই প্রতিনিধির নির্দিষ্ট কার্যকাল শেষ হওয়ার আগেই জনগণ তাকে অপসারিত করতে পারে। এই ব্যবস্থাকে পদচ্যুতি বলে। এই পদ্ধতি অনুসারে এক নির্দিষ্ট সংখ্যক ভোটদাতা তাদের প্রতিনিধির পদত্যাগ দাবি করে। তখন এই দাবি প্রস্তাবের আকারে গণ-ভোটে পেশ করা হয়। এই প্রস্তাব অধিকাংশ ভোটদাতার দ্বারা সমর্থিত হলে উক্ত প্রতিনিধিগণকে পদত্যাগ করতে হয়। পদচ্যুতি নির্বাচকমণ্ডলীর হাতে এক গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণসমূহের মধ্যে এই ব্যবস্থা সর্বাধিক কার্যকরী বলে গণ্য হয়। সুইজারল্যান্ডে এই ব্যবস্থা প্রচলিত আছে।
প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের গুণাগুণ
প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের সপক্ষে যুক্তি
গণতন্ত্র বলতে জনগণের এবং জনগণের দ্বারা পরিচালিত শাসনব্যবস্থাকে বোঝায়। এই কারণে প্রতিনিধিমূলক গণতন্ত্রে প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণগুলির ভূমিকা অপরিসীম।
(১) গণতন্ত্রের স্বরূপ সংরক্ষণ: প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণসমূহের মধ্যে আইন ও শাসন-সংক্রান্ত বিষয়ে শেষ ইচ্ছা প্রকাশের এবং শেষ কথাটি বলার ক্ষমতা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছ থেকে নির্বাচকমণ্ডলীর হাতে হস্তান্তরিত হয়। এই ব্যবস্থাগুলির মাধ্যমে জনগণ সরকারী কাজকর্মে সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। এভাবে গণতন্ত্র জনগণের দ্বারা পরিচালিত শাসনে পরিণত হয়।
(২) স্বৈরাচার রোধ: নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ দলীয় স্বার্থে কোন অবাঞ্ছিত আইন প্রণয়নে উদ্যোগী হলে বা জনসাধারণের স্বার্থকে উপেক্ষা করলে নির্বাচকমণ্ডলী এই সমস্ত পদ্ধতির মাধ্যমে তা প্রতিরোধ করতে পারেন। গণভোটের মাধ্যমে জনগণ আইনসভা কর্তৃক গৃহীত আইনের খসড়া প্রস্তাবসমূহ বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখতে পারে এবং জনস্বার্থবিরোধী আইনের খসড়াকে নাকচ করতে পারে। আবার পদচ্যুতির মাধ্যমে জনগণ স্বৈরাচারী প্রতিনিধিকে নির্ধারিত কার্যকাল শেষ হওয়ার আগেই পদচ্যুত করতে পারে। কার জনমতের বিরোধিতা করে স্বৈরাচারী হতে পারে না। সরকার জনমতের অনুগামী হতে বাধ্য হয়।
(৩) প্রতিনিধি ও নির্বাচকদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক: নির্বাচনের সময় ছাড়াও অন্য সময়ে জনগণের সঙ্গে আইনসভার সদস্যদের যোগাযোগ বজায় রাখার ব্যাপারে এই পদ্ধতিগুলির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এই পদ্ধতির মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধি ও নির্বাচকমণ্ডলীর মধ্যে সম্পর্ক গভীরতা লাভ করে। লর্ড ব্রাইস বলেছেন: “It helps the Legislature to keep in touch with the people at other times than at general election.”
(৪) রাজনীতিক চেতনার বিকাশ: তা ছাড়া এই নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাগুলি জনগণের রাজনীতিক চেতনা বৃদ্ধি করে ও জনমতকে ব্যাপ্ত করে। জনসাধারণ শাসনকার্য পরিচালনা সংক্রান্ত বিষয়ে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। তার ফলে তাদের রাজনীতিক বিচার-বুদ্ধি বিকশিত হয়। আপ্পাডোরাই মন্তব্য করেছেন: “Direct legislation, by means of referendum and the initiative is also of high value as a means of political education.”
