প্রশ্নঃ নিয়ন্ত্রণ পরিধির উপাদানগুলো আলোচনা কর। 

নিয়ন্ত্রণ পরিধির উপাদান (Factors of Span of Control): নিয়ন্ত্রণ পরিধির কোন অপরিবর্তনীয় বা অলঙ্গনীয় সীমারেখা থাকতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে এটি কতকগুলো বিশেষ উপাদান দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। এগুলো নিচে উল্লেখ করা হলোঃ

(ক) কাজের প্রকৃতি (Nature of Work): কাজের প্রকৃতি বলতে বুঝানো হয়, কোন ধরনের কাজকে তদারক হবে তাকে। অভিন্ন প্রকৃতির কাজ হলে একজন কর্মকর্তা অধিক সংখ্যক অধস্তনের কাজ তদারক করতে সক্ষম। একজন ঊর্ধ্বতন পদের ইঞ্জিনিয়ার তাঁর অধীনস্থ অনেকজন ইঞ্জিনিয়ারের কাজের তদারক ও তত্ত্বাবধান করতে পারেন। কিন্তু অধস্তনদের কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ শিক্ষাবিদ হলে ঊর্ধ্বতনের পক্ষে কাজ তদারক করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তদারকির সময় এক ধরনের কাজ থেকে দৃষ্টি বা মনোযোগ সরিয়ে নিয়ে অন্য ধরনের কাজে মনোনিবেশ করার জন্য যে মানসিক প্রস্তুতি নিতে হয় তাতে নিয়ন্ত্রণের পরিধি খাটো হয়ে পড়ে। অভিজ্ঞতার বাইরের দায়িত্বপূর্ণ কাজ অপেক্ষা নিজের জ্ঞাত ধরাবাঁধা কাজ তদারক করা সহজ সফলতাও সেখানে সহজে লাভ করা যায়।

(খ) নেতার ব্যক্তিত্ব (Personality of Leader): সংগঠনের প্রশাসকের নেতৃত্ব প্রদানের গুণাবলি থাকা একান্ত জরুরি। তত্ত্বাবধায়কের ব্যক্তিত্ব ও গুণগত উৎকর্ষতা বা শ্রেষ্ঠত্বের উপরে নিয়ন্ত্রণের সফলতা অনেকাংশে নির্ভর করে। তত্ত্বাবধায়ক নেতা যদি বিচক্ষণ, বুদ্ধিমান, সপ্রতিভূ, কর্মঠ ও দৃঢ় ব্যক্তিত্বের অধিকারী হন তবে তিনি বহুসংখ্যক লোককে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করতে সক্ষম হবেন। কিন্তু তদারককারী নেতার মধ্যে যদি এসব গুণের অভাব থাকে এবং তিনি দুর্বল ও নির্বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি হন তাহলে তিনি কার্যকরভাবে খুব কম সংখ্যক লোককেও তত্ত্বাবধান করতে ব্যর্থ হবেন। তবে উল্লেখ্য যে, তত্ত্বাবধায়কের কাজ কতটা সহজ বা কতটা কঠিন হবে, তা নির্ভর করে নিয়ন্ত্রিত অধস্তনরা কতটুকু প্রতিভা ও যোগ্যতাসম্পন্ন তার উপর। অনেক সময় কম মেধা ও বুদ্ধিসম্পন্ন কর্মচারীদেরকে কোন বিষয়ে তালি। দেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। সহজে কোন বিষয়ে তাদেরকে শেখানো সম্ভব হয় না। সে ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক আরো ঘনিষ্ঠভাবে তার অধস্তনদের তদারক কার্য সম্পাদন করবেন। অর্থাৎ তদারককারী নেতার ব্যক্তিত্ব বলতে বুঝায় ঊর্ধ্বতন ও অধস্তন কর্মচারীর পেশাগত ও ব্যক্তিগত যোগ্যতাকে এবং এটা তদারককারীর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার পরিধিকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে।

(গ) সংগঠনটির স্থায়িত্ব সময় (Permanancy Time of Organization):

