প্রশ্নঃ নিরপেক্ষ সৃষ্টিবাদ ও সাপেক্ষ সৃষ্টিবাদ কী? এদের পার্থক্য দেখাও। এ দু’টি মতবাদের মধ্যে কোনটিকে অধিক গ্রহণযােগ্য বলে মনে হয়?

অথবা, নিরপেক্ষ সৃষ্টিবদ ও সাপেক্ষ সৃষ্টিবাদ বলতে কী বুঝায়? সাপেক্ষ সৃষ্টিবাদ ও নিরপেক্ষ সৃষ্টিবাদের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় কর। এ দুটি মতবাদের মধ্যে তুমি কোনটিকে অধিক গ্রহণযােগ্য বলে মনে কর?

অথবা, নিরপেক্ষ সৃষ্টিবাদ ও সাপেক্ষ সৃষ্টিবাদ কী? উভয়ের মধ্যে বৈসাদৃশ্য নিরূপণ কর। এ দু’টি মতবাদের মধ্যে তুমি কোনটিকে অধিকতর গ্রহণযােগ্য বলে মনে কর?

ভূমিকাঃ দর্শনের ইতিহাস পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিচারে আমরা জগতের উৎপত্তি বিষয়ক দু’টি মতবাদ বেশ গুরুত্বপূর্ণরূপে পায়। এদের মধ্যে একটি বিবর্তনবাদ, অপরটি সৃষ্টিবাদ। ধর্ম সমর্থিত মতবাদ হচ্ছে সৃষ্টিবাদ এবং বিজ্ঞান ও দর্শন সমর্থিত মতবাদ হচ্ছে বিবর্তনবাদ। সৃষ্টিবাদ একটি অতিপ্রাকৃত সত্তা বিষয়ক মতবাদ। এ মতবাদ মনে করে যে স্রষ্টা তার কোনাে বিশেষ উদ্দেশ্যসাধনের জন্য কোনাে একটি নির্দিষ্ট সময়ে জগতের সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টিবাদ অনুযায়ী এক সময় এ বিশ্বজগতের কোনাে অস্তিত্ব ছিল না। কোনাে অতিপ্রাকৃত সত্তা তার কোনাে বিশেষ উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য এ জগত সৃষ্টি করেছেন দার্শনিক Thilly তার A history of philosophy গ্রন্থে বলেন, বিশ্বজগত বিভিন্ন আকার, প্রকৃতি এবং গতির অসংখ্য পরমাণু দ্বারা সৃষ্ট। অপরদিকে বিবর্তনবাদ অনুসারে, জগতের সৃষ্টি হয়েছে বিবর্তন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।

নিরপেক্ষ সৃষ্টিবাদঃ যে মতবাদ মনে করে যে জগতের অভ্যন্তর যাবতীয় উপাদান পরম স্রষ্টা কোনাে এক নির্দিষ্ট সময়ে শূন্য থেকে তার ইচ্ছাবলে সৃষ্টি করেছেন তাকে নিরপেক্ষ সৃষ্টিবাদ বলে। নিরপেক্ষ সৃষ্টিবাদে পরম সহ অস্তিত্বকে অনন্তকালের জন্য স্বীকার করে নেয়। কিন্তু বিশ্বজগতের অস্তিত্বকে অনন্ত বলে স্বীকার করা হয় না। এক সময় এ বিশ্বজগতের কোনাে কিছুই অস্তিত্বশীল ছিল না। কোনাে এক বিশেষ মুহূর্তে সর্বশক্তিমান এবং সর্বজ্ঞ স্রষ্টার ইচ্ছার এ বিশ্বজগতের সৃষ্টি হয়েছে। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে এ মতবাদের সমর্থনে অনেক যুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছে। দার্শনিক মার্টিনিউ এ মতবাদের জোর সমর্থক ছিলেন। এই মতবাদের সমর্থনকারীরা বলেন, যেহেতু ঈশ্বর এক পরিপূর্ণ সত্তা, সেহেতু তার ইচ্ছার অসাধ্য কিছু নেই। তাই শূন্য থেকে এই জগত সৃষ্টি করাটা তার পক্ষে অসম্ভব কিছু নয়। তাদের মতে, কোনাে পূর্ব অবস্থিত জড় বা বস্তু থেকে জগতের সৃষ্টি করাটা ঈশ্বরের স্রষ্টার পক্ষে অবমানকর বৈ কী?

