নামসর্বস্ব: (১) নামসর্বস্ব শাসক বলতে বােঝায় যার নামে তত্ত্বগতভাবে দেশের শাসনকার্য পরিচালিত হয়, কিন্তু বাস্তবে তিনি ক্ষমতা ভোগ করেন না। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায় ইংল্যান্ডের রাজা-রানি এবং ভারতের রাষ্ট্রপতি। (২) নামসর্বস্ব শাসক প্রধান উত্তরাধিকারসূত্রে বা জনগণের পরােক্ষ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হন। (৩) ব্রিটেনের রাজা বা রানি আলংকারিক শাসক মাত্র। (৪) নামসর্বস্ব শাসক সরকারের প্রধান নয়, তাই রাষ্ট্রের প্রধান বলে বিবেচিত হয় না। তাই এদের দায়িত্ব কম, সম্মান ও মর্যাদা অনেক বেশি।
প্রকৃত শাসক: (১) তত্ত্বগতভাবে যিনি সর্বোচ্চ শাসনক্ষমতা বা মর্যাদার অধিকারী নন, কিন্তু বাস্তবে যিনি শাসনক্ষমতার প্রকৃত কর্ণধার ও প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী, তাকে বলা হয় প্রকৃত শাসক। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী, গ্রেট ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী। (২) প্রকৃত শাসকরা সাধারণত জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হন। (৩) প্রকৃত শাসক হিসেবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রী পরিষদ প্রকৃত শাসকপ্রধানের কর্ণধার মাত্র। (৪) প্রকৃত শাসক প্রতিনিধিরা সরকারের প্রধান হিসেবে কাজকর্ম সম্পাদন করে থাকে বলে, এদের দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব নামসর্বস্ব শাসকের তুলনায় অনেক বেশি।
আধুনিক রাষ্ট্রের শাসন বিভাগের ক্ষমতার পরিধি ও গুরুত্ব বৃদ্ধি পাওয়ায় বর্তমানে শাসন বিভাগকেই সরকারের মূল স্তম্ভ বলে অভিহিত করা হয়। সাধারণভাবে সরকার বলতে শাসন বিভাগকেই বােঝায় কারণ, আইনসভার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও শাসন বিভাগকেই সরকারের যাবতীয় কাজকর্ম পরিচালনা করতে হয় এবং সরকারের সকল সিদ্ধান্তকে বাস্তবায়িত করতে হয়। উপরোক্ত ভূমিকা পরিপ্রেক্ষিতে অধ্যাপক কোরি (Corry) মন্তব্য করেছেন, সরকারের মূল অংশ হল শাসন বিভাগ। অধ্যাপক ব্লন্ডেল (Blondel) শাসন বিভাগকে রাজনৈতিক জীবনের প্রধান অংশ বলে বর্ণনা করেছেন। বলা যায় শাসন বিভাগ মানেই সরকার। বর্তমান শতাব্দীর সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য ঘটনা হল সরকারের শাসন বিভাগের ক্ষমতার সম্প্রসারণই শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণ। এ ছাড়াও অন্যান্য কারণগুলি হল –
(১) নীতি নির্ধারণে শাসন বিভাগের ভূমিকা: সরকারের নীতি নির্ধারণ ছাড়াও গণতান্ত্রিক ও রাষ্ট্রপতি-শাসিত শাসন ব্যবস্থার কাজে শাসন বিভাগের গুরুত্ব অপরিসীম। শুধুমাত্র নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রেই এই ক্ষমতা সীমাবদ্ধ থাকে না, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, রূপায়ণ এবং সমন্বয়সাধনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে থাকে।
(২) দল ব্যবস্থার উদ্ভব ও দলীয় নিয়মানুবর্তিতার ফলে ক্ষমতা বৃদ্ধি: আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতাপ্রাপ্ত দলের নেতারা মন্ত্রীসভা গঠন করার অধিকারী বলে বিবেচিত হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতাদের আদেশ, নির্দেশ অবজ্ঞা করার ক্ষমতা আইনসভার সদস্যদেরও থাকে না। যদি তা না হয় তাহলে সেই সদস্যের রাজনৈতিক অপসারণ অবধারিত। এই কঠোর দলগত নিয়মনীতির জন্যই শাসন বিভাগের ক্ষমতা ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
