‘সোনার তরী’ কবিতাটি রচিত হয় বাংলা ১২৯৮ সালের ফাল্গুন মাসে এবং ‘সোনার তরী’ কাব্য গ্রন্থের প্রথম কবিতা। এই কবিতাটি নিয়ে এক সময় পাঠক সমাজে একটা বেশ আলোড়ন সৃষ্টি হয়। পন্ডিতেরা তর্ক রসজ্ঞেরা কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের আর কোনো কবিতা নিয়ে এত তর্ক-বিতর্ক হয়নি। রবীন্দ্র জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ও খছেন : ‘প্রায় চৌদ্দ বৎসর পরে বাংলার সাময়িক সাহিত্যে ইহা যে পরিমাণ রস ও বিষ সৃষ্টি করিয়াছিল তাহা রবীন্দ্রনাথের কোনো একটি কবিতা সম্বন্ধে পূর্বে বা পরে কখনও হয় নাই।”

এ কবিতাটিকে নিয়ে যে সমালোচকরা কঠোর সমালোচনা করেছিলেন তাঁহার মধ্যে তৎকালীন কবি ও নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ১৯১৩ সালে ‘সোনার তরী’ কবিতাটির বিরুদ্ধে সমালোচনা করেছিলেন। তিনি কবিতাটিকে অভিহিত করেন অস্পষ্ট এবং দুর্বোধ্য বলে ; এর মধ্যে কিছু কিছু অসঙ্গতি রয়েছে বলে মন্তব্য করেন। তিনি লক্ষ্য করেছেন যে কবিতাটি বর্ষার পটভূমিতে বর্ণিত হলেও আসলে উহা লিখিত হয় বসন্তকালে, ফাল্গুন মাসে। সুতরাং দ্বিজেন্দ্রলালের মতে ‘সোনার তরী’ কবিতাটি কবির অন্তর প্রেরণাজাত নয় কৃত্রিম রচনা।

অতএব দেখা যাচ্ছে ‘সোনার তরী’ কবিতাটি সম্বন্ধে তখনকার সাহিত্যে, সমাজে যথেষ্ট বিরূপ সমালোচনা হয়েছিল—অনেকের মতে এটি দুর্বোধ্য এবং অর্থহীন। আবার অনেকে বলেছেন কবিতাটির বর্ণনার পরিবেশ অসঙ্গতিময় এবং বাস্তবতার সঙ্গে কোনো মিল নেই। যেমন শ্রাবণ মাসে বাংলার পল্লিতে ধান কাটা হয় না, কারণ তখন ধান পাকে না। চারদিকে বাঁকা জল দ্বারা পরিবেষ্টিত চরে ধানের চাষ হয় না। ভরা পালে যখন নৌকা চলতে থাকে তখন নৌকা বাওয়ার কোনো প্রশ্ন ওঠে না। বর্ণনায় রয়েছে গ্রামখানি মেঘে আবৃত অথচ সে সময় দেখা যাচ্ছে নিবিড় গাছের ছায়ার গ্রামখানি ঢাকা। তার মধ্যে শেষের স্তবকটি সম্বন্ধে কড়া অভিযোগ হচ্ছে এটি সম্পূর্ণ অর্থহীন।

এত অভিযোগ ও সমালোচনার পরও কিন্তু কবিতাটি পাঠক-হৃদয়ে রস-সঞ্চার করেছে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ কবিতাটিতে একটা ভাবময় অবস্থা ব্যক্ত হয়েছে খন্ড খন্ড প্রকৃতির এবং মানবজীবনের বাস্তব ঘটনার সঙ্গতির মাধ্যমে। তাতে কবিতাটি রূপকধর্মী হয়ে উঠেছে—এ সম্বন্ধে কবি তাঁর ‘সোনার তরী’ কাব্যগ্রন্থের সূচনাতে ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেছেন; ‘আমি শীত বর্ষা মানিনি, কতবার সমস্ত বৎসর ধরে পদ্মার আতিথ্য নিয়েছি—বৈশাখের খররৌদ্রতাপে শ্রাবণের মূষলধারা বর্ষণে। পরবার ছিল ছায়াঘন পল্লির শ্যামশ্রী, এ পরে ছিল বালুচরের পাণ্ডুবর্ণ জনহীনতা, মাঝখানে পদ্মার চলমান স্রোতের পটে বুলিয়ে চলেছে দ্যুলোকের শিল্পী প্রহরে প্রহরে নানা বর্ণের আলোছায়ার তুলি। এইখানে নির্জন-সজনের নিত্যসংগম চলছিল আমরা জীবনে। অহরহ সুখ দুঃখের বাণী নিয়ে মানুষের জীবনধারার বিচিত্র কলরব এসে পৌঁচাচ্ছিল আমার হৃদয়ে। মানুষের পরিচয় খুব কাছে এসে আমার জাগিয়ে রেখেছিল। তাদের জন্য চিন্তা করেছি, কাজ করেছি, কর্তব্যের নানা সংকল্প বেঁধে তুলেছি—সেই সংকল্পের সূত্র আজও বিচ্ছিন্ন হয়নি আমার চিন্তায়। সেই মানুষের সংস্পর্শেই সাহিত্যের পথ এবং কর্মের পথ পাশাপাশি প্রসারিত হতে আরম্ভ হল আমার জীবনে। আমার বুদ্ধি এবং কল্পনা এবং ইচ্ছাকে উন্মুখ করে তুলেছিল এই সময়কার প্রবর্তনা, বিশ্বপ্রকৃতি এবং মানবলোকের মধ্যে নিত্যসচল অভিজ্ঞতার প্রবর্তনা। এই সময়কার প্রথম কাব্যের ফসল ভরা হয়েছিল ‘সোনার তরীতে। তখনই সংশয় প্রকাশ করেছি এ তরী নিঃশেষে আমার ফসল তুলে নেবে, কিন্তু আমাকে নেবে কি।”

