নিরাপদ মাতৃত্ব হলো একটি মেয়ের জীবনের প্রাপ্ত অধিকার। আমাদের দেশে অর্থাৎ বাংলাদেশে প্রতি বছর ২৮ শে মে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস পালন করা হয়। আমাদের দেশের মেয়েরা এখনো পুরোপুরি শিক্ষিত নয় যার কারণে নিরাপদ মাতৃত্ব তারা বোঝে না আর এর প্রধান কারণ হলো অশিক্ষিত পরিবারের ক্ষেত্রে একটি মেয়ে ১২ থেকে ১৩ বছর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়।

নিরাপদ মাতৃত্বের ক্ষেত্রে আমাদের দেশের আরেকটি প্রধান সমস্যা হল অনেক মেয়েরাই সময়ের আগে প্রসব করে নেয় অর্থাৎ সিজার করে ফেলে যার কারণে তাদের প্রি – টার্ম প্রসব হয় এবং এর ফলে অটিজম বাচ্চা জন্মগ্রহণ করে। আর নিরাপদ মাতৃত্বের ক্ষেত্রে আমাদের এই বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে।

আন্তর্জাতিক নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস

২৮ শে মে বিশ্ব মাতৃত্ব দিবস। প্রতিবছর এই তিনটি যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে পালন করা হয়ে থাকে। .১৯৯৭ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকার প্রতিবছরে দিবসটি পালন করে আসছে। ১৯৯৭ সালে ২৮ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস ঘোষণা করেন এবং ১৯৯৮ সাল থেকে বাংলাদেশ নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস পালন করা হয়। প্রসূতিকে সুস্থ রাখতে এবং নবজাতককে সুস্থ্য ও নিরাপদে রাখতে নিরাপদ মহাত্তিত্ব

নিশ্চিত করা প্রয়োজন । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মতে প্রতিবছর গর্ভধারণ ও গর্ভধারণ সংক্রান্ত কারণে মারা যায় প্রায় বারো ১২ হাজার নারী। সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুসারে বাংলাদেশ ২০২০ সালে প্রায় ৮৮৪ জন নারীর মৃত্যু হয়েছিল। তবে গত বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে তা কমে গিয়ে ৭৮৮ জনে নেমে এসেছে।

গর্ভকালীন সেবা কাকে বলে

একজন নারী গর্ভধারণের পর থেকে শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার আছে। শুধু মা নন তার গর্ভে বেড়ে ওঠা শিশুর যত্নের প্রয়োজন হয় এবং এই সময় যে সেবা পাওয়া যায় তাকে গর্ভকালীন সেবা বলা হয়। নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য শিশুর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা এবং গর্ভজনিত পুনঃ জটিলতা দেখা দিলে তার চিকিৎসা করা বা প্রতিরোধ করা। গর্ভকালীন যত্নের প্রধান লক্ষণ এক কথায় বলা যায় যে মায়ের স্বাস্থ্যের কোন ক্ষতি না করে পরিবার তথা সমাজ বা দেশের একটি সুস্থ শিশুর উপহার দেওয়া।

বাংলাদেশে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস

বাংলাদেশেও যথাযজ্ঞ মর্যাদার সাথে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস পালন করা হয়ে থাকে। ১৯৯৭ সাল থেকে বাংলাদেশে প্রতিবছর এই দিবস পালন করা হয়। এই জাতীয় দিবস ১৯৯৭ সালের ২৮ শে মে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস ঘোষণা করেন আর এই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৮ সাল থেকে বাংলাদেশে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস পালন করা শুরু হয়েছে।একটি জাতি সুস্থ ও সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে হলে প্রয়োজন নবজাতককে সুস্থ রাখা এবং সর্বোপরি প্রয়োজন নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করা।

বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে মাতৃ মৃত্যুহার

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বিবিএস এর হিসাব মতে ২০১০ সালে বাংলাদেশে প্রতি ১ লাখে মাতৃ মৃত্যুহার ছিল ১৯৪ জন। এক দশকে কমে তা নেমে এসেছে ১৬৫ জনে। তবে এখনো শহরের তুলনায় গ্রামে মাতৃ মৃত্যুর হার বেশি। যেমন এখনো গ্রামে মাতৃ মৃত্যুর হার প্রতি লাখে প্রায় ১৯১ জন এবং শহরে প্রায় ১২৩ জন।তবে প্রসবের ক্ষেত্রে শতকরা ১৫ জন সরকারি হাসপাতালে এবং শতকরা ৮৫ জনই বেসরকারি হাসপাতালে হয় হয়ে থাকে।

