নিয়ন্ত্রণ পরিধি (Span of Control): নিয়ন্ত্রণ পরিধি প্রশাসনিক সংগঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি। নিয়ন্ত্রণ পরিধি প্রশাসনের পবিত্র ও অলঙ্ঘনীয় নীতি। একজন প্রশাসক যতজন অধস্তন ব্যক্তি বা যতগুলো কাজের ইউনিটকে ব্যক্তিগতভাবে পরিচালনা করতে পারেন নিয়ন্ত্রণ পরিধি বলতে তার সংখ্যাকে বুঝায়। একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার পক্ষে কতজন লোকের কাজ তদারক করা সম্ভব, তা নিয়ন্ত্রণ পরিধি বা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপকতার নীতির মাধ্যমেই জানা যায়। ডিমোক ও ডিমোক (Dimock and Dimock)- বলেছেন, “The span of control is communication contacts between the chief executive of an enterprise and his principle fellow officers.” অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণ পরিধি বা স্প্যান অব কন্ট্রোল বলতে কোন সংগঠনের প্রধান নির্বাহী কর্তা এবং তার প্রধান সহযোগী কর্মকর্তাদের মধ্যকার প্রত্যক্ষ, স্বাভাবিক যোগাযোগ সূত্রাদির সংখ্যা ও আওতাকেই বুঝায়।
ডিমোক প্রদত্ত বক্তব্যটি মূলত ‘মনোযোগের পরিধি’ ( Span of Attention) নীতির সাথে সম্পর্কযুক্ত। ভি. এ গ্রাইকিউনাস (V. A Graicunas) নিয়ন্ত্রণের পরিধিকেই সার্থকভাবে ‘মনোযোগের পরিধি’ বলে উল্লেখ করেছেন। মানুষের সামর্থ্যের একটা সীমা আছে এবং যদি গুরুত্বহীনভাবে প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড তদারক করা হয় তবে কতকগুলো অসন্তোষজনক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে-যার পরিণতিও হয় অকল্যাণকর। ভি. এ. গ্রাইকিউনাসের মতে, “একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা স্বাভাবিকভাবে পাঁচজন অধস্তন কর্মচারীর কাজ তদারক করতে পারেন। যাদের কাজ পরস্পর সংযুক্ত এমন পাঁচ বা বেশির পক্ষে ছয় জনের চেয়ে বেশি সংখ্যক অধস্তন কর্মচারীর কাজ কোন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাই তদারক করতে পারেন না।”
আবার কেউ কেউ এ নিয়ন্ত্রণ পরিধিকে তিন জনের ক্ষেত্রে সীমিত করেন। কেউ কেউ একে সাত বা ততোধিক ব্যক্তির ক্ষেত্রে সীমিত রাখেন। যদিও নিয়ন্ত্রণাধীন কর্মচারীর সংখ্যা সম্পর্কে কখনও মতৈক্য দেখা যায় না। তথাপি একটা ব্যাপারে সাধারণ মতৈক্য রয়েছে যে, নিয়ন্ত্রণাধীন কর্মচারীর সংখ্যা যত কম হবে, নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা তত সফলতার সাথে তার কর্ম সম্পাদন করতে সক্ষম হবেন। ‘নিয়ন্ত্রণের পরিধি’র সত্যিকার মাত্রা কতখানি তা নিয়ে প্রশাসন বিষয়ক লেখকদের মধ্যে মতবিরোধের অন্ত নেই। স্যার আয়ন হ্যামিলটন (Sir Ian Hamilton) তার সামরিক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বলেছেন, এর সংখ্যা ৩ থেকে ৪ মাত্র। এল আরউইক (L. Urwick) আরও বেশি সংখ্যার কথা বলেছেন। তার মতে, “অধস্তনদের কাজ যখন পরস্পরের সাথে যুক্ত তখন কোন তত্ত্বাবধায়ক সরাসরি ৫ বা ৬ জনের বেশি অধস্তনের কাজ তদারক করতে পারেন না । যেখানে কাজ নির্ঘণ্টমাফিক বা ধরাবাঁধা নিয়মের সেখানে সংখ্যা বেড়ে যায়। তখন নিয়ন্ত্রণের পরিধি দাঁড়ায় ৮০ থেকে ১২।”
