মহাদেবী বর্মা দুঃখবাদী কবি নন, জীবনবাদী শিল্পী ‘নিভে যাওয়া দ্বীপগুলি আজ জ্বালিয়ে যাব’ কবিতা অবলম্বনে মন্তব্যটির যথার্থতা বিচার করো।
ছায়াবাদীদের নতুন পথের অভিযাত্রী মহাদেবী বর্মা। কোনো এক প্রেম ও সৌন্দর্য বিধুরতায় কবি বিভোর, বিভোর মানবিক প্রেমে, বিভোর জীবনের রং-বেরঙা খেলায়।
কবি মহাদেবী একদা মন্তব্য করেন— “দুঃখ মেরে নিকট অ্যায়সা কাব্য হ্যায় জো সারে সংসার কো এক মে বাঁধ রাখনে কী ক্ষমতা রখতা হ্যায়।….কিন্তু হমারা এক বুঁদ আঁসু কী জীবন কী অধিক মধুর, অধিক উর্বর বনায়ে বিনা নহী-গির সকতা।”—জীবনে সুখের হাওয়া যতটা না প্রয়োজন, তার চেয়ে দুঃখের আগুন অধিকতর প্রয়োজন। কেননা ‘সুখ আমাদের মনুষ্যত্বের প্রথম ধাপ পর্যন্ত হয়তো পৌঁছে দেবে না। তবুও তো বাঁচতে হয়। অন্ধকার থেকে আলোর পথে ছুটে চলতে হয়। — এই আলোর পথে ছুটে চলা, বাঁচার স্বতঃস্ফূর্ত আগ্রহ রয়েছে মহাদেবীর কবিতায়, রয়েছে ব্যথা-বেদনা-যন্ত্রণার চিত্রও। কবির ভাষায়—
‘আশা কী মুস্কাহট্ পর
মেরা নৈরাশ্য লুটা দো। [আঠ, নীহার]
‘দীপশিখা’ [১৯৪২ ] কাব্যগ্রন্থের উল্লেখযোগ্য কবিতা ‘নিভে যাওয়া দ্বীপগুলি আজ জ্বালিয়ে যাব’। কবিতাটি কবির ব্যক্তি জীবন বিজরিত, নৈরাশ্য মুক্তি লক্ষিত বলিষ্ট জীবন প্রত্যয়ের কবিতা।
রবীন্দ্র সাহচার্য ধন্য কবি মহাদেবী প্রেম ও সৌন্দর্যের উপাসক। দুঃখ-দারিদ্র্যকে তিনি জীবনের নিয়ামক শক্তি হিসাবে চিহ্নিত করলেও ‘তমসো না জ্যোতি-গময়ঃ’ মন্ত্রে তিনি দীক্ষিতা। তাই নৈরাশ্য পেরিয়ে জীবনানন্দের মতোই কোনো এক আলোকোজ্জ্বল ভূমিতে তিনি জীবনকে দেখতে চান। এ কবিতাও সেই ‘অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলোর কবিতা হিসেবে চিহ্নিত।
রবীন্দ্র সাহচার্য ধন্য কবি মহাদেবী প্রেম ও সৌন্দর্যের উপাসক। দুঃখ-দারিদ্র্যকে তিনি জীবনের নিয়ামক শক্তি হিসাবে চিহ্নিত করলেও ‘তমসো না জ্যোতি-গময়ঃ’ মন্ত্রে তিনি দীক্ষিতা। তাই নৈরাশ্য পেরিয়ে জীবনানন্দের মতোই কোনো এক আলোকোজ্জ্বল ভূমিতে তিনি জীবনকে দেখতে চান। এ কবিতাও সেই ‘অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলোর কবিতা হিসেবে চিহ্নিত। যতীন্দ্রনাথের মতো বা বিষ্ণুদের মতো শুধুই দুঃখ বা চোরাগুলির ফাঁদে কবি বন্দি নন বরং অন্ধকার যাদেরকে ঘিরে রেখেছে কবি স্বয়ং তাদেরকে অন্ধকারের আগল ভেঙে আলোর জগতে নিয়ে যেতে চেয়েছেন। আলোচ্য কবিতায় সূচনাতেই তাই কবি বলেছেন—
“সব বুঝে দীবক জ্বলা লু
