মর্ত্যলোকে দেবী চণ্ডীর পূজা প্রচার করবার উদ্দেশ্যে মহাদেব এক ছলনার আশ্রয় নিয়ে ইন্দ্রপুত্র নীলাম্বরকে ব্যাধসন্তান-রূপে জন্মগ্রহণ করবার অভিশাপ দান করেন। তদনুযায়ী নীলাম্বর দেহত্যাগ করলে দেবী চণ্ডী এক বৃদ্ধা ব্রাহ্মণীর ছদ্মবেশ ধারণ করে ধর্মকেতু ব্যাধের গৃহে ব্যাধপত্নী নিদয়ার কাছে পৌঁছুলেন—উদ্দেশ্য একাদশী উপবাসের পর পারণ করবেন। নিদয়া যথাযোগ্য সম্ভ্রম প্রদর্শন করলে দেবী নিদয়াকে পুত্রবর্তী হবার বর দান করেন। পুলকিত হ’য়ে নিদয়া প্ৰতিশ্ৰুতি দিল—
‘পাইয়া তোমার বর যে হইবে বংশধর
তোমার করিয়া দিব দাস।’
তারপর নিদয়া স্নান করে দেবীর নিকট থেকে ঔষধের আশায় ঊর্ধ্বমুখী হ’য়ে বসলে দেবী তাকে ঔষধ দিলেন এবং এই অবসরে নীলাম্বর মক্ষিকারূপ ধারণ ক’রে নিদয়ার গর্ভে প্রবেশ করলো।
নিদয়া গর্ভবর্তী হল—প্রথম দু’মাস টের না পাওয়া গেলেও তৃতীয় মাসে নিদয়া ভূমিতে শয়ন করে, চতুর্থ মাসে মৃত্তিকা ভক্ষণ করে, পঞ্চম মাসে তার মুখে কোনো খাদ্য রোচে না, ষষ্ঠ মাসে তার চলাফেরায় অসুবিধা ঘটে, সপ্তম মাসে ধর্মকেতু তাকে নববস্ত্র উপহার দেয়, অষ্টম মাসে নিদয়া আর চলতে পারে না, নবম মাসে নিদয়ার সাধ দেওয়া হ’ল।
অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি এবং সহহৃদয় মানবতাবোধের আধকারী কবি মুকুন্দ চক্রবর্তী প্রচলিত কাহিনী অবলম্বন করে চণ্ডীমঙ্গল কাব্য রচনা করলেও যখনি সুযোগ পেয়েছেন, তখনই সাংসারিক জ্ঞান এবং মানবিকতাবোধের পরিচয় দিয়েছেন। এরূপ একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ নিদয়ার গর্ভসঞ্চার এবং সাধভক্ষণ। রমণী গর্ভসঞ্চারের পর মাসে মাসে তার দেহের ও মনের যে পরিবর্তন সাধিত হয়, স্বীয় অভিজ্ঞতা থেকে তিনি সেই সমস্ত লক্ষণ বর্ণনা করেছেন। এই লক্ষণগুলি থেকে স্পষ্টতই দেখা যাবে, দেশকালোচিত সামান্য পরিবর্তন সহ এ সমস্ত লক্ষণ এবং তদুপযোগী বিধি-ব্যবস্থা একালেও গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত আছে। মুকুন্দ কবি প্রদত্ত এই বিবরণ এত পুঙ্খানুপুঙ্খ যে কবির সাংসারিক জ্ঞান এবং অসাধারণ মানবিকতাবোধের পরিচয় পেয়ে বিস্মিত হতে হয়। নবম মাসে গর্ভবর্তী রমণীর মনে যে সকল সাধ জাগে সেই সকল সাধ পূরণ করাই সাধভক্ষণ অনুষ্ঠানে প্রধান করণীয়। এই সাধ সাধারণত খাদ্যরুচি বিষয়ক বলেই কবি এখানে অনুরূপ খাদ্যতালিকার বিবরণ দিয়েছেন।
পূর্ণগর্ভকালে অর্থাৎ গর্ভের নবম মাসে নিদয়া তার শারীরিক এবং মানসিক অবস্থার কথা বর্ণনা করছে স্বামী ধর্মকেতুর কাছে। মুখে তার রুচি নেই, খাদ্য এবং জল–কোনটাই তার খেতে ইচ্ছে করে না। পেটে ক্ষিধে রয়েছে, কিন্তু কিছুই সে মুখে তুলতে পারে না। নিকটে তার মা নেই, যার কাছে সে মনের দুঃখের কথা বলতে পারে কিংবা বোন, পিসি, মাসি বা মামি – এমন কোনো আত্মীয়-বন্ধু নেই যে