সরকারের স্বাস্থ্য তথ্যমতে ২০২০ সালে ৮৮৪ জন নারীর মৃত্যু হয়েছিল এবং ২০২১ সালে কমে তা আর ৭৮৮ জনে নেমে এসেছে। দেশে প্রান্তিক পর্যায়ে ইউনিয়ন, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, কমিউনিটি ক্লিনিক, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ধাত্রীবিদ্যা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী রয়েছে। এই সকল সেবায় মাত্র দু – একটি সন্তান প্রসব হয়। তবে সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতালে নানা ভোগান্তি পোহাতে হয় বলে অনেকেই চলে যান বেসরকারি হাসপাতালে। বর্তমানে বেসরকারি হাসপাতালে সিজারের মাধ্যমে সন্তান জন্মদানের সংখ্যা বেড়েছে।

মাতৃ মৃত্যুতে বাল্যবিবাহ

বাংলাদেশে মাতৃ মৃত্যুর আরেকটি প্রধান কারণ হলো বাল্যবিবাহ। কিন্তু বাংলাদেশ আইনে বাল্যবিবাহ দ্বন্দ্বনীয় অপরাধ। কিন্তু এখন পর্যন্ত গ্রামগঞ্জে মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিয়ের বছর পার না হতে তারা মা হয়ে যাচ্ছে। এরপরও মা হতে তাদের নানা প্রতিবন্ধকতা সহ্য করতে হচ্ছে অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে গ্রাম অঞ্চলে বেশি হয়ে থাকে। আর এর কোন কারণ হলো তারা দরিদ্র সীমার নিচে বসবাস করছে। গ্রামের মানুষকে প্রতিনিয়ত নানা কুসংস্কারের সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হয়। আর সচেতনতার অভাবে মায়ের মৃত্যু ঝুঁকিও অনেক বেড়ে যায়।

জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী মাতৃ মৃত্যুহার

জাতিসংঘের তথ্য মতে বাংলাদেশে ২০১৬ সালে ৩০ লাখ ৮৮ হাজার জীবিত শিশুর জন্ম হয়েছে আর বাংলাদেশ সরকারের জরিপ মতে বাংলাদেশে ১ লক্ষ শিশুর জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে প্রায় ১৮৬ জন মায়ের। বাংলাদেশ সরকার নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করতে বেশ কিছু কার্যক্রম হাতে নিয়েছে এবং প্রসূতি মায়ের দক্ষ সেবা নিশ্চিত করেছে এবং এই বিষয়টিকে সরকার অগ্রাধিকার দিয়েছে। বাংলাদেশে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা হলো ২০৩০ সালের মধ্যে মাতৃ মৃতহার

প্রতি লাখে ৭০ জনে নামিয়ে নিয়ে আসা। আর এই লক্ষে সরকার হাতে নিয়েছে বেশ কিছু কার্যক্রম। ২০১৯ সালে মাতৃ মৃত্যর হার ১ লাখে ১৭২ জন। গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মায়েদের জন্য মাতৃ সেবা নিশ্চিত করতে সরকার ৬ হাজার জনগোষ্ঠীর জন্য একটি করে কমিউনিটি স্বাস্থ্য সেবা ক্লিনিক এর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

বাংলাদেশে মাতৃ মৃত্যুর প্রধান কারণ

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৭ সালের ২৮ মে মাতৃত্ব দিবস ঘোষণা করেন এবং ১৯৯৮ সাল থেকে তা নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস হিসেবে সারা দেশব্যাপী পালন করা হয়ে থাকে। এরপর ও প্রতিবছর বাংলাদেশে অনেক নারী মা হতে গিয়ে মারা যায়। আর এইমাত্র প্রধান কারণ হলো-

  • বাল্য বিয়ে
  • ২০ বছরের নিচে সন্তান নেওয়া
  • প্রসবের পরবর্তী রক্তক্ষরণ
  • খিচুনি
  • বিলম্বিত প্রসব
  • ঠিকমতো প্রসব করতে না পারায় ইনফেকশন

নবজাতকের মৃত্যুর কারণ

বাংলাদেশে প্রতি মিনিটের জন্ম নেয় ২১টি শিশু আর এই হিসাবে বাংলাদেশে প্রতি বছরের শিশু জন্মগ্রহণ করে প্রায় ২০ লাখ। মাতৃ মৃত্যুর মতো আমাদের দেশে অনেক নবজাতকের মৃত্যু হয়। যে সকল কারণে বেশির ভাগ নবজাতকের মৃত্যু হয় তা হল-