ঘির রহা তম আজ দীপক-রাগিণী আপনি জগা লু।”
বিংশ শতকের কবি দেখেছেন গান্ধী আন্দোলন, দেখেছেন প্রথম বিশ্ব যুদ্ধোত্তর ভারতবর্ষের সামাজিক-অর্থনৈতিক অবনয়ন, দেখেছেন ইংরেজ শাসন-শোষণ, দেখেছেন দ্বিতীয় মহারণের রক্তক্ষয়।– এহেন বিবিধ অবক্ষয়িত সমাজে পরিবেশে সে সময়—’অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ’ বলে মনে হয়েছিল জীবনানন্দের। এই ‘অদ্ভুত আঁধারে’র বুকে দাঁড়িয়েও কবি মহাদেবী অন্ধকারের করাল রূপকে আপাদ-মস্তক উপলব্ধি করলেও জীবনের গান গাইতে তিনি ভোলেননি। তাই তিনি যথার্থ ভাবেই অন্তদৃষ্টিতে দেখেন—
‘ক্ষিতিজ-কারা তৌড় কর অব
গা উঠী উন্মত্ত আঁধী,
সব ঘটায়ৌ মে ন রুকতী
লাস-তন্ময় তড়িৎ বাঁধী,
ধূলি কী ধূস বীণ পর মে তার হর তৃণ কা মিলা লু’
অন্ধকারের ‘কারা’ কে ভেঙে ফেলতে উন্মত্ত যে আলোক গান গাইতে গাইতে ছুটে আসছে, তাকে ঢাকা দেওয়ার ক্ষমতা অন্ধকারের নেই। বরং জীবনের অন্ধকার পাদে এই আলোর গান জীবনকে নতুন স্বপ্ন দেখাতে সক্ষম হবে। আধুনিক যন্ত্র সভ্যতার চাকচিক্যে মানুষের মূল্যবোধের যে অবনতি তাতে আমরা ক্রমশ নৈরাশ্যের অতলে তলিয়ে যাচ্ছি। তথাপি আশাবাদী কবি এই অন্ধকারে নিভে যাওয়া আশার প্রদীপগুলিকে পুনরায় প্রজ্জ্বলন করার জন্য বদ্ধপরিকর।
হঠাৎ উল্কাপাতের মতো ধ্বংস নেমে আসে আচমকাই—এক রক্ষা করবার সাধ্য কারও নেই। ঠিক যেমনভাবে হঠাৎ ভয়ে মানুষ চোখ বন্ধ করে ফেলে, অন্ধজন পথ পায় না, তেমনি হঠাৎ বিপদে বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে মানুষ, তবুও তো তাকে চলতে হয়। চলতে হয় নবজীবন পানে। সে জীবন দুঃখের অন্ধকারে আচ্ছন্ন হতে পারে, হতে পারে কোনো প্রিয়জনের স্মৃতিতে বিভোর। কবির নিজের জীবনেও এমনই এক দাম্পত্য দুঃখ-অন্ধকার একদা গ্রাস করে—এ কবিতার চরণ তারই সাক্ষ বহন করে—
“উগলিয়োং কী ওট মে সুকুমার সব স্বপ্নে বাঁচালু
লয় বনী মৃদু বর্তিকা
হর স্বর জলা বনলৌ সজীলী,
ফৈলতী আলোক-সী
ঝঙ্কার মেরী স্নেহ-সীলী,
ইস মরণ কী পরব কো মে আজ দীপালী বনালু।” কবি হারানো পাতির ছায়া-স্বপ্নকে আঁকড়ে বাঁচবেন, বাঁচিয়ে রাখবেন অতীতের সেই মধুর স্বপ্নকে। অতীতের বাক্সম্পদকে প্রজ্বলিত দীপশিখার মতই জ্বেলে রাখবেন আপন অন্তরে।— এ কবির অঙ্গিকার। এ যেন রবি কবির ‘যেতে নাহি দিব’। এক Nostalgic Emotion-এ কবি এখানে মগ্ন।
কবি ব্যক্তি সীমা ছাড়িয়ে এক বিশ্বময় ব্যাপ্তিতে নিজেকে নিজের আলোক প্রদীপকে জ্বালিয়ে ধরণিকে আলোকময় করে তোলার কথা বলেছেন।