সাপেক্ষ সৃষ্টিবাদঃ যে মতবাদ অনুসারে জগতের অভ্যন্তরস্থ পূর্বস্থিত উপাদান দ্বারাই স্রষ্টা এ জগত সৃষ্টি করেছেন, তাকে সাপেক্ষ সৃষ্টিবাদ বলে। সাপেক্ষ সৃষ্টিবাদ নিরপেক্ষ সৃষ্টিবাদের বিপরীত মতবাদ। এ মতবাদ নিছক শূন্য থেকে জগৎসৃষ্টির বিষয়টি স্বীকার করেনা। সাপেক্ষ সৃষ্টিবাদ অনুযায়ী সৃষ্টির প্রাথমিক পর্যায়ে জাগতিক উপাদানগুলাে ছিল এলােমেলাে ও বিচ্ছিন্ন। স্রষ্টা এসব বিশৃঙ্খল উপাদানককে সুসংগঠিত করে নিপুণ হাতে এ জগত সৃষ্টি করেছেন। সাপেক্ষ সৃষ্টিবাদে বলা হয় যে, স্রষ্টা জগতের উপাদান কারণ নয় বরং নিমিত্ত কারণ। অনন্তকাল ধরে স্রষ্টা ও জাগতিক উপাদানগুলাে সহাবস্থান করে আসছিল। সহাবস্থিত এ উপাদানগুলাের বিচ্ছিন্নতা ও বাস্তব অনুপযুক্ততা দেখে স্রষ্টা এগুলােকে উপযােগী করে তােলার চিন্তা করেন। আর এ চিন্তার অনিবার্য ফলশ্রুতিতে এ জগতের সৃষ্টি হয়েছে। এই মতবাদ মােতাবেক ঈশ্বরকে স্পষ্টত একজন স্থপতি বলা চলে। এই মতবাদ ধর্মের দ্বারা সমর্থিত না হলেও কতিপয় দার্শনিকদের দ্বারা সমর্থিত। যেমন প্লেটো মনে করেন, ঈশ্বর জড় থেকে জগত সৃষ্টি করেন, শাশ্বত ধারণার অনুকরণে জড়পিণ্ড থেকে জাগতিক বস্তু সৃষ্টি হয়ে থাকে।

নিরপেক্ষ সৃষ্টিবাদ ও সাপেক্ষ সৃষ্টিবাদের পার্থক্য বৈসাদৃশ্যসমূহঃ নিরপেক্ষ সৃষ্টিবাদ ও সাপেক্ষ সৃষ্টিবাদের মধ্যে নানাবিধ পার্থক্য / বৈসাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। নিম্নে নিরপেক্ষ সৃষ্টিবাদ ও সাপেক্ষ সৃষ্টিবাদের পার্থক্য-বৈসাদৃশ্য আলােচনা করা হলাে-

(১) নিরপেক্ষ সৃষ্টিবাদ অনুযায়ী স্রষ্টা শূন্য থেকে জগত সৃষ্টি করেছেন। অপরদিকে, সাপেক্ষ সৃষ্টিবাদ অনুযায়ী স্রষ্টা পূর্বস্থিত উপাদান থেকে জগত সৃষ্টি করেছেন।

(২) নিরপেক্ষ সৃষ্টিবাদ অনুযায়ী স্রষ্টা এ জগতের আদি কারণ। পক্ষান্তরে, সাপেক্ষ সৃষ্টিবাদ অনুযায়ী স্রষ্টা এ জগতের নিমিত্ত কারণ।

(৩) নিরপেক্ষ সৃষ্টিবাদে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, কালক্রমে এ জগত ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। অন্যদিকে সাপেক্ষ সৃষ্টিবাদে জগত ধ্বংসের ব্যাপারে স্পষ্টভাবে কিছু বলা হয় নি।

(৪) নিরপেক্ষ সৃষ্টিবাদ অনুযায়ী জগত সৃষ্টির পর স্রষ্টা এ জগত থেকে দূরে অবস্থান করছেন। অপরদিকে, সাপেক্ষ সৃষ্টিবাদ অনুযায়ী স্রষ্টা জগতের সম্পূর্ণ বাইরে ও থাকেন না, আবার সম্পূর্ণ ভিতরে ও থাকেন না।