(৫) প্রতিনিধিদের সজাগ রাখা: প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কর্তব্য কর্ম সম্পর্কে সজাগ রাখে এবং জনস্বার্থ সংরক্ষণের জন্য তাঁদের দায়িত্ব পালনে সচেতন করে।
(৬) প্রবহমান জনমতের প্রতিফলন: পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের ফলে পুনরায় জনমত যাচাই করার প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। এ রকম অবস্থায় সরকারী নীতি ও কর্মসূচী পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন হতে পারে। প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমে এই প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা করা যায় এবং সরকারী কাজকর্মে প্রবহমান জনমত প্রতিফলিত হয়।
(৭) নির্বাচনের সময় ভোটদাতারা সমগ্র দেশের সকল সমস্যা সামগ্রিকভাবে বিচার করে। কিন্তু গণ ভোটের মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয় স্বতন্ত্রভাবে বিচার-বিশ্লেষণের সুযোগ পাওয়া যায়। আবার গণ-উদ্যোগের মাধ্যমে জনগণ নিজেরাই তাদের অভিপ্রেত আইন প্রণয়নের সুযোগ পায়।
(৮) সর্বোপরি প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির মাধ্যমে জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রকৃত অর্থে বাস্তবে রূপায়িত হতে পারে।
প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের বিপক্ষে যুক্তি
কিন্তু আধুনিক বৃহদায়তনবিশিষ্ট জাতীয় রাষ্ট্রসমূহে এই সমস্ত পদ্ধতির প্রয়োগ অসম্ভব বিবেচিত হয়। তা ছাড়া প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণগুলির কতকগুলি অসুবিধা আছে।
(১) বৃহৎ রাষ্ট্রের পক্ষে অনুপযোগী: বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রই বৃহদায়তনবিশিষ্ট এবং জনবহুল। এই সমস্ত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের জনগণের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে ব্যাপক মতপার্থক্য থাকে। এই ব্যবস্থায় ভোটদাতাদের মতানুসারে আইন প্রণয়নের ব্যবস্থা করলে বহু পরস্পর-বিরোধী আইন প্রণীত হওয়ার আশংকা থাকে। এই সমস্ত রাষ্ট্রে এই সব পদ্ধতির প্রয়োগ অসম্ভব ত বটেই, ক্ষেত্রবিশেষে অকাম্যও। এই অবস্থায় কোন বিষয়েই জনগণের মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া অসম্ভব।
(২) জনগণের প্রয়োজনীয় জ্ঞানের অভাব: আধুনিক রাষ্ট্রের আইন প্রণয়ন সংখ্যায় বহু এবং প্রকৃতিতে অত্যন্ত জটিল। তাই আইন প্রণয়ন এখন বিশেষজ্ঞদের কাজে পরিণত হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দূরদৃষ্টি জনগণের থাকে না। তাই প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা জনগণের পক্ষে সম্ভব হয় না। ল্যাস্কি মন্তব্য করেছেন: “Direct government in fact, is too crude an instrument for the purpose of modern government.”
