রবীন্দ্রনাথের কবিমানসে দুটি বিপরীতধর্মী প্রবণতা যে ছিল তা তিনি নিজেই অনেকবার বলেছেন। একদিকে হাসিকান্না সুখ-দুঃখে ভরা এই মর্ত্য-পৃথিবী, অপরদিকে এক পরিপূর্ণ সৌন্দর্যের কাল্পনিক জগৎ তাঁকে আকর্ষণ করেছে। কে এই মর্ত্য-ধরণীর জীবনে তাঁকে আকর্ষণ করে কেই-বা তাঁর মনে জাগিয়ে তোলে সৌন্দর্যের নিরুদ্দেশ আকাঙ্ক্ষা এই জিজ্ঞাসার উত্তরে তিনি তাঁর কবিকর্মের নিয়ন্ত্রীশক্তির অস্তিত্বকে অনুভব করার কথা বলেছেন। এই শক্তি কখনও পুরুষ আবার কখনও নারীরূপে কবির কাছে প্রতিভাত হয়েছে। ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ কবিতায় কবি নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রীশক্তিকে এক রহস্যময়ী নারীরূপে কল্পনা করেছেন। এই কল্পিত সত্তাকেই কবি আলোচ্য কবিতায় কখনও ‘সুন্দরী’ কখনও ‘বিদেশিনী’ আবার কখনও ‘অপরিচিতা’ বলে সম্বোধন করেছেন।
‘সোনার তরী’ কাব্যের অপর দুটি কবিতা ‘সোনার তরী’ এবং ‘মানসসুন্দরী’ কবিতা দুটিতেও এক কাল্পনিক স্বতন্ত্র সত্তার বিগ্রহ আছে। এই সত্তা কবির জীবনের কর্মে ও কাব্যে সৃষ্টিশীলতায় নিজেকে যেভাবে প্রকাশ করেছেন—তার মধ্যে কবির সচেতন ইচ্ছাশক্তির প্রেরণা ছাড়া অপর এক শক্তির উপস্থিতি তিনি অনুভব করেন। ‘সোনার তরী’ ও ‘মানসসুন্দরী’ কবিতা দুটির মত ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ কবিতাতেও এই কল্পিত সত্তারই উপস্থিত ঘটেছে।
নিরুপাধি সৌন্দর্যের উদ্দেশ্যে কবি যাত্রা করেছেন, সোনার তরণীতে, নাবিকা রহস্যময়ী সুন্দরী বিদেশিনী। ইনি নীরব হাসিতে কবিকে ভরসা দেন, স্পষ্টভাবে কোনো প্রতিশ্রুতি দেন না। কবি এর ওপর নির্ভর করতে পারলেও তাঁর সংশয় দূর হয় না। যে অজ্ঞাত জগতের উদ্দেশ্যে কবি যাত্রা করেছেন তা নিজের অভিজ্ঞতার বাইরে বলেই বিদেশ। কিন্তু যিনি সেই দিকে কবিকে চালনা করেছেন, তিনি নিশ্চয় সে জগতের স্বরূপ জানেন। কবির পক্ষে ঐ অপরিজ্ঞাত সৌন্দর্যের জগৎটি যেমন বিদেশ, সেই জগতের অধিষ্ঠাত্রী দেবীও সেইরকম বিদেশিনী। এদিক থেকে ‘বিদেশিনী’ শব্দটি ব্যবহারের একটা অর্থ পাওয়া যায়। এ নারী তাঁকে পরিচালনা করেছে কিন্তু তার স্বরূপ তিনি জানেন না, নীরব রহস্যময়ী সুন্দরী রমণীর সঙ্গে কোনও ভাবের আদান প্রদানও তাঁর হয় নি; সুতরাং এ নারী তাঁর অপরিচিতা।
‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ কবিতায় কবির অনুভূত জীবন নিয়ন্ত্রীশক্তির বা জীবনের অধিষ্ঠাতা দেবতার কল্পনা পূর্ণ বিকশিত হয় নি। এই কল্পনা কবির মনে ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ তত্ত্বরূপে লাভ করেছে ‘চিত্রা’ কাব্যে। এই সত্তার আভাস বা ইঙ্গিতময়তাই প্রাধান্য লাভ করেছে বলেই ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’য় ‘বিদেশিনী’, ‘অপরিচিতা’ শব্দগুলি প্রযুক্ত হয়েছে; আবার বিমূর্ত সৌন্দর্যের লক্ষ্যের দিকে ধাবমান তরণীর রহস্যময়ী সঙ্গিনীর দেহসৌরভে কেশপাশের স্পর্শে কবির জীবনরচনাকারিণী সৌন্দর্যের সঙ্গে এক হয়ে গেছে। নারীমূর্তির রূপকে ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’য় যিনি চিত্রিত হয়েছেন তার মধ্যে কবির উপলব্ধিজাত জীবননিয়ন্ত্রী শক্তি বা জীবনদেবতারই আভাস ব্যঞ্ছিত হয়েছে যিনি কবিকর্মের প্রেরণাই শুধু দেন না সমগ্র জীবনকে একটি অখণ্ড তাৎপর্যে প্রথিত করে তোলেন। আলোচ্য কবিতার এ ব্যঞ্জনা পরবর্তী কাব্যসৃষ্টিতে পূর্ণাঙ্গ ও সুনির্দিষ্ট রূপ গ্রহণ করেছে।
যে সৌন্দর্যজগৎ কবির মানসে ক্রমে ক্রমে উদ্ঘাটিত হচ্ছে, তা এখন অসীম যে তাঁর ভয় হয়, শেষ পর্যন্ত সেখানে পৌঁছানো সম্ভব কিনা। আশঙ্কা ও সংশয় কবির চিত্তকে পীড়িত করেছে। তিনি আশা করেছিলেন, ঐ সৌন্দর্য-সাধনায় সকল সংশয় ও আশঙ্কা দুর হয়ে যাবে এবং নিবৃত্তি লাভ সম্ভব হবে। কিন্তু সৌন্দর্যের উদ্দেশ্যে যাত্রায় তাঁর বোধ হচ্ছে এ পথ অন্তহীন, লক্ষ্যে পৌঁছাবার আগেই তাঁর শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাবে, জীবনও চিরস্থায়ী নয়। তাই ব্যাকুল হয়ে তিনি সহযাত্রিণী নাবিকাকে ঐ আশঙ্কা দূর করতে বলেছেন, সে এক রহস্যময় হাসি হাসছে। এ হাসির অর্থ অভয় দান-রাত্রির অন্ধকার নামলেও আশঙ্কার কোনো কারণ নেই, এখনও কত প্রভাত আছে। সৌন্দর্যসাগর অকূল সীমাহীন হলেও সেই অসীমের বুকেই সৌন্দর্যের নানা আলোক বিচ্ছুরিত হবে। ঐ হাসিতে কবির আশা জাগছে কিন্তু তিনি সংশয়হীন হতে পারছেন না।
Leave a comment