(৫) নিরপেক্ষ সৃষ্টিবাদ অনুযায়ী জগত সৃষ্টির পূর্বে এখানে কোনাে উপাদান ছিল না। পক্ষন্তরে, সাপেক্ষ সৃষ্টিবাদে বলা হয় জগত সৃষ্টির পূর্বে এখানে বিশৃঙ্খল আকারে অনেক উপাদান বিদ্যমান ছিল।

(৬) নিরপেক্ষ সৃষ্টিবাদে কোনাে বিশেষ মুহূর্তের কথা উল্লেখ করা হয় নি। অপরপক্ষে সাপেক্ষ সৃষ্টিবাদের জগত সৃষ্টির একটি বিশেষ মুহূর্তের কথা বলা হয়।

(৭) নিরপেক্ষ সৃষ্টিবাদে স্রষ্টা ও জাগতিক উপাদানের সহাবস্থানের কথা স্বীকার করা হয় না। অপরদিকে সাপেক্ষ সৃষ্টিবাদ অনুযায়ী এক সময় স্রষ্টা ও জাগতিক উপাদানসূহ সহাবস্থান করেছে।

(৮) নিরপেক্ষ সৃষ্টিবাদ একত্ববাদী। পক্ষান্তরে, সাপেক্ষ সৃষ্টিবাদ এক ধরনের দ্বৈতবাদের সৃষ্টি করে।

(৯) নিরপেক্ষ সৃষ্টিতত্ত্বে বলা হয়, স্রষ্টা স্বীয় উদ্দেশ্যসাধনের জন্য এ জগত সৃষ্টি করেছেন। অন্যদিকে, সাপেক্ষ সৃষ্টিবাদে বলা হয় স্রষ্টা জাগতিক উপাদানগুলাের বিশৃঙ্খল লক্ষ্য করে এগুলাের সুসামঞ্জস্য রূপ প্রদানের লক্ষ্যে এ জগত সৃষ্টি করেছেন।

(১০) নিরপেক্ষ সৃষ্টিবাদ অনুযায়ী আকস্মিকভাবে এ জগতের সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে, সাপেক্ষ সৃষ্টিবাদ আকস্মিকতার কথা স্বীকার করে না।

(১১) নিরপেক্ষ সৃষ্টিবাদ অনুযায়ী জাগতিক বস্তুসমূহের উদ্ভব হয়েছে। অন্যদিকে, সাপেক্ষ সৃষ্টিবাদে বলা হয় জাগতিক বস্তুসমূহ অন্যদিকাল ধরে বিদ্যমান আছে।

যে মতবাদটি গ্রহণযােগ্যঃ সাপেক্ষ সৃষ্টিবাদে জাগতিক উপাদানগুলাের পূর্বস্থিত উপাদানগুলােকে চিরন্তন বলাই এক ধরনের দ্বৈতবাদী ধারণা উদ্ভব ঘটে। কিন্তু নিরপেক্ষ সৃষ্টিবাদ কোনাে প্রকার দ্বৈতবাদী ধ্যান-ধারণার জন্ম দেয় না। কাজেই সাপেক্ষ সৃষ্টিবাদের তুলনায় নিরপেক্ষ সৃষ্টিবাদকে গ্রহণ করাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায়, নিরপেক্ষ সৃষ্টিবাদ ও সাপেক্ষ সৃষ্টিবাদের মধ্যে বিভিন্ন পার্থক্য বিদ্যমান। নিরপেক্ষ সৃষ্টিবাদ অনুযায়ী ঈশ্বর শূন্য থেকে জগত সৃষ্টি করেছেন এবং বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ দ্বারা এটি সমর্থিত। ঈশ্বর সর্বশক্তিমান ও সর্বব্যাপী। এক বিশেষ মুহূর্তে তার ইচ্ছা হওয়ার সাথে সাথে জগত সৃষ্টি হয়। সাপেক্ষ সৃষ্টিবাদ অনুযায়ী ঈশ্বর একেবারে শূন্য থেকে জগত সৃষ্টি করেননি। তিনি জড় থেকে জগত সৃষ্টি করেছেন। এমত অনুসারে ঈশ্বর একজন প্রকৌশলী। নিরপেক্ষ সৃষ্টিবাদ ও সাপেক্ষ সৃষ্টিবাদের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও এদের উভয়েরই দর্শনে সবিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।