কুতুবউদ্দিন মুবারক শাহ (১৩১৬-২০ খ্রিঃ):
মালিক কাফুরকে হত্যা করার পর আলাউদ্দিনের তৃতীয় পুত্র কুতুবউদ্দিন মুবারক নাবালক সুলতান শিহাবউদ্দিনের অভিভাবক নিযুক্ত হন। কিন্তু মাত্র দু-মাস প্রতিনিধিত্ব করার পর কুতুবউদ্দিন বালক শিহাবউদ্দিনের চক্ষুদ্বয় উৎপাটিত করে এবং কারারুদ্ধ করে নিজেকে ‘সুলতান’ বলে ঘোষণা করেন। তিনি কুতুবউদ্দিন মুবারক শাহ’ নাম নিয়ে সিংহাসনে আরোহণ করেন (১৯ এপ্রিল, ১৩১৬ খ্রিঃ)। আলাউদ্দিনের কোনো গুণই তাঁর পুত্রের চরিত্রে ছিল না। এস. রায় লিখেছেন : “Mubarak was an unworthy successor of his father. In him the vices of Alauddin were magnified, but his virtues were lacking.” ব্যভিচারিতা ছিল মুবারকের অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। তিনি কেবল বহুকামী ছিলেন না, সমকামীও ছিলেন। তাঁর সমকামী-প্রবণতার ফলেই হাসান বর্দু এবং হুসামউদ্দিন বর্দু নামক দুই যুবক মুবারকের অতি প্রিয়পাত্রে পরিণত হন। এদের মধ্যে হাসান ছিলেন মুবারকের বেশি পছন্দের। তাঁকে মুবারক ‘খসরু শাহ’ উপাধিতে ভূষিত করে নানা গুরুত্বপূর্ণ রাজপদে নিয়োগ করেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য খসরু খাঁ মুবারককে হত্যা করে সিংহাসন দখল করেন।
মুবারক সিংহাসনে বসেই আলাউদ্দিনের আমলের কঠোর নিয়ন্ত্রণ-বিধি শিথিল করে দেন। রাজনৈতিক অপরাধের জন্য বন্দিদের মুক্তি দেন এবং নির্বাসিতদের পুনর্বাসিত করে মুবারক সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করেন। দ্রব্যমূল্য বা বাজারের ওপর আরোপিত কঠোর নিয়ন্ত্রণও তিনি শিথিল করে দেন। ফলে উৎপাদক, ব্যবসায়ী প্রভৃতি শ্রেণির মানুষ তাঁর সমর্থকে পরিণত হয়। বারাণীর মতে, আলাউদ্দিন যে ভীতির পরিমণ্ডল সৃষ্টি করে একাধারে অভিজাত ও সাধারণ মানুষকে সুলতানির প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্য জ্ঞাপনে বাধ্য করেছিলেন; মুবারক শাহের যুক্তিহীন তোষণনীতির ফলে তা অন্তর্হিত হয়। ফলে কর্মচারীদের নৈতিক অধঃপতন দেখা দেয়, সাধারণ মানুষের মধ্যে বিশৃঙ্খলা দানা বাঁধে এবং অভিজাতদের মধ্যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও ষড়যন্ত্রপ্রিয়তা প্রকট হয়ে ওঠে। সুলতানের ব্যভিচার ও অসংযমী জীবনযাপনের নগ্ন দৃষ্টান্ত প্রশাসনিক অবক্ষয়কে দ্রুত পুষ্ট করে।
