‘পয়লা নম্বর’ গল্পের অনিলা চরিত্র আলোচনা করো।

রবীন্দ্রপর্ব বাংলা সাহিত্যে নারী চরিত্র মানেই যেন সংসারের জন্যে কে কতটা ত্যাগ স্বীকার করতে পারে তার প্রতিযোগিতা। নারীর মন বা ইচ্ছার কথা ততটা বর্ণিত হত না। এমনকি সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের দেবী চৌধুরাণীকেও শেষদৃশ্যে ঘাটে বসে বাসন মাজতে দেখা গেছে। বস্তুত সে সময় সাহিত্য পাঠিকাদের সতীত্ব বোধ জাগানোর প্রয়াসেই ব্যাপৃত ছিলেন সাহিত্যিকরা। তবে এ জন্যে কেবলমাত্র সাহিত্যিকদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো উচিত নয়, মনে রাখতে হবে যুগমানসিকতাও সে সময় ততটা উন্নত হয়নি।

রবীন্দ্রসাহিত্যে নারীরা নানা রূপে বন্দিত হয়েছে। কখনও, প্রেয়সী রূপে, কখনও দেবীর বেশে, কখনো অন্তর সম্পদে পূর্ণ ঐশ্বর্যময়ী রূপে, কখনও ব্যক্তিত্বময়ী রূপে। ‘স্ত্রীর পত্রে’র মেজবউ মৃণাল, ‘পয়লা নম্বর’-এর অনিলা, ‘চতুরঙ্গ’-এর দামিনী, ‘শেষের কবিতা’র লাবণ্য, ‘চিত্রাঙ্গদা’-র চিত্রাঙ্গদা এই সমস্ত চরিত্র অত্যন্ত উজ্জ্বল হয়ে ভাস্বর হয়ে আছে। এরা প্রত্যেকেই স্বাধীন মনুষ্যত্ব অর্জন করেছে।

আমাদের আলোচ্য ‘পয়লা নম্বর’ গল্পের অনিলা চরিত্রও এইরকম অনুপম ব্যক্তিত্বে সমাসীন। তার নারীজীবনে মাতৃত্ব, প্রেয়সীত্ব, ভগ্নীতুর চেয়ে বড়ো হয়ে উঠেছে নারীত্ব। পুঁথির ব্যূহ ভেদ করে, তত্ত্বজ্ঞানের কুয়াশা কাটিয়ে তার স্বামী অদ্বৈতচরণ ধন্য করতে পারেনি তার জীবন যৌবনকে। দাম্পত্য জীবনে একাকীত্বে আচ্ছন্ন হয়েও সে কোনো ব্যর্থ প্রতিবাদ করে সংসারের সমাজের ও স্বামীর অশ্রদ্ধাভাজন করে তোলেনি নিজেকে। সেই নিঃসঙ্গ মনের পাড়ে প্রেমের হাতছানি এসেছিল সিতাংশুমৌলির। একদিকে সামাজিক বন্ধন, অন্যদিকে অসামাজিক প্রেমে অবগাহন প্রস্তাব এই দু-এর টানাপোড়েন থেকে আত্মরক্ষা করার জন্যে তার উভয়ের কাছেই অধরা থাকতে গৃহত্যাগ করতে হয়েছিল। কেন না, একদিকে যেমন তার স্ত্রী-জীবনটি হয়েছিল। অবহেলিত, অন্যদিকে তেমনি সিতাংশুর প্রেমের শ্রদ্ধানষ প্রস্তাবে সাড়া দিলে তার মর্যাদা ক্ষুণ্ন হতো অবশ্যই। তাই আত্মস্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে নিরুদ্দেশ হওয়া ছাড়া অন্য কোনো পথ তার সামনে খোলা ছিল না।

অনিলা নিজেকে স্বাবলম্বী রূপে প্রতিষ্ঠা করেছে, তার সংসারের কাজে। সংসার চালানোর কাজে কোনোদিন অদ্বৈতচরণের পরামর্শ সে নিতে যায়নি। এমন কি তার পিতার মৃত্যুর পর ছোটো ভাই সরোজের পড়াশোনা ও পিতার থেকে পাওয়া সাত হাজার টাকার ব্যবস্থা করতে একমুহূর্তের জন্যেও স্বামীর শরণাপন্ন হয়নি। অথচ যথাযোগ্য ব্যবস্থা ও পরিচালনা সে করে গেছে। আবার সরোজের আত্মহত্যার সংবাদ পাওয়ার পর সে নিজেই সমস্ত কাজ সমাধা করে এসেছে। এমনকি তার স্বামীকে এ ব্যাপারে এতটুকুও বিড়ম্বিত করেনি। কেন না, সে জানতো তার স্বামীর পক্ষে এই সমস্ত অশান্তি পোহানো কষ্টকর। একদিকে এ থেকে তার নিষ্পেষিত অবহেলিত মনের বিক্ষোভ যেমন ধরা পড়েছে, তেমনি ধরা পড়েছে স্বাবলম্বী ব্যক্তিত্বর বিচ্ছুরণ। কিন্তু তার জীবন-যৌবন অবহেলিত হলেও, কিংবা তার মনের আশ্রয় সংসারের কোথাও না পেলেও আপন কর্তব্য সমাধায় এতটুকু ফাঁকি দেখা যায়নি। যেদিন ভাই-এর সৎকার করে সে বাড়ি ফিরল, সেদিনও অদ্বৈতচরণের সভার জন্যে মহাভোজের আয়োজন তাকে করতে হয়েছিল। নিজেকে আড়ালে রেখে এইভাবে সংসারের কর্মনির্বাহ করার মধ্যে দিয়েও ফুটে উঠেছে তার প্রতিবাদী মানসিকতা। পাওয়া গেছে দৃঢ় অনুপম ব্যক্তিত্বের পরিচয়। কোমলতায় পূর্ণ মনের মাঝে ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তা। তার ব্যক্তিত্বকে স্পর্শ করতে পারেনি অদ্বৈতচরণ কিংবা নরোত্তমপুরের জমিদার সিতাংশুমৌলি। প্রেমের ও পার্থিব ঐশ্বর্যের প্রলোভন এবং অভ্যস্ত অনাদর তাকে চালিত করতে পারেনি চিরাচরিত পথে। সে যদি সিতাংশুর সঙ্গে পালিয়ে যেত কিংবা আত্মহত্যা করতো তা হলে তার শ্রেষ্ঠত্বে দাগ ধরতে পারতো। কিন্তু এখানে তার স্বামী এবং প্রেমাস্পদ উভয়কেই প্রত্যাখ্যান করে স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে সে-ই হয়ে গেছে পয়লা নম্বর।