রাজ্যপাল রাজ্যের সর্বোচ্চ শাসক হলেও, প্রকৃত অর্থে তিনি নামসর্বস্ব বা নিয়মতান্ত্রিক শাসক। অঙ্গরাজ্যে প্রকৃত রাজনৈতিক প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রয়ােগ করেন মুখ্যমন্ত্রী ও তার মন্ত্রী পরিষদ।

সংবিধানের ১৫৩ নং ধারায় বলা হয়েছে, প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের জন্য একজন করে রাজ্যপাল থাকবেন, যিনি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হবেন। তবে এক বা একাধিক রাজ্যের জন্য একজন করে রাজ্যপাল নিযুক্ত হতে পারেন।

কেউ কেউ রাজ্যপালকে রাজ্য প্রশাসনের একজন প্রকৃত ক্ষমতাসম্পন্ন শাসক হিসেবে প্রতিপন্ন করে। কিন্তু এই ধারণা ঠিক নয়। রাজ্যপাল রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষে অবস্থান করলেও রাজ্যপালের ভূমিকা হল আনুষ্ঠানিক বা নিয়মতান্ত্রিক।

গণপরিষদের অন্যতম সদস্য সংবিধান-প্রণেতা ড. বাবাসাহেব আম্বেদকর বলেছিলেন যে, রাজ্যপালের কোনাে ক্ষমতা ও কাজ নেই, তিনি মন্ত্রীপরিষদের পরামর্শ মেনে চলতে বাধ্য।

অপরদিকে কে এম মুন্সী বলেছিলেন যে, রাজ্যপাল মন্ত্রীসভাকে উপেক্ষা করবেন না, তিনি গ্রেট ব্রিটেনের রাজা-রানির মতাে ভূমিকা পালন করবেন, রাজ্যপালের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা থাকলেও তা কোনােক্রমেই রাজ্যে দায়িত্বশীল শাসন ব্যবস্থার পরিপন্থী হবে না।

এইজন্যই রাজ্যের প্রকৃত শাসক হলেন মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন রাজ্য মন্ত্রীসভা বা ক্যাবিনেট। মন্ত্রীসভার পরামর্শকে অনুসরণ করেই রাজ্যপালকে তার ক্ষমতা প্রয়ােগ করতে হয়। নিয়মতান্ত্রিক শাসক হিসেবে রাজ্যপালকে প্রতিপন্ন করতে যে যুক্তিগুলি তুলে ধরা হয়, তা নিন্নে সূত্রাকারে লিপিবদ্ধ করা হল—

(১) মন্ত্রীসভা হল প্রকৃত শাসক: যুক্তরাষ্ট্রীয় ভারতের অঙ্গরাজ্যগুলো কেন্দ্রের মতােই সংসদীয় গণতন্ত্র সম্মত মৌলিক রীতি পদ্ধতি ও প্রকরণগুলি গৃহীত হয়েছে। রাজ্যে প্রবর্তিত সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় নিয়মতান্ত্রিক প্রধানের ভূমিকা গ্রহণ করে থাকেন রাজ্যপাল এবং প্রকৃত শাসকের ভূমিকায় থাকে মন্ত্রীসভা। বলাবাহুল্য, এই মন্ত্রীসভার পরামর্শ অনুসারে রাজ্যপাল কে তার শাসনকার্য পরিচালনা করতে হয়।

(২) রাজ্য মন্ত্রী পরিষদের পরামর্শ অনুযায়ী ক্ষমতা প্রয়ােগ: কেন্দ্রের মতাে রাজ্যে সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় রাজ্য মন্ত্রী পরিষদের পরামর্শক্রমে রাজ্যপালের নামে রাজ্যের শাসনকার্য পরিচালিত হয়। সংবিধানের ১৬৩ (১) নং ধারায় বলা হয়েছে, স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা ছাড়া অন্যান্য ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে রাজ্যপাল কে সহযােগিতা ও পরামর্শদানের জন্য মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন একটি মন্ত্রীপরিষদ থাকবে।

(৩) রাজ্যপালের আনুষ্ঠানিক নিয়ােগ ক্ষমতা: সংবিধানের ১৬৪ (১) নং ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাজ্যপাল মুখ্যমন্ত্রী-সহ অন্যান্য মন্ত্রী নিযুক্ত করতে পারেন। কিন্তু এক্ষেত্রে রাজ্যপাল নিতান্তই নিয়মতান্ত্রিক ক্ষমতার অধিকারী। রাজ্যের মন্ত্রীসভাকে যৌথভাবে বিধানসভার কাছে দায়বদ্ধ থাকতে হয় বলেই রাজ্যপাল স্বাভাবিক অবস্থাতেও বিধানসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতাকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নিয়ােগ করে থাকেন এবং তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী অন্যান্য মন্ত্রীদের নিয়ােগ করে থাকেন। যদিও তার এই ক্ষমতা আনুষ্ঠানিক ক্ষমতা বলে বিবেচিত হয়।