(৩) সময় ও দক্ষতার অভাবের জন্যই শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি: বর্তমানে অধিকাংশ রাষ্ট্রের আইনসভা তার সময়ের অভাবের জন্য আইন প্রণয়নের দায়িত্ব শাসন বিভাগের হাতে অর্পণ করেছে। এ ছাড়াও আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে আইনসভার সদস্যদের প্রয়ােজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতার অভাব দেখা দিলে সেই দায়িত্ব শাসন বিভাগের উপরই ন্যস্ত হয়, এর ফলস্বরূপ শাসন বিভাগের ক্ষমতার গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে।
(৪) জরুরি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি: দেশের অভ্যন্তরীণ গােলযােগ বা যুদ্ধ বা আন্তর্জাতিক সংকট-এর মতাে জরুরি অবস্থার দ্রুত মােকাবিলা করার জন্য আইনসভা শাসন বিভাগের হাতে প্রচুর ক্ষমতা অর্পণ করে। এ ছাড়াও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পররাষ্ট্রনীতি সংক্রান্ত বিভিন্ন কাজ, যথা – নীতি নির্ধারণ, কূটনীতিক সম্পর্ক পরিচালনা এবং প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত কাজ শাসন বিভাগকেই করতে হয়, যা পরােক্ষে শাসন বিভাগের ক্ষমতাবৃদ্ধির কারণ রূপে চিহ্নিত করা যায়।
(৫) আর্থিক ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনে শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি: আইন প্রণয়নের ক্ষমতা আইন বিভাগ ভােগ করলেও বাস্তবে বেশিরভাগ আইনের শাসন বিভাগের পক্ষ থেকে উত্থাপিত হয়। সরকারের আয়-ব্যয়ের হিসাব বা বাজেট শাসন বিভাগের পক্ষ থেকেই উত্থাপিত হয়। শাসন বিভাগের সকল সদস্যই আর্থিক বিষয়ে অভিজ্ঞ এবং বিশেষজ্ঞ | এই বিভাগের মতামত ছাড়া সরকার অচল বলে বিবেচিত হয়। আইনসভার সদস্যদের অনভিজ্ঞতা অন্যদিকে অপারগতা শাসন বিভাগের ক্ষমতা বা ভূমিকাকে শক্তিশালী করে তুলেছে।
(৬) জনকল্যাণকর রাষ্ট্র গঠনের ফলে শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি: বর্তমান জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রে সরকারের কাজের পরিধি বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে সকল বিষয়ে সঠিকভাবে আইন প্রণয়ন করার মতাে সময় আইনসভার হাতে থাকে না— এর ফলে জনকল্যাণকর রাষ্ট্র গঠনের অনেক ক্ষমতা আইনসভা শাসন বিভাগের হাতে অর্পণ করেছে।
(৭) বিরোধী দলের ভূমিকা গঠনে শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধি: বিরােধী দল বিভিন্ন কারণে-অকারণে আইনসভার আলােচনায় অংশগ্রহণ না করে কক্ষত্যাগ করে। আইনসভায় বিরােধী দলের অংশগ্রহণ ঘটলেও আইনসভার ক্ষমতা হ্রাসপ্রাপ্ত হচ্ছে এবং শাসন বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হচ্ছে।
(৮) আইন বিভাগের তুলনায় শাসন বিভাগের সক্রিয় ভূমিকা পালন: জনসাধারণের মনস্তত্ত্বও শাসন বিভাগের ক্ষমতা ও প্রভাব বৃদ্ধিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। বাস্তবে আইন বিভাগের তুলনায় শাসন বিভাগই রাষ্ট্রের সকল বিষয়ে বেশি সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
Leave a comment