লর্ড হলডেন (Lord Haldane) ও গ্রাহাম ওয়ালাস (Graham Wallace) মনে করেন যে, মাত্রাতিরিক্ত ধাপের সম্মুখীন না হয়ে একজন প্রধান কার্যনির্বাহী ১০ থেকে ১২ জন অধস্তনের ঐ বছর কাজ তদারক করতে পারেন। ১৯৩৭ সালে বিভিন্ন দেশে জরিপ চালিয়ে ওয়ালাস দেখেছেন, জাপানে প্রধান শাসকের (Chief executive) অধীনে ১৩টি দফতর (Department) কানাডা, জার্মানি ও ইতালিতে ১৪টি দফতর, ফ্রান্সে ১৭টি দফতর, রাশিয়াতে ১৯ ও ২০টি দফতর, ইল্যান্ডে ২৫টি দফতর ও যুক্তরাষ্ট্রে ৬০টি দফতর কাজ করেছিল। তত্ত্বাবধানে ন্যস্ত দফতরের সংখ্যা বিভিন্ন ধরনের হওয়া সত্ত্বে ও কোথাও প্রশাসন ভেঙ্গে পড়তে দেখা যায় নি।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, প্রশাসন তত্ত্বে বা বাস্তব অনুশীলনে কোথাও নিয়ন্ত্রণের পরিধির সংখ্যাটি কত তা স্থির নিশ্চিত বা সঠিক করে দেয়া হয় নি । কেউ কেউ একে সীমিত রাখতে চেয়েছেন ৩ জন ব্যক্তিতে, কেউ কেউ ৭ জন ব্যক্তিতে আবার কেউ কেউ তাকে ব্যাপ্ত করেছেন ২০ জন ব্যক্তিতে কেউবা তদ্রূপ অন্য কোন সংখ্যায়। কিন্তু সঠিক সংখ্যাটি কত এ ব্যাপারে সর্বজনীন মতৈক্য কিছু নেই। তবে সাধারণ একটি মতৈক্য রয়েছে। যেগুলো পর্যালোচনার ব্যাপার। প্রথমত, সকলেই স্বীকার করেন যে, তত্ত্বাবধানের সকল স্তরেই নিয়ন্ত্রণের একটি পরিধি রয়েছে। পরিধি মাত্রাতিরিক্ত বাড়লে নিয়ন্ত্রণ ভেঙ্গে পড়বার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়।
এ প্রসঙ্গে ভি. এ. গ্রাইকিউনাস (V. A. Graicunas)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে এল. আরউইক (L. Urwick) উল্লেখ করেন যে, “কোন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার পাঁচজন অধস্তনের স্থলে অধস্তন ছয়জন করা হলে অধস্তনের সহায়তা মাত্র ২৩% অর্জন করা যায় কিন্তু তত্ত্বাবধান বৃদ্ধি পায় ১০০%-এরও উপরে।” এর কারণ হলো শুধু অধস্তনদেরই তদারক করতে হয় না, অধিকন্তু তাদের সাথে কর্মকর্তার এবং তাদের পারস্পরিক সম্পর্কজনিত সামগ্রিক বিষয়টিকে তত্ত্বাবধান করার দরকার পড়ে। এর ফলে দেখা যায় যে অধস্তন ব্যক্তির সংখ্যা যখন গাণিতিক ক্রমনিয়মে বাড়ে তখন কর্মসম্পর্কের বুনট (Network)-এর জটিলতা জ্যামিতিক নিয়মে বেড়ে যায়। তাই নিয়ন্ত্রণের পরিধি বিশ্বজনীনভাবে থাকলেও তার মাত্রাটি সঠিকভাবে শনাক্ত করা মুশকিল ৷
বস্তুত প্রশাসনিক সংগঠনের ক্ষেত্রে একটি সাধারণ পথ-নির্দেশক নীতি হিসেবে ‘নিয়ন্ত্রণ-পরিধি নীতির উপযোগিতা রয়েছে। অপরদিকে, নিয়ন্ত্রণ-পরিধিকে মাত্রাতিরিক্তভাবে সীমিত করার মধ্যে অনিষ্টের বীজ নিহিত রয়েছে। যেমনঃ সেখানে মুষ্টিমেয় কর্মচারীদের পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদারক করার ঝুঁকি রয়েছে। ফলে অধস্তন কর্মকর্তাদের অনুপ্রেরণাদানে বা তাদের সামর্থ্যকে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগানোর ব্যাপারে ব্যর্থতা দেখা দেয়। নিয়ন্ত্রণ-পরিধি সঙ্কোচনের ফলে ‘চেইন অব কম্যাণ্ড’ বা ‘আদেশের শৃংখল’ দীর্ঘ হয়ে পড়তে পারে।” হাডসন (Hudson) বলেন, “On the other hand, there are dangers, inherent in excessively limited spans of control, such as, the risk of detailed supervision of the few reporting, the resultant failure to stimulate subordinates or to fully use the capacities of them. It is possible also that short spans of control mean long chains of command.”