(৪) রাজ্য মন্ত্রীপরিষদের দায়িত্বশীলতা: সংবিধানের ১৬৪ (২) নং ধারা অনুযায়ী রাজ্য মন্ত্রীপরিষদকে তার সম্পাদিত কার্যাবলির জন্য বিধানসভার নিকট দায়বদ্ধ থাকতে হয়। এর থেকে বােঝা যায় যে রাজ্যপাল নয়, মন্ত্রীপরিষদই হল প্রকৃত শাসক। কারণ মন্ত্রীপরিষদকে তার কার্যাবলির জন্য রাজ্যপালের নিকট কখনােই দায়বদ্ধ থাকতে হয় না।

(৫) রাজ্যের মন্ত্রীপরিষদ হল প্রকৃত কর্ণধার: রাষ্ট্রপতি রাজ্যপালকে মনােনয়ন করেন বলেই রাজ্যপাল জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচিত হন না। অপরদিকে সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতেই প্রকৃত ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে। মন্ত্রীরা হলেন জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি। এর জন্যই সংবিধান-প্রণেতারা রাজ্যপাল কে নিয়মতান্ত্রিক শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

(৬) মন্ত্রীসভা বাতিল করা সঠিক পদক্ষেপ নয়: রাজ্যপাল যদি রাজ্যের মন্ত্রীসভাকে বাতিল করার ক্ষেত্রে বিধানসভার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন, তাহলে সেটি সঠিক পদক্ষেপ বলে বিবেচিত হবে না। সংবিধানের নির্দেশ অনুযায়ী রাজ্যপালকে সাহায্য ও পরামর্শদানের জন্য একটি মন্ত্রীপরিষদ থাকবে এবং এই মন্ত্রীপরিষদের নির্দেশ রাজ্যপাল কে সর্বদা মেনে চলতে হয়। তাই এখানে রাজ্যপাল নিয়মতান্ত্রিক শাসক বলে বিবেচিত হন।

(৭) প্রশাসনিক ক্ষেত্রের সিদ্ধান্ত কার্যত মন্ত্রীসভাই গ্রহণ করে: সংবিধানের ১৬৭ (১) নং ধারায় বলা হয়েছে যে, রাজ্য মন্ত্রীপরিষদ কর্তৃক গৃহীত যাবতীয় প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত সম্পর্কে রাজ্যপালকে জানানাে মুখ্যমন্ত্রীর কর্তব্য’, আবার রাজ্যপাল নিজে প্রশাসনিক কিংবা আইন প্রণয়ন সম্পর্কে যে-কোনাে প্রস্তাব জানতে চাইলে মুখ্যমন্ত্রী তা জানাবেন [ ১৬৭ (২) নং ধারা ]। এর থেকে প্রমাণিত হয় যে, প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারী হল রাজ্য মন্ত্রীপরিষদ। এক্ষেত্রে রাজ্যপাল কোনােরূপ ভূমিকা পালন করেন না।


(৮) স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা খুশিমতাে ব্যবহার করা যায় না: রাজ্যপাল তাঁর খুশিমতাে যে-কোনাে ক্ষেত্রে তাঁর স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়ােগ করতে পারেন না। যদি তিনি এই ক্ষমতা যখন-তখন প্রয়ােগ করেন তাহলে সেই ব্যবস্থা একনায়কতন্ত্র বলে বিবেচিত হবে। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় ব্যক্তিগত বা স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতার ধারণা সম্পূর্ণরূপে অচল। ড. দুর্গাদাস বসু বলেছেন, সংবিধানের উল্লিখিত ক্ষেত্র ছাড়া রাজ্যপাল স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়ােগ করতে পারেন না। ড. বাবাসাহেব আম্বেদকরের মতে, রাজ্যপালের স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা দায়িত্বশীল সংসদীয় শাসনব্যবস্থায় কোনােরূপ বাধার সৃষ্টি করে না।

(৯) রাজ্যপালের নির্বাচিত মন্ত্রিসভা বাতিল করার ক্ষমতা গণতান্ত্রিক: আইন অনুসারে মন্ত্রীসভাকে বাতিল করার ক্ষমতা রাজ্যপালের আছে। কিন্তু তার এই ক্ষমতা মূলত নিয়মতান্ত্রিক ক্ষমতা।

রাজ্যপালের পদমর্যাদা

রাজ্যপালের প্রকৃত ক্ষমতা ও পদমর্যাদা সম্পর্কিত বিষয়টি হল একটি বহু বিতর্কিত বিষয়। এ বিষয়ে সাংবিধানিক বিধানগুলি অস্পষ্ট। সুপ্রিমকোর্ট এ বিষয়ে কোনাে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেনি। এক্ষেত্রে স্মরণ করা দরকার যে, রাজ্যের শাসন বিভাগীয় প্রধান হিসেবে রাজ্যপালের ভূমিকা নিতান্তই নিয়মতান্ত্রিক। রাজ্যপালের ভূমিকা সম্পর্কে জওহরলাল নেহরুর একটি মন্তব্য উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি বলেছিলেন, জনসাধারণের সঙ্গে সংযােগ রক্ষা করা এবং তাদের সন্তুষ্ট রাখা ছাড়া রাজ্যপাল আর কোনাে কার্য সম্পাদন করতে পারেন না।