সীমা থেকে অসীমে তথা ব্যক্তি থেকে বিশ্বমানবে ছড়িয়ে পড়ার ইঙ্গিত কবি দিলেন এইভাবে—
“দেখ কর কোমল ব্যথা কো
আঁসুও কে সজল রস মে,
মোম-সী সাধ্বেং বিছা দী
থী ইসী অংগার-পথ মেং
স্বর্ণ হেং বে মত কহো অব ছার মেং উনকো জ্বলালু। অর্থাৎ মানুষের ‘কোমল ব্যথা’ দেখে কবির দু’চক্ষু বেয়ে মোম গলনের ন্যায় অশ্রুধারা ঝরে পড়ছে। এই দুঃখের পথে অগ্নি থাকে। সোনা থাকে মানুষের ঘুমের স্থানে, ‘পাশ’ থাকে না। এই স্বর্ণময় স্থানে কবির মনের মানুষ আছেন, আছে কবির স্বপ্ন-আশা। এই স্বপ্নের মধ্যে আছে আরও এক বৃহত্তর ভাবনা—মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণার থেকে বাঁচার স্বপ্ন।
কবি শুধু মানবমুখীনই নন, কবি অধ্যাত্মবাদীও। তাই কবিতার শেষ পাদে কবি তাঁর জীবন দেবতাকে আহ্বান জানিয়েছেন যন্ত্রণার বৃহত্তর প্রেক্ষিত থেকে মুক্তির উদ্ধার পাওয়ার জন্য। এযেন রবীন্দ্রনাথের জীবন দেবতার আবাহন। রবীন্দ্রনাথ বলেন—
“গান গেয়ে তরী চেয়ে কে আসে পারে,
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
…………..…..
ওগো, তুমি কোথা যাও কোন্ বিদেশে,
বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে।”
মহাদেবী বলেন—
“অব তরী পওয়ার লা কর
তুম দিখা মত পার দেনা,
আজ গর্জন মে মুঝে বস
একবার পুকার লেনা!”
আজকের গর্জনে [বিপদে মাঝি যেন কবিকে দেখে একবার অন্তত তুলে নেন। তাহলে কবি সংসারের সব দুঃখ-যন্ত্রণাকে অনায়াসেই পার করতে পারবেন। কবির ভাবনায়—
“জৌয়ার কো তরণী বনা মে ইস প্রলয় কা পার পা লু।
আজ দীপক রাগ গা লু”
শুধু আপন সংসার নয়, জগৎ সংসারের তুলসী মঞ্চে কবি আপন প্রাণের দীপ জ্বেলে দেওয়ালী সাজাতে সক্ষম হবেন—এই তাঁর অঙ্গীকার।
সমগ্র কবিতা জুড়ে এভাবে যে অঙ্গীকার বাণীর প্রত্যয় শোনা গেছে, তাতে সার্বিকভাবে অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে আলোর সত্য-সুন্দর প্রত্যয়ের কথা ধ্বণিত হয়েছে। এ প্রত্যয়ে যেমন আছে মানবমুক্তির প্রত্যয়, তেমনি আছে অশুভ বোধ থেকে মুক্তির প্রত্যয়, একই সঙ্গে রয়েছে ইতিহাসের প্রেক্ষিতে চালিত ইংরেজ শাসনের করাল গ্রাস থেকে মুক্তির অপ্রত্যক্ষ প্রত্যয়ও। সুতরাং দুঃখবাদ নয়, নয় কোনো নেতিবাচকতা বরং সত্য-শিব-সুন্দরের তথা আলোর প্রত্যয়ের কবি মহাদেবী মুখর।
তাই ‘নিভে যাওয়া দীপগুলি আজ জ্বালিয়ে যাব’ কবিতাটি সদর্থে নতুন ভোররে কবিতা, নতুন জীবনের কবিতা।
Leave a comment