রবীন্দ্রনাথ বিরহের কবি। কেবল রবীন্দ্রনাথই বা কেন? বিশ্বের সমস্ত কবিদের সত্তাকেই বিরহের স্পর্শকাতর একটি অনুভূতি আচ্ছন্ন করে রেখেছে। রবীন্দ্রনাথের মধ্যে বিরহ মাঝে মাঝে পরিণত হয়েছে বিশ্বব্যাপী একটি আর্তিতে। এ বিরহ প্রিয়জনকে হারানোর বিরহ, এ বিরহ বিশ্বপ্রকৃতি থেকে বিচ্ছেদের বিরহ, এ বিরহ অতৃপ্ত সৌন্দর্যানুভূতির বিরহ। ‘সোনার তরী’ কবিতায় কবি সংসারের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যান জনিত বিরহে, ‘যেতে নাহি দিব’ কবিতায় কবি অমোঘ নিয়মিত হাতে প্রিয়জনকে তুলে দেওয়া জনিত বিচ্ছেদের বিরহে বিরহী, ‘বসুন্ধরা’ কবিতায় কবি প্রকৃতির কাছ থেকে বিচ্ছিন্নতার বিরহে বিরহী, ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ কবিতায় কবি অনস্ত সৌন্দর্যলক্ষ্মীকে না পাওয়ার বিরহে বিরহী। এই বিরহ নানা রূপে নানা রঙে নানা রসে রবীন্দ্রনাথের কবিসত্তার ওপরে ছাপ রেখে গিয়েছে।
‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’য় কবি এক অস্পষ্ট অপূর্ব সৌন্দর্যময়ী নারীর সঙ্গে নিরুদ্দেশের পথে যাত্রা করেছেন। নৌকার মাঝিরূপী এই নারীটি যে কে কবি তা জানেন না। ‘সোনার তরী’ কবিতার মাঝিটিকেও কবি স্পষ্ট করে চিনতে পারেননি। এই অস্পষ্টতার রহস্যই কবির আর্তিকে যেমন প্রবল থেকে প্রবলতর করে তুলেছে, কাব্যসৌন্দর্যের অনুভূতিটিকেও তেমনি করে তুলেছে তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্মতর। কবি-জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষা, আনন্দ-বেদনা পরিণত হয়েছে একটি আর্ত প্রশ্নে। এ প্রশ্নের কোনো উত্তর কবির কাছে মেলেনি। উন্মত্ত সিন্ধু, প্রায়ান্ধকার দিনান্তের ক্রমবর্ধমান রহস্য, ঝটিকার দীর্ঘশ্বাস এবং অনিশ্চিত বেদনার হাহাকার–কবির নিরুদ্দেশ যাত্রায় এরা সবাই তাঁর পাথেয়, কিন্তু সবচেয়ে বড়ো সঙ্গী হচ্ছে একটি অর্দ্ধপরিচিতা রমণী আর কবির বিরাট দুর্বোধ্য একটি প্রশ্ন—আর কতদূর, আরও কতদূরে।
কিন্তু কোথায় কবি যাত্রা করেছেন, আর তাঁর উদ্দেশ্যই বা কী? এই দুটিই কবির ঠিক জানা নেই। তাঁর কণ্ঠে গভীর পিপাসা, অনন্ত সৌন্দর্য মদিরা তিনি পান করতে চান। কিন্তু কোথায় সেই সৌন্দর্য ? সেই সৌন্দর্যলোকে তিনি পৌঁছবেনই বা কেমন করে ? কে তাঁকে ? সেইখানে নিয়ে যাবে ? কবির মনে এতগুলি প্রশ্ন। কিন্তু তাদের উত্তর দেবে কে ? কেউ না।
কবি একটি চিঠিতে লিখেছেন—’আমি সত্যি সত্যি বুঝতে পারিনে আমার মনে সুখ দুঃখ-বিরহ-মিলনপূর্ণ ভালোবাসা প্রবল, না সৌন্দর্যের নিরুদ্দেশ আকাঙ্ক্ষা প্রবল। আলোচ্য কবিতাটিতে কবির এই দ্বিতীয় সমস্যাটিই প্রবল আকার ধারণ করেছে। সৌন্দর্যের একটি অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণে কবি অভিভূত হয়ে সৌন্দর্যলক্ষ্মীর হাতে নিজেকে সমর্পণ করেছেন। হারিয়ে ফেলেছেন নিজেকে নিয়ন্ত্রিত করার ক্ষমতাটুকু পর্যন্ত। কিন্তু এই রহস্যময়ী বিদেশিনী নৌকার মাঝিটি কে ? কোনো কোনো সমালোচক একে কবিজীবনের নিয়ন্ত্রী হিসাবে চিহ্নিত করেছেন ; কোনো কোনো সমালোচক বলেছেন ইনি হচ্ছেন কাব্যলক্ষ্মী। তিনি যেই হোন, তাঁর কাছেই কবি যে আত্মসমর্পণ করেছেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই–না কবির, না আমাদের।
তাৎপর্যের দিক থেকে আলোচনা করলে বোঝা যাবে যে সৌন্দর্যলোকে উপনীত হওয়ার জন্যে কবি একটি বিপদসঙ্কুল অথচ সুন্দর পরিবেশের মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হচ্ছেন। কিন্তু কবি জানেন যে অনন্ত সৌন্দর্য উপভোগ করা মানুষের পক্ষে কোনো দিনই সম্ভব নয় ; দিকচক্রবালের মতো এই সৌন্দর্য-সীমান্ত ক্রমশই দূর থেকে দূরে অপসৃয়মান সৌন্দর্যলাভের পথটিও বড়ো বন্ধুর–আসন্ন সন্ধ্যার অন্ধকার, বাতাসের দীর্ঘশ্বাস, বিষাদময় অসীম রোদনের প্লাবন, তরঙ্গের উচ্ছ্বাস–কবির যাত্রাপথকে আতঙ্কিত করে তুলেছে এরা। ফলে প্রথম দিকে কবির মনে আকাঙ্ক্ষার যে তীব্রতা দেখা দিয়েছিল কবিতাটিকে অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সেই তীব্রতা কমতে কমতে পরিণত হয়েছে একটি অবশ্যম্ভাবী আত্মনিবেদনে।
স্নিগ্ধ মরণ আছে কি হোথায়,
আছে কি শান্তি, আছে কি সুপ্তি তিমিরতলে?
এরও কোনো উত্তর পেলেন না কবি। কিন্তু তিনি বেশ বুঝলেন যে সৌন্দর্যের কোনো অবসর নেই, তাই সৌন্দর্যের পূর্ণ অনুভূতি বলতেও কিছু নেই। আকাশের মতোই তা সীমাহীন। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সেই সৌন্দর্য আহরণ করাই মানুষের কাজ। সৌন্দর্য কেবল এগিয়ে চলেছে অপূর্ণতা থেকে পূর্ণতার দিকে। সেই সৌন্দর্যের আরহণে কবিকে নিরুদ্দেশের পথে যাত্রা করতে হবে বই কী! পরিপূর্ণ সৌন্দর্যকে উপভোগ করার অন্য কোনো পথ নেই। জীবন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একটানা এই পথ চলা— অবিরাম, অনিবার। এটা হচ্ছে সেই ‘Infinite passion and pain of finite heart that yearns.”
Leave a comment