(৩) জনস্বার্থের ক্ষতি: ক্ষেত্রবিশেষে কিছু প্রভাবশালী ও চতুর ব্যক্তি জনগণকে প্রকৃত কল্যাণকর প্রস্তাবের বিরুদ্ধেও প্ররোচিত করতে পারে। ফলে কাম্য আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি হয় এবং জনস্বার্থ বিপন্ন হয়। অনেক সময় প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের সুযোগ নিয়ে সুযোগ সন্ধানী রাজনীতিক নেতারা অযথা জনগণকে বিভ্রান্ত করেন এবং বিপথে চালিত করেন।
(৪) জনবিরোধী সিদ্ধান্ত: আবার অনেক সময় এই সমস্ত পদ্ধতির মাধ্যমে সুবিধাবাদী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী জনগণকে নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থে পরিচালিত করতে পারে এবং কোন সৎ ও জনদরদী প্রতিনিধিকে পদচ্যুত করতে পারে। তার ফলে দেশের ও দশের কল্যাণ ব্যাহত হয়।
(৫) জরুরী অবস্থার উপযোগী নয়: এই সমস্ত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা দেশের সংকটপূর্ণ বা জরুরী অবস্থার মোকাবিলার ক্ষেত্রে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের পথে অবাঞ্ছিত বাধার সৃষ্টি করে। বস্তুত প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় সংকটকালীন পরিস্থিতিতেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দ্রুত ও দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় না।
(৬) গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য নয়: অনেকের মতে প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণগুলি গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য অপরিহার্য নয়। ইংল্যাণ্ডে বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এইসব ব্যবস্থা নেই। তবুও সেখানকার মানুষ সুইসদের থেকে কম স্বাধীনতা ভোগ করে না।
(৭) ব্যয়বহুল: তা ছাড়া এই সমস্ত পদ্ধতি যে অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ সে বিষয়ে দ্বি-মতের অবকাশ নেই।
(৮) আইনসভার মর্যাদা হানি: প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রবর্তিত হলে জনপ্রতিনিধি এবং আইনসভার ভূমিকা ও মর্যাদার হানি ঘটে। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তাঁদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পাদনে বড় একটা উদ্যোগী হন না। এই ব্যবস্থার ফলে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দায়িত্বশীলতা হ্রাস পায়। তাঁদের মধ্যে এই ধারণার সৃষ্টি হয় যে, তাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত নয়। জনগণই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। এমনকি যোগ্য, বিজ্ঞ ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিরা প্রতিনিধি হতে চান না। এ দিক থেকেও আইনসভার উৎকর্ষের অবনতি হয়।
(৯) গণ-ভোটে যে খসড়া প্রস্তাব পেশ করা হয়, তার কোন একটি অংশ যদি গ্রহণযোগ্য বিবেচিত না হয়, তা হলে পুরো প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যায়। প্রস্তাবের কোন অংশ সংশোধন করার সুযোগ থাকে না।
(১০) তা ছাড়া প্রশাসনিক সাফল্যের জন্য প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য নয়। অনেকের মতে এগুলি শাসনযন্ত্রের স্বাভাবিক গতিকে অনেক সময় অকারণে রুদ্ধ করে।
উপসংহার: ড. ফাইনারের মতানুসারে প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণগুলি প্রতিনিধিমূলক গণতন্ত্রের দুর্বলতা দূর করার ব্যাপারে তেমন কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে না। বস্তুত এই পদ্ধতিগুলির সুবিধা অপেক্ষা অসুবিধাই বেশী। ল্যাস্কি সীমাবদ্ধ পদচ্যুতি (limited recall)-র আংশিক নিয়ন্ত্রণের পক্ষপাতী। এতদ্সত্ত্বেও বলা যায় যে, এই সমস্ত পদ্ধতির সাফল্য বা কার্যকারিতা শর্তসাপেক্ষ। এই শর্তগুলি হল:
-
(ক) জনগণকে সংকীর্ণ স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে প্রকৃত দেশপ্রেমিকের ভূমিকা পালন করতে হবে;
-
(খ) জনগণকে উপযুক্ত রাজনীতিক জ্ঞানসম্পন্ন হতে হবে এবং
-
(গ) রাষ্ট্রের আয়তন ও জনসংখ্যা খুব বেশী হবে না।
সর্বোপরি সদাসতর্ক, সুসংগঠিত এবং সক্রিয় জনমতই হল জন-নিয়ন্ত্রণের প্রধান হাতিয়ার। তাই জনমতের ধারক ও বাহকগুলির সতত সক্রিয় ও জাগ্রত হওয়া দরকার।
Leave a comment