কবির সূচনা পর্বের মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে কবিতাটির সম্বন্ধে ব্যাখ্যামূলক যে সব আলোচনা হয়েছে তা দেখা যাক—

১। এ নদীতে একমাত্র কান্ডারী কালতরঙ্গপরাজয়ী অপ্রতিহত শক্তি ঈশ্বর। তাঁকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করা যায়, কিন্তু দৃষ্টির বাইরে। মাঝে মাঝে ক্ষণিকের জন্য তাঁর দেখা পাই, কিন্তু চিরদিনের জন্য নয়—তাঁকে ভালো করে চিনে নিবে কীরূপে তাঁরই আশ্রয় লওয়া যাক। তাই কবির জীবনের কাজগুলি তাঁকেই অর্পণ করা হয়েছে। 

২। ‘সোনার তরী’ রবীন্দ্রনাথের সাধনতরী এবং তার নেয়ে অসীমতার অর্ধস্ফুট জ্ঞান। কৃষকের অপরাধ—সে সোনার তরী দেখা মাত্রই নেয়ের কাছে আত্মসমর্পন না করে নিজের ছোটো খেতের তুচ্ছ ফসল দেখিয়ে বলেছিল—‘যত চাও তত লও তরণী’ পরে। সে এই গবোক্তি না করে যদি বলত—‘এখন আমারে লহ করুণা করে’ তবে তাকে শূন্য নদীতীরে পড়ে থেকে কাঁদতে হত না।

৩। তাঁর পার্থিব যত কিছু তাঁর সমষ্টি ওই ‘সোনার’ ধানগুলি। আর ওই সোনার ধান ‘চিনি মাঝি’ কে দান করে কবি যখন বলছেন,–‘আমার লহ করুণা করে’—তখন ভগবদ্ গীতার নিষ্কাম কর্ম সম্পূর্ণ হচ্ছে।

আবার রূপকার্থের উন্মোচন প্রয়াসেও সোনার তরী কবিতাটির আলোচনা আছে : তা হচ্ছে : পৃথিবীর চারিদিকে আমার যা কিছু দেখছি—তা যুগযুগান্তরে মানবের কর্মসঞ্চিত সাধনার ফল। কিন্তু সে-মানব কোথায় যে তার সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে বস্তূতে রূপ দিয়েছে, ভাষায় সুর দিয়েছে। কালস্রোতে তার সোনার ধান নৌকা বোঝাই করে নিয়ে যায়, কিন্তু মানুষকে একলা ফেলে যায়, তাকে নৌকায় স্থান দেয় না। ‘সোনার তরী’ কবিতায় মানব জীবনের সেই ট্র্যাজিডি কবি ব্যক্ত করেছেন।

সর্বশেষে ‘সোনার তরী’ কাব্যগ্রন্থে ‘সোনার তরী’ কবিতার ব্যাখ্যা সম্বন্ধে কবি নিজেই বলেনঃ “এ সমস্ত ব্যাখ্যাকে ধিক। কবিতার রস এই ব্যাখ্যার ওপরেই যদি নির্ভর করে তবে ইহা বৃথাই লিখিত হইয়াছিল। মনে করো না কোনোই বিশেষ অর্থ নাই ; কেবল বর্ষা, নদীর চর, কেবল মেঘলা দিনের ভাব, একটা ছবি, একটা সংগীত মাত্রই যদি হয় তাহাতে ক্ষতি কী?”

