যে অপরিচিতা মধুরহাসিনী বিনোদিনী কবিকে নিরুদ্দেশ যাত্রায় আকর্ষণ করেছেন তার পরিচয় দাও।
রবীন্দ্রনাথের কবিচিত্তে দুটি বিপরীতধর্মী প্রবণতা ক্রিয়াশীল ছিল তাঁর নিজের কথায়ই সে স্বীকৃতি রয়েছে। একদিকে এই মর্ত্য-পৃথিবী এবং অপরদিকে এক পরিপূর্ণ সৌন্দর্যের কাল্পনিক জগৎ তাঁকে আকর্ষণ করেছে। কে এই মর্ত্য-ধরণীর জীবনে তাকে আকর্ষণ করে, কেই বা তাঁর মনে জাগিয়ে তোলে নিরুপাধি সৌন্দর্যলাভের আকাঙ্ক্ষা। এই জিজ্ঞাসার উত্তরে তিনি তাঁর কবিকর্মের নিয়ন্ত্রীশক্তির অস্তিত্বকে অনুভব করার কথা বলেছেন।
‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ কবিতায় তিনি নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রীশক্তিকে সুন্দরী নারীরূপে কল্পনা করেছেন। ‘সোনার তরী’ কাব্যের জন্য কবিতায় একেই কবি ‘মানসসুন্দরী’ বা ‘বিদেশিনী’ নামে অভিহিত করেছেন। কবি নিজে যা কিছু করেছেন—জীবনের কর্মে ও কাব্যে সৃষ্টিশীলতায় নিজেকে যেভাবে প্রকাশ করেছেন তার মধ্যে কবির সচেতন ইচ্ছাশক্তির প্রেরণা ছাড়া অপর এক শক্তির উপস্থিতি তিনি অনুভব করেন। এই কল্পিত সত্তা ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’র ‘সুন্দরী’।
‘বিদেশিনী’র ডাকে কবি তাঁরই তরণীতে এক কল্পলোকের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছেন। বহু পথ অতিক্রম করলেও যাত্রা সমাপ্তির কোনো সম্ভাবনা দেখা না। কবি জানেন না তরীর চালিকা তাঁকে কোথায় নিয়ে। চলেছেন। এ যাত্রার লক্ষ্য সম্পর্কে প্রশ্ন করে কোনও উত্তর পাওয়া যায় না। সুন্দরী নাবিকা অকুল সমুদ্রের তরঙ্গোচ্ছ্বাসের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে রহস্যময় হাসি হাসেন মাত্র।
রাত্রির আবির্ভাবে সমুদ্রের জলরাশি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল এবং সেই ভীতি সঞ্চারী জলরাশির মধ্য দিয়ে তরণী এগিয়ে চলল। কিন্তু কবির কাছে বিস্ময়কর মনে হল যে এই ভয়ঙ্করতার মধ্যেও তরণীর রহস্যময়ী চালিকা নিরুদ্বিগ্ন, তাঁর মুখ নীরব হাসিতে উদ্ভাসিত।
সময় অতিক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কবিচিত্ত কখনও সংশয়, কখনও আশায় আন্দোলিত হল। যাত্রাশেষে অন্ততঃ মরণের স্নিগ্ধতাটুকু লাভ করা যাবে কিনা কবির এ প্রশ্নেরও কোনও উত্তর মিলল না।
এ কবিতায় তরণী চালিকার প্রতি কবির যে মনোভাব প্রকাশিত হয়েছে তাতে আশা ও আকাঙ্ক্ষা দুই প্রকাশিত হয়েছে। কোনো একটি আকাঙ্ক্ষার পূর্ণতা কবির লক্ষ্য—সে আকাঙ্ক্ষা নিরুপাধি সৌন্দর্যলাভের আকাঙ্ক্ষা। সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণের দিকে তাঁকে নিয়ে চলেছেন তাঁর জীবনের নিয়ন্ত্রী এক অন্তর্যামী শক্তি-সোনার তরীর সুন্দরী চালিকারূপে যার আবির্ভাব। লক্ষ্যে পৌঁছান সম্ভব কিনা এ ব্যাপারে কবির সংশয় উপস্থিত হয় এবং তিনি মোহিনী নাবিকার কাছ থেকে ভরসা চান। সঙ্গিনীর রহস্যের হাসিতে সে ভরসা মেলে, কিন্তু সংশয়ও একেবারে দূর হয় না।
কবির জীবনের নিয়ন্ত্রীশক্তি এই সজীব সত্তা যিনি এই কবিতায় নারীরূপে কল্পিত হয়েছেন, তাঁর উপর ভরসা রেখেই কবি যাত্রা করেছেন, সৌন্দর্যের পরিপূর্ণ জগতে উত্তীর্ণ হবেন এই আশা প্রাণে জাগছে। তাঁর নীরব হাসি নিশ্চয়তার আশ্বাসরূপেই কবির মনে প্রতিভাত হয়েছে, যদিও সংশয়ের ভাবটা সম্পূর্ণ দূরীভূত হয় নি। নিজের জীবনের এবং কাব্যসাধনার দিক থেকে আশা-নৈরাশ্যে আন্দোলিত কবিমানসের পরিচয় এই কবিতায় পাওয়া যায়। কবি রহস্যময়ী নাবিকার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছেন, নীরব হাসিতে আশ্বাস খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু এই শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করেন নি। সুন্দরী বহিত্র-বাহিনীর লাস্যলীলায় কবি অভিভূত হয়েছেন কিন্তু তাঁর অভিপ্রায় কবির কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে নি এবং একটি অনিশ্চয়তার ভাব কবিতার শেষ পর্যন্ত অক্ষুণ্ণই থেকেছে। তরণী এগিয়ে চলেছে, দিনের আলো নিবে আসছে, অন্ধকারে তরণী চালিকার হাসিটুকুও আর দেখা যাবে না, বাতাসে শুধু দেহসৌরভ ভেসে আসবে, উড়ন্ত কেশরাশি কবিকে স্পর্শ করবে। কবি তাতে আরও অধীর হয়ে উঠবেন, দেখবার ও কাছে পাওয়ার বাসনা আরও বাড়বে। রহস্যময়ী সুন্দরী সহযাত্রিণীর সেটাই যেন অভিপ্রায়—এমনি করেই তিনি কবিকে সৌন্দর্যের রহস্যলোকে পৌঁছে দেবেন।
Leave a comment