গুজরাট, দেবগিরি এবং বরঙ্গলের বিরুদ্ধে মুবারক অবশ্য কয়েকটি সফল সামরিক অভিযানের ব্যবস্থা করেন। গুজরাট দখল করার পর সুলতানের শ্বশুর জাফর খাঁ সেখানকার শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। খসরু বরঙ্গলের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে প্রচুর ধনসম্পদ লুণ্ঠন করেন। দাক্ষিণাত্যের বিদ্রোহদমনের পর মুবারকের ঔদ্ধত্য ও অহঙ্কার সীমাহীন হয়ে পড়ে। গোয়ালিয়র দুর্গে বন্দি তিন ভাই সাদি খাঁ, খিজির খাঁ ও শিহাবউদ্দিনকে তিনি নৃশংসভাবে হত্যা করেন। প্রকাশ্য রাজসভায় নর্তকী বা বারনারীদের এনে সভার মর্যাদা কলঙ্কিত করেন দ্বিধাহীন চিত্তে। বারাণীর বিবরণে দেখা যায়, মুবারকের চার বছর চার মাস ব্যাপী রাজত্বকালের অধিকাংশ সময় ব্যয়িত হয়েছিল নাচ, গান আর মদ্যপানে।
খসরু শাহ সুলতান মুবারকের বিকৃত লিপ্সার সঙ্গী ছিলেন। সুলতানের অনুগ্রহে উজির-পদ তাঁর করায়ত্ত হয়েছিল। একজন ধর্মান্তরিত মুসলমানের এহেন পদোন্নতি ও প্রতিপত্তি ছিল কিছুটা আশ্চর্যজনক। তথাপি খসরু কোনোদিনই মুবারকের ওপর সন্তুষ্ট ছিলেন না। মুবারকের অসংযমী আচরণ তাঁকে অবশ্যই ব্যথিত করত। তাই প্রথম থেকেই মুবারকের হাত থেকে মুক্তিলাভের বাসনা এই তরুণ যুবকের মনের গোপনে বাসা বেঁধেছিল। সুলতানের দুর্বলতার সুযোগে খসরু একটু একটু করে তাঁর লক্ষ্যপথে অগ্রসর হন। সুলতানের অনুমতিক্রমে খসরু গুজরাট থেকে নিজ গোষ্ঠীভুক্ত বহু লোককে দিল্লিতে এনে ৪০ হাজার অশ্বারোহীর এক বাহিনী গড়ে তোলেন। রাত্রিকালে প্রাসাদের অভ্যন্তরে নিজের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের সাথে আলাপ-আলোচনায় মিলিত হবার বিশেষ অনুমতিও তিনি পান। সুলতানের শুভাকাঙ্ক্ষী কেউ কেউ খসরুর অভিপ্রায় সম্পর্কে সুলতানের কাছে সন্দেহ প্রকাশ করলেও মুবারক নির্লিপ্ত থাকেন। অতঃপর ১৩২০ খ্রিস্টাব্দের ১৩ এপ্রিল খসরু এক গোপন পরিকল্পনা অনুসারে আকস্মিক আক্রমণ দ্বারা মুবারককে হত্যা করেন।
নাসিরুদ্দিন খসরু শাহ (১৩২০ খ্রিঃ) :
মুবারক শাহকে হত্যা করে খসরু ‘নাসিরুদ্দিন খসরু শাহ’উপাধি নিয়ে সুলতানি সিংহাসনে বসেন। খসরুর রাজত্বকালকে খলজিবংশের অবসান এবং তুঘলক শাসনের সূচনার যোগসূত্র বলা চলে। সমকালীন মুসলমান লেখকরা খসরুকে ‘নীচজাতিভুক্ত হিন্দু এবং অকৃতজ্ঞ ও বিশ্বাসঘাতক’ বলে বর্ণনা করেছেন। বারাণী খসরু কর্তৃক সিংহাসনদখলের ঘটনাকে ইসলামের সংকট’ এবং ‘হিন্দুত্ববাদের পুনর্জাগরণ’ বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু কোনো বক্তব্যটিই যথার্থ নয়। প্রথমত, খসরু ষড়যন্ত্র দ্বারা ক্ষমতালাভ করলেও, তিনি অন্তত মুবারক শাহ বা আলাউদ্দিন খলজির থেকে অধিক অকৃতজ্ঞ বা নিষ্ঠুর ছিলেন না। দ্বিতীয়ত, জন্মসূত্রে হিন্দু হলেও তিনি বাল্যকালেই ইসলামধর্মে দীক্ষিত হন এবং তাঁর নাম হয় ‘হাসান’। তাঁর ক্ষমতাদখলের সময় তাঁরই উপজাতিভুক্ত গুজরাটের বহু হিন্দু এই কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। এমনকি তারা দিল্লি-প্রাসাদের অভ্যন্তরে হিন্দু ধর্মাচরণের