এই দুঃসময়ে তার সংসারের ভার নিয়ে তাকে একটু অব্যাহতি দিতে পারে। এই প্রসঙ্গে একটি গ্রামীণ প্রথার কথা উল্লেখ করা চলে, প্রথাটি অবশ্য নগরাঞ্চলেও একেবারে অপ্রচলিত নয়। সন্তান প্রসব কালের কিঞ্চিৎ পূর্বে অর্থাৎ সাধভক্ষণের পরই সাধারণত গর্ভিনী নারী মাতৃসান্নিধ্যের প্রয়োজনে পিতৃগৃহবাসিনী হয়ে থাকে। এই সময়টা নিদয়ার পক্ষে, যে কোনো কারণেই হোক, পিতৃগৃহ গমন সম্ভবপর হয়নি বলেই তার এই কাতরতা প্রকাশ পেয়েছে। কবিকঙ্কণ তীব্র মানসিক অনুভূতির কারণেই নিদয়া-হাদয়ের এই আকৃতি অনুভব করে তাকে এখানে যথাযোগ্যভাবে প্রকাশ করেছেন। যাহোক— নিদয়া ভাবছে— নিয়তিও এ সময় তার প্রতি প্রতিকূল আচরণ করছে। গত দশ দিন ধ’রে ক্ষুধা-তৃষ্ণা নেই, এ সব দেখে তার মনে ভয় ধরছে। এখন যে সকল খাদ্যে তার রুচি হতে পারে বলে মনে হয়, নিদয়া তার একটা তালিকা পেশ করছে।
জামীরের রস দিয়ে মাছপোড়া পেলে এখন সে নিজের মত করে কয়েক গ্রাস খেতে পারে। মহিষ-দধির সঙ্গে ধানহীন খৈ, কুল, করমচা মিঠা ঘোল, পাকা চালতের ঝোল এবং আমসি পেলে নিদয়া প্রাণ ভরে খেতে পারে। এখানে নিদয়া যে খাদ্য তালিকা দিয়েছে, সবই অম্লজাতীয়। এ জাতীয় খাদ্যেই গর্ভবর্তী রমণীর সর্বাধিক স্পৃহা লক্ষ্য করা যায়। শুধু তাই নয়, গ্রাম্য দরিদ্র নারীর পক্ষে আয়োজন সম্ভবপর, এমন সমস্ত দ্রব্য সম্ভারের তালিকা উল্লেখ করে কবিকঙ্কণ বাস্তব বুদ্ধি ও পরিমিতিবোধের পরিচয় দিয়েছেন।
নিদয়ার পরবর্তী তালিকায় রয়েছে একটু ভিন্নস্বাদের খাদ্য—হেলেঞ্চা, কলমী এবং গিমা, তিনটিই তেতো। বোয়াল মাছ কুটে পাক করতে হবে, কড়া জ্বালে সরষে তেলে পলতা ভাজবে। পুঁই-ডগা মুখীকচু ফুলবড়ি আর মরিচের ঝাল দিয়ে হ’বে এক ব্যঞ্জন। হলুদ দিয়ে কাঁজি পেট ভরে তার খেতে ইচ্ছে হয়, পাকা তাল পেলে যেন সে প্রাণ পায় বাড়তি নুন দিয়ে বেজি ও গোসাপ পোড়া, হাঁসের ডিমের বড়া, রাই খয়রা মাছ ভাজা, চিংড়ির বড়া এবং শিক পোড়া সজারুও খুব উপাদেয়।
নিদয়ার এখন সর্বদাই বমি বমি ভাব, মুখে জল ওঠে, দিনে দিনে দেহের বল কমে আসে। মূলা বেগুন সীমের সঙ্গে ডুমুর এবং নিম পাতার রান্না হ’লে নিদয়ার পক্ষে রুচিকর হ’তে পারে।
সাধভক্ষণে যে সকল খাদ্যের কথা নিদয়া উল্লেখ করে বিভিন্ন ঘর থেকে চেয়ে চিন্তে সেই সকল উপকরণ যোগাড় ক’রে ধর্মকেতু নিজেই রান্না করে দেয়।
নিদয়ার সাধভক্ষণের এই খাদ্য তালিকায় যে সকল উপকরণের উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের কোনটিই বিশেষ মূল্যবান নয়। এই তালিকা নিম্নবিত্ত শ্রেণীর পক্ষেই উপযোগী এবং ব্যাধজীবনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এ থেকে কবিকঙ্কণের বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি, সাংসারিক জ্ঞান এবং মানবিকতা বোধের পরিচয় পাওয়া যায়।
Leave a comment