আসল কথা হচ্ছে, অপরিবর্তনীয় কোন নিয়ন্ত্রণ পরিধি থাকতে পারে না। অনেক পরিবর্তিত বা বিভিন্নধর্মী উপাদানের উপর এর পরিধি নির্ভর করে। এ সকল উপাদানগুলো হলো তত্ত্বাবধায়কের ব্যক্তিত্ব, সংগঠনের ভূমিকার বিভিন্নমুখীতা, সংগঠনের বয়স, সংগঠনের ঐতিহ্য ও পারিপার্শ্বিকতা, অধস্তনদের মেধা ও যোগ্যতা। স্থান (Space) নামক উপাদানও পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটাতে পারে। একটি ভবনে বা একই স্থানে সকল দপ্তর অবস্থিত কিনা অথবা বহুস্থান ও বহুসংখ্যক ভবনে দপ্তরগুলো বিক্ষিপ্ত কিনা তাও পরিধির আয়তনকে প্রভাবিত করে। এ প্রসঙ্গে আরউইক (Urwick) প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান এবং কর্মকর্তার নিকট প্রবেশাধিকার (access) এর মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করেছেন। অন্য কথায় একজন অফিসার প্রত্যক্ষভাবে খুবই সীমিত সংখ্যক ব্যক্তির উপর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান রাখতে পারে। তবে অফিসার বৃহত্তর সংখ্যক অধস্তনকে তার কাছে আসতে দিয়ে সংগঠনে নমনীয়তা প্রবর্তন করতে পারেন।
ভি. এ. গ্রাইকিউনাস (V. A. Graicunas) কর্মচারী তত্ত্বাবধানের পরিসর নির্ণয়ের উদ্দেশ্যে একটি ফর্মূলা ব্যবহার করেছেন।১৬ এ ফর্মূলা অনুসারে যখন কোন ব্যক্তিকে কিছুসংখ্যক অধস্তন কর্মচারীর কাজ তদারক করতে হয়, তখন কেবল তাদের প্রত্যেককে নিজ নিজ ভাবে তদারক করলেই চলবে না। এ ক্ষেত্রে তাকে তাদের মধ্যকার আড়াআড়ি সম্পর্ক এবং গোষ্ঠী সম্পর্ককেও তদারক করতে হয়। উদাহরণ স্বরূপ, যদি ‘ক’-এর দুজন অধস্তন কর্মচারী ‘খ’ এবং ‘গ’ থাকে তবে তাকে নিম্নোক্ত সম্পর্কসমূহের প্রতি দৃষ্টি দিতে হবেঃ
১। উক্ত ব্যক্তি এবং ‘ক’-এর মধ্যে এবং উক্ত ব্যক্তি ও ‘খ’-এর মধ্যে প্রত্যক্ষ এক সম্পর্ক (২টি সম্পর্ক)
২। উক্ত ব্যক্তি ও ‘ক’-‘খ’-এর এবং ‘খ’-এর মধ্যে এবং উক্ত ব্যক্তি ও ‘খ’-‘গ’-এর মধ্যে প্রত্যক্ষ গোষ্ঠী সম্পর্ক। (২টি সম্পর্ক)
৩। ‘ক’-এর সাথে ‘খ’-এর এবং ‘খ’-এর সাথে ‘ক’-এর আড়াআড়ি সম্পর্ক। (২টি সম্পর্ক)
এভাবে দেখা যাচ্ছে যে, এ ক্ষেত্রে সর্বমোট সম্পর্কের সংখ্যা হলো ছয়টি। এটা হতে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, পদসোপানভিত্তিক সংগঠনে নিয়ন্ত্রণ পরিধির উপস্থিতি কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না এবং এটাকে সম্পূর্ণরূপে লঙ্ঘন করাও সম্ভব নয়।
Leave a comment