সংশ্লিষ্ট সংগঠনের স্থায়িত্বকালও তদারককারীর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার সীমাকে প্রভাবিত করে। প্রতিষ্ঠান যদি বহুদিনের পুরনো হয় তবে সেই প্রতিষ্ঠানের তদারক ও তত্ত্বাবধান সহজতর হয় এবং নিয়ন্ত্রণের পরিধিও বৃদ্ধি পায়। কোন সুপ্রতিষ্ঠিত সংগঠনে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দ্রুততার সাথে অধস্তন কর্মীদের কাজ তদারক করতে পারেন। কারণ এরূপ সংগঠনের কতকগুলা সুনির্দিষ্ট পরীক্ষিত-নিরীক্ষিত কর্মপদ্ধতি থাকে এবং সেখানে যোগ্য ব্যক্তিগণ যোগ্যস্থানে নিযুক্ত থাকেন। কোন নতুন সংগঠনের সর্বদা নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি হতে থাকে।নতুন সমস্যাগুলোর সমাধানের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ক্রমাগত প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়৷

(ঘ) সংগঠনের শাখাগুলোর অবস্থান (Location of the Organizational Units): নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার পরিধি নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্থানগত উপাদানের গুরুত্ব অপরিসীম। তত্ত্বাবধায়কের আশেপাশে বা একই ভবনে যদি প্রশাসনিক অফিসগুলো অবস্থিত হয় তবে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার পক্ষে সহজে অনেক বেশিসংখ্যক অধস্তনের কাজ তদারক করা সম্ভব হয়। এর অন্যথা হলে তত্ত্বাবধায়কের পক্ষে সাফল্যের সাথে কর্ম সম্পাদন করা কঠিন হয়ে পড়ে। অধস্তনরা ঊর্ধ্বতনের অভিজ্ঞ দৃষ্টির সামনে না থাকলে তাদের কাজে যেমন গলদ থেকে যায় তেমনি অনেক গলদ তত্ত্বাবধায়কের দৃষ্টিও এড়িয়ে যায়। সংগঠনের শাখাগুলোর অবস্থান প্রসঙ্গে আরউইক (Urwick) “প্রত্যক্ষ তদারক’ (Direct supervision) এবং ‘বস’-এর কাছে ‘প্রবেশাধিকার (access)-এর মধ্যে যে পার্থক্য নির্দেশ করেছেন, তাও বিশেষভাবে লক্ষণীয়। অর্থাৎ যখন কোন প্রশাসনিক কর্মকর্তা কেবল সীমিত সংখ্যক ব্যক্তিগণের কাজের উপরই তদারক চর্চা করতে পারেন, তখন তিনি কিছু বেশি সংখ্যক অধস্তন কর্মচারীকে তার নিকট ‘প্রবেশ লাভের’ অনুমতি দিয়ে সংগঠনের মধ্যে নমনীয়তা আনতে পারেন।

প্রশাসনিক সংগঠনের মূল দিকনির্দেশক সূত্র হিসেবে নিয়ন্ত্রণ পরিধির নীতি অত্যন্ত উৎকৃষ্ট। কিন্তু এ সূত্রকে গাণিতিক ভাষায় যেমন উত্থাপন করা যায় না, তেমনি শিক্ষাদানেরও কোন উপায় নেই। অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণ পরিধি অনমনীয়ভাবে প্রয়োগ করার কোন পথ নেই। তবে উপরোক্ত চারটি কার্যকারণের ভিত্তিতেই নিয়ন্ত্রণের পরিধি নির্ধারিত হয়।

