সাধক কবি রামপ্রসাদ তাঁর আধ্যাত্মসাধনায় দুঃখ থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছেন। তাঁর অধিকাংশ গানেই দুঃখ থেকে সেই মুক্ত হবার বাসনা প্রকাশ পেয়েছে। পার্থিব জগতের দুঃখ, নিজের জীবনের চরম সমস্যার সম্মুখীন হয়ে তাঁর অভিমান, অভিযোগ মায়ের কাছে, কখনও একেবারে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন– “এবার কালী তোমায় খাব, রামপ্রসাদে এই ভনে; দ্বন্দ্ব হবে মায়ের সনে।” মায়ের কাছে অভিযোগ “কোনো অবিচার আমার ‘পরে করলে দুঃখের ডিক্রি জারি ।” মায়ের কাছে অভিমান –’অভয় পদ সব লুটালে, কিছু রাখলে না মা তনয় বলে? এইভাবেই তাঁর গানে তিনি আধ্যাত্মিক আর্তি প্রকাশ করেছেন। জীবনের দুঃখ-কষ্টের জন্য দায়ী করেছেন শ্যামা মাকে কখনও নিজেকে। এইভাবে রামপ্রসাদ তাঁর পদে জীবনের দুঃখ আক্ষেপের কথা ব্যক্ত করে পদখানিকে নতুন মাত্রা দিয়েছেন।

অষ্টাদশ শতকের বাংলাদেশের গ্রামে স্বাধীন বৃত্তি ও কৃষিতন্ত্রের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়েছিল। গ্রামীণ জীবনের এই পরিপ্রেক্ষিতে মধ্যবিত্তকে নগরাভিমুখীন করে তোলে। কিন্তু যে নগরাভিমুখীন মধ্যবিত্ত শ্রেণি অতীত জীবনের স্মৃতি ভুলতে পারেন নি, রামপ্রসাদ সেই শ্রেণির প্রতিনিধি। স্বভাবতই তাঁর কাব্যে বিষয়াস্তরিত জীবনের ব্যর্থতা প্রকাশ পেয়েছে ।

“মন রে কৃষি জান না।

এমন মানব জমিন রইল পতিত

আবাদ করলে ফলত সোনা।”

একথা ঠিক, শাক্তগান আগাগোড়াই দুঃখের গান। ‘আগমনী’ গানের মাতা-কন্যা মিলনান্দের আবদার অভিমান বর্ণনাংশ ছাড়া সবটাই মেনকার তীব্র বেদনার কথা। ‘বিজয়া’ সর্বতোভাবেই দুঃখের গান। ‘ভক্তের আকৃতি’ সংসারের দুঃখ থেকে মুক্ত হবার আকাঙ্ক্ষাকে ব্যক্ত করেছে। রামপ্রসাদ তাঁর সাধনশক্তিতে অটুট বিশ্বাসী ছিলেন এবং সংসারে দুঃখ দারিদ্র, অভাব ও আরও অন্যান্য মনোবেদনার অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল।

জীবনের দুঃখ তাঁকে সাধনভ্রষ্ট করতে পারেনি। তিনি গৃহীসাধকও ছিলেন। গৃহ সংসারের বাস্তব দয়া তাঁকে বহন করতেই হয়েছে। দুবেলা আহার সংস্থানের চিন্তা থেকে মুক্তি তাঁর ছিল না। নিতান্ত বেঁচে থাকার জন্য সমস্যায় জর্জরিত হয়ে প্রাত্যহিক দিনযাপন করতেন। তবুও তিনি বলেছেন ‘আমি কি দুঃখেরে ডরাই? এর কারণও তিনি জেনেছেন, পার্থিব জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত দুঃখময়–

“আগে পাছে দুঃখ চলে মা, যদি কোনখানেতে যাই। 

তখন দুঃখের বোঝা মাথায় নিয়ে দুঃখ দিয়ে মা বাজার মিলাই।।”

বাস্তব সংসারের নিত্তনৈমিত্তিক যে সুখ-দুঃখ, তা মেনে নিয়েই পার্থিব জীবনযাপন করতে হয়। এর মধ্যে যে সাময়িক সুখ মেলে তা বহু মানুষকে মোহবিহ্বল করলেও রামপ্রসাদ জেনেছেন সে সুখ নিতান্ত ক্ষণিকের। তিনি অনুভব করেছেন সুখের মায়ায় ভুললে জীবনে দুঃখের যন্ত্রণা আরও বেদনাদায়ক। তাই পার্থিব সংসারের দুঃখকে সত্য বলে মেনে দুঃখের মধ্যেই নিজেকে স্থাপন করেছেন। এবং তাই সাংসারিক দুঃখে তাঁর যন্ত্রণাবোধ হয় না –

“আমি এমন বিষের কৃমি মাগো, বিষের বোঝা নিয়ে বেড়াই।”

মানুষের জীবনে প্রকৃত সুখ সাংসারিক বিষয়াসুক্তিমুক্ত হয়ে মাতৃচরণে আশ্রয় লাভে। অথচ রামপ্রসাদ তাঁর ইন্দ্রিয় বাসনাকে নিত্য পীড়িতের কারণ বলে মনে করেছেন। তাই তো তিনি বলেছেন–

“যে দুঃখ গৰ্ভ যাতনে, মাগো জন্মিলে থাকে না মনে। 

মায়ামোহে পড়ে ভ্রমেও জন্মি বলে ওনা ওনা।।”

পার্থিব জীবনে অর্থাভাব, অন্নাভাব, আত্মীয় পরিজনের প্রীতি ও সহানুভূতির অভাব সাধারণত মানুষকে দুঃখ দেয় কিন্তু রামপ্রসাদ তাকে গ্রাহ্যই করেন না। তাঁর যন্ত্রণা পঞ্চেন্দ্রিয় ও ষড়রিপুর পীড়নে–

“পঞ্চ ভূত ছয়টা রিপু, দশেন্দ্রিয় মহা লেঠে, 

তারা কারো কথা কেউ শোনে না, দিন তো আমার গেল ঘেঁটে।”

সাধারণ মানুষ যেদিন নানাভাবে নিষ্পেষিত হচ্ছে তাই সাধক কবির কণ্ঠে উচ্চারিত—

“মা আমায় ঘুরাবি কত।

কলুর চোখ ঢাকা বলদের মতো ?”

এখানে প্রকাশ পেয়েছে অসহায় মানুষের একই বৃত্তে ঘোরার গ্লানি। এইভাবে রামপ্রসাদ লোকায়ত জীবন থেকে সংগ্রহ করেছেন তাঁর কাব্যের চিত্রকল্প।

অতএব রামপ্রসাদ শাক্তপদাবলিতে নিজের জীবনের দুঃখময় আর্তিকে প্রকাশ করে পদখানিকে কাব্যসৌন্দর্যে ভূষিত করেছেন। রামপ্রসাদের সাধনা দুঃখ-বেদনা-আর্তি থেকে মাতৃচরণে আশ্রয় পাওয়ার সাধনা যা একমাত্র মুক্তির পথ।