সুযোগও পেয়েছিল। তবুও এই ঘটনাকে ইসলামের পরিবর্তে হিন্দুর অভ্যুত্থান বলা চলে না। কারণ খসরু কখনোই হিন্দুত্বের পুনঃপ্রতিষ্ঠার কথা বলেননি। তিনি ইসলামের রীতি অনুযায়ী ‘খুৎবা’ পাঠ করেন এবং নিজেকে ‘আল্লাহ্র সেনাপতি’বলে অভিহিত করেন। এমনকি খসরুর বিরুদ্ধে যখন গাজিমালিক (তুঘলক) প্রাদেশিক মুসলমান শাসকদের ঐক্যবদ্ধ হবার আহ্বান জানান, তখন অধিকাংশ শাসকই নির্লিপ্ত থাকেন। তাই খসরুর সিংহাসনদখলকে মধ্যযুগীয় ক্ষমতাদখলের রাজনীতির একটা অধ্যায় মাত্র বলে অধ্যাপক কে. এস. লাল অভিমত প্রকাশ করেছেন।
সিংহাসন দখল করে খসরু তাঁর আত্মীয় বন্ধু এবং অন্যান্য যাঁরা ক্ষমতাদখলের সহায়ক ছিলেন, তাঁদের অর্থ দিয়ে কিংবা উচ্চপদে আসীন করে পুরস্কৃত করেন। বহু আলাই অভিজাতকে সম্মানিত করে তাদের সমর্থনলাভেরও চেষ্টা করেন। অবশ্য আলাউদ্দিনের জীবিত সমস্ত বংশধরকে হত্যা করে নিজের সিংহাসন কণ্টকমুক্ত করার ব্যাপারেও তিনি উদ্যোগ নেন। বহু ব্যক্তি খসরুর সমর্থকদের হাতে লাঞ্ছিত হন। ইবন বতুতা লিখেছেন, বেশ কিছু উঁচুপদে হিন্দুদের নিয়োগ করে মুসলমানদের জব্দ করা হয়। অবশ্য এ অভিযোগ যথেষ্ট যুক্তি দ্বারা প্রমাণিত নয়।
খসরুর বিরুদ্ধে হিন্দুদের অভিযোগ প্রচার করে দিপালপুরের শাসনকর্তা গাজি তুঘলক জনমত গঠনে তৎপর হন। গাজি তুঘলকের পুত্র জুনা খাঁ তখন দিল্লির দরবারে নিযুক্ত ছিলেন। পিতার নির্দেশে জুনা দিল্লি থেকে দিপালপুরে পালিয়ে যান। অতঃপর গাজি তুঘলক উচ্, মুলতান, সিস্তান, সামানা, জালোর প্রভৃতি প্রদেশের শাসনকর্তাদের খসরুর বিরুদ্ধে সমবেত হবার আহ্বান জানান। অবশ্য উচের শাসক বাহরাম আইবা ব্যতীত কেউই তাঁর আহ্বানে সাড়া দেননি। এমনকি সুফিসন্ত নিজামউদ্দিন আউলিয়াও খসরুর বিরোধিতা করতে অস্বীকার করেন। দিল্লি থেকে ‘আইন-উল-মুলক্’ (আলম খাঁ) অবশ্য আসন্ন সংগ্রামে নিরপেক্ষতা রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেন। দিল্লির সন্নিকটে তিলপত নামক স্থানে খসরুর সাথে গাজি মালিকের চূড়ান্ত যুদ্ধ হয় (৬ সেপ্টেম্বর, ১৩২০ খ্রিঃ)। খসরু অপূর্ব বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে যখন জয়ের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত, তখন আইন-উল-মুলক্ আকস্মিক যুদ্ধ ত্যাগ করে মালবের পথে পালিয়ে যান। খসরু হতোদ্যম হয়ে পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য হন। খসরুকে হত্যা করা হয়। অতঃপর অভিজাতদের অনুরোধক্রমে গাজি মালিক ‘গিয়াসউদ্দিন তুঘলক শাহ’ উপাধি নিয়ে দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন। শুরু হয় সুলতানি ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়।
Leave a comment