অবশ্য নিয়ন্ত্রণের পরিধি সম্পর্কিত ধারণাসমূহ সাম্প্রতিককালে অনেক সংশোধিত ও পরিবর্তিত হয়েছে। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রাদির ক্রমবর্ধমান ব্যবহার, তথ্য আদান-প্রদানের আমূল পরিবর্তন এবং বিশেষজ্ঞদের ক্রমবর্ধমান ভূমিকা এ পরিবর্তনের একমাত্র প্রধান কারণ। যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সহজ ও সরল করা, সংবাদ আদান-প্রধান প্রক্রিয়া সহজীকরণ ও ত্বরিত গতিসম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে স্বয়ংক্রিয় ও যান্ত্রিক পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে। করণিক কাজের (Clerical work) বোঝা হ্রাস ও দীর্ঘসূত্রতা পরিহার করার উদ্দেশ্যে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রাদি ও যান্ত্রিক প্রক্রিয়াসমূহের ব্যবহার ক্রমশ বেড়েই চলছে। হিসাব গণনা ও হিসাব রক্ষণ, টেবুলেশন, বাছাই বা সর্টিং ও কম্পিউটেশন কাজ প্রভৃতির ক্ষেত্রে যন্ত্রাদির ব্যবহারের প্রধান উদ্দেশ্য হলো রুটিন মাফিক ও ক্রমশ সম্প্রসারণ লাভকারী কার্যাদি সম্পন্ন করা। সংবাদ তথ্য সংরক্ষণ করা, সংশ্লিষ্ট তথ্যাদি সমন্বিত করা, সুপ্রতিষ্ঠিত মানদণ্ড অনুযায়ী এসব তথ্য বিশ্লেষণ করা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষেত্রে এ সকল যন্ত্র উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে।

বস্তুত অটোমেশন (Automation) যন্ত্রাদির ব্যবহার রুটিন মাফিক কাজের ও করণিক কাজের বোঝা সাম্প্রতিক সময়ে পূর্ব থেকে অনেক কমেছে। বিদ্যুৎ চালিত অটোমেশন যন্ত্ৰসমূহ প্রশাসকগণকে অত্যন্ত দ্রুততার সাথে বহুসংখ্যক সংশ্লিষ্ট ও সঠিক উপাত্ত বা ডাটাসমূহ সরবরাহ করতে সাহায্য করে থাকে। এরূপ সুবিধার কারণে সাম্প্রতিক কালে প্রশাসকগণ পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি সংখ্যক ইউনিটের কাজকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হচ্ছেন। তাছাড়া অটোমেশন যন্ত্রাদির ব্যবহারের ফলে যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থার কাজ সহজ ও দ্রুতগতিতে সম্পন্ন হচ্ছে। ফলে দূরত্ব ও সময়ের ব্যবধানও কমে গেছে বহুলাংশে এবং সদর দফতর ও মাঠপর্যায়ের মধ্যকার সম্পর্কের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ পরিধি প্রসার লাভ করছে।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, বর্তমান সময়ে সরকারি প্রশাসনের ক্ষেত্রে পেশাদার বিশেষজ্ঞ ও টেকনিশিয়ানদের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধিলাভ করছে। এর ফলে সেখানে নিয়ন্ত্রণ-পরিধি প্রভাবিত হয়েছে। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে এরূপ শ্রেণীর ব্যক্তিগণের আবির্ভাবের ফলে কতকগুলো পরিণতির সৃষ্টি হয়েছে। প্রথমত, বিশেষজ্ঞ ও টেকনিশিয়ানগণ নিজেদের বিশেষ জ্ঞান ও দক্ষতা সম্পর্কে সচেতন এবং তারা তাদের স্ব স্ব বিশেষ কার্যক্ষেত্রে অন্যান্যদের হস্তক্ষেপ মেনে নিতে চান না। দ্বিতীয়ত, তারা সংগঠনের ভিতরকার ঊর্ধ্বতন-অধস্তন সম্পর্ককেও পছন্দ করেন না এবং সংগঠনেরই প্রতিষ্ঠিত রীতিতেই পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। যে সংগঠনে প্রধানত বিশেষজ্ঞ বা টেকনিশিয়ানগণ কাজ করেন, সেখানে আদেশ জারি ও ‘হুকুম তামিলে’র চেয়ে বরং পরামর্শ, যুক্তি প্রদান ও আলাপ-আলোচনার পথে কাজ পরিচালিত হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাকে বিকেন্দ্রীভূত করা হয় এবং সংগঠনের প্রধান নির্বাহীকর্তা তদারক ও নিয়ন্ত্রণের চেয়ে বরং সমন্বয় সাধনের দায়িত্বই পালন করে থাকে।