    • ওজন কম নিয়ে জন্মগ্রহণ করা

 

    • প্রি ম্যাচিউর

 

    • জন্মের পর শ্বাস না নেওয়া

 

  • নাভিতে ইনফেকশন ইত্যাদি

মাতৃ মৃত্যুর হার কমানোর উপায়

মাতৃ মৃত্যু বাংলাদেশের মতো দরিদ্র এবং উন্নয়নশীল দেশের জন্য একটি সাধারণ সমস্যা ।কারণ এই দেশের শতকরা ৮০ ভাগ লোক কৃষি কাজ করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে এবং তারা স্বাস্থ্য সেবা সম্পর্কে অসচেতন। আর এর প্রধান কারণ হলো সঠিক শিক্ষার অভাব। নারীর মৃত্যুর হার কমাতে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে তা হল-

    • বাল্যবিবাহ রোধ করতে হবে

 

    • ১৮ বছর পূর্ণ না হলে বিয়ে না দেওয়া

 

    • মেয়েদের জননতন্ত্র পূর্ণতা না পাওয়া পর্যন্ত বিবাহ না দেওয়া

 

    • নারী হিসেবে সংসার পরিচালনার জন্য মানসিকতা গড়ে না ওঠা পর্যন্ত বিবাহ না
      দেওয়া

 

    • প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না হওয়া পর্যন্ত বিবাহ না দেওয়া

 

    • মাকে সর্বদা পরিষ্কার রাখা

 

    • মাকে পর্যাপ্ত সুষম খাবার খাওয়ানো

 

    • বিশ্রামও যত্নের ব্যবস্থা করা

 

    • শিশুর নাভির যত্ন নেওয়া

 

    • নিয়মিত টিকা দেওয়া

 

  • শিশুর খাদ্য হিসাবে প্রথম ৬ মাস মায়ের দুধ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা ইত্যাদি

ইসলামের দৃষ্টিতে যত্ন

ইসলামে প্রসূতি মা ও নবজাতকের যত্ন নেওয়ার ব্যাপারে জোরালো তাগিদ দেওয়া হয়েছে। গর্ভবতী মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয় পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। ধর্মীয় গোড়ামী ও শিক্ষার অভাবের কারণে গ্রাম অঞ্চলে মেয়েরা প্রতি বছর সন্তান ধারণ করে থাকে। আর এই কারণে দিন দিন রোগাক্রান্ত ও পুষ্টিহীন শিশুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। অথচ আমাদের সমাজে অপুষ্টি ও অযত্নের কারণেই মা ও নবজাতকের মৃত্যুর হার বাড়ছে।

প্রসবের পরে একজন নারীকে পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হয় কিন্তু গ্রাম অঞ্চলে এই বিশ্রামের সুযোগ থাকে না।মাতৃত্ব সেবা আরো বাড়াতে হবে এবং মাতৃ সেবার উন্নয়নের যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। মাতৃ সেবার জন্য জাতি, ধর্ম, বর্ণ পেশার সকল কিছু ভুলে দেশের সকল জনসাধারণকে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই নিরাপদ মাতৃত্ব সম্ভব।

প্রতিপাদ্য বিষয়

প্রতিবছরই বাংলাদেশ নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস পালন করা হয়ে থাকে এবং বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সংস্থা এই দিবস পালনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। প্রতিবছরই নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস পালনের প্রতিপাদ্য বিষয় নির্বাচন করা হয়ে থাকে। ২০২২ সালের প্রতিবাদ্য বিষয় হলো “শিশুর জীবন বাঁচাতে, স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যেতে হবে”। ২০২৩ সালের প্রতিবাদ্য বিষয় হলো -” গর্ভকালে চারবার সেবা গ্রহণ করি নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করি”।

শেষ কথা

নিরাপদ মাতৃত্ব এবং শিশুর যত্নই পারে টিকশই ও উন্নয়নশীল বাংলাদেশ গড়ে তুলতে। তাই আমাদের মাতৃত্ব সেবা আরো বাড়াতে হবে এবং মাতৃ সেবার উন্নয়নের যথার্থ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। আর এক্ষেত্রে দলমত, ধর্ম – বর্ণ সকল বিভেদ বলে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারি সংস্থার পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে বাল্য বিয়ে প্রতিরোধ করতে হবে এবং প্রসবকালীন সেবা নিশ্চিত করতে হবে এবং প্রসব পরবর্তী সেবা নিশ্চিত করতে হবে।