রবীন্দ্রনাথের এই শেষের কথাটুকু বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ‘শান্তিনিকেতন’ গ্রন্থের ‘তরী বোঝাই’ শীর্ষক ভাষণে (৪ চৈত্র ১৩১৫) রবীন্দ্রনাথ ‘সোনার তরী’র ব্যাখ্যায় বলেছেন— “প্রত্যেক মানুষ জীবনের কর্মের দ্বারা সংসারকে কিছু না কিছু দান করছে, সংসার তার সমস্তই গ্রহণ করছে, রক্ষা করছে, কিছুই নষ্ট হতে দিচ্ছে না। কিন্তু মানুষ যখন সেইসঙ্গে অহংকেই চিরন্তন করে রাখতে চাচ্ছে, তখন তার চেষ্টা বৃথা হচ্ছে। এই যে জীবনটি ভোগ করা গেল অহংটিকে তার খাজনা স্বরূপ মৃত্যুর হাতে দিয়ে হিসাব চুকিয়ে যেতে হবে—ওটি কোনোমতেই জমাবার জিনিস নয়।”

আবার ‘সোনার তরী’ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে লিখেছেন, আমার মনে ‘সোনার তরীর’ যে ইতিহাসকে সত্য হয়ে গেছে সেটা হচ্ছে সেই শ্রাবণ-দিনের ইতিহাস, সেটা যে কোন্ তারিখে লিখিত হয়েছিল সেইটেই আকস্মিক—সে দিনটা বিশেষ দিন নয়, সে দিনটা আমার স্মৃতিপটে কোনো চিহ্ন দিয়েই যাইনি। অতএব, আমার ইতিহাসে আর তোমাদের ইতিহাসে এইখানে বাদ-প্রতিবাদ হবেই ; দুর্ভাগ্যক্রমে তোমাদের ইতিহাসে এইখানে বাদ-প্রতিবাদ হবেই ; দুর্ভাগ্যক্রমে তোমাদের হাতে দালাল আছে, আমার হাতে নেই। আদালতে তোমাদের জিত রইল। আমার দলিলের তারিখ কবিতার অভ্যন্তরেই আছে—’শ্রবণ গগন ঘিরে ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে। তুমি বলবে ওটা কাল্পনিক; আমি বলব তোমাদের তারিখটা রিয়ালিটিকে।”

‘সোনার তরী’ কাব্যে কেউ কেউ জীবন দেবতার পূর্বভাস লক্ষ্য করছেন। এ সম্বন্ধে E. J. Thompson স্পষ্টই বলেছেন: “It is Jivan Devata entering his work: The genius of his life and effort crossing the world stream in his Golden Boat. The prevailing theme of the poem is the immanence of the universal in the common and particular. The poem is haunted by a sense of the transitoriness of life.”

মোহিতলাল মজুমদারও ‘সোনার তরী’ কাব্যের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন—তাতে তিনি জীবন দেবতা তত্ত্বকে প্রাধান্য দান করেছেন। সোনার তরী নিয়ে যে পুরুষটিকে কবি আসতে দেখেছেন এবং ‘দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে’, বলে যাকে উল্লেখ করেছেন—সেই নাবিক যেন কবির সমগ্র কবি-চৈতন্যকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি কখনও নারী কখনও পুরুষের রূপে কবির কাছে উপস্থিত হন।

আবার কিছু কিছু সমালোচক মনে করেন সোনার তরীর নাবিককে ‘জীবনদেবতা’ বলা ঠিক হবে না। কারণ রবীন্দ্রনাথ যখন এই কবিতাটি রচনা করেন, তখন তাঁর মনে ‘জীবনদেবতা’ তত্ত্বে উদ্ভব হয়নি। জীবনদেবতা তত্ত্বের বিকাশ ও প্রকাশ ঘটে এই কবিতা লেখার তিন-চার বছর পরে, যখন তিনি ‘চিত্রা’র অন্তর্যামী এবং ‘জীবনদেবতা কবিতা দু’টি লেখেন, তখন। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথ নিজে এই কবিতাটির প্রসঙ্গে যে সব আলোচনা করেছেন সেখানে কোথাও তিনি উহার ইঙ্গিত দেননি।

এই কবিতাটি নিয়ে পাঠকমহলে দ্বিধার কারণ হল কবি এই কবিতায় স্পষ্ট করে কিছু বলেনি, আকারে ইঙ্গিতে, আভাসে ও ব্যঞ্জনার মাধ্যমে কবি সৌন্দর্যবোধের জন্যে রোমান্টিক মানসের আর্তি ব্যক্তি করেছেন। কবির যৌবন বয়সের লেখা কাব্য তখন রোমান্টিক মানসের আর্তি ব্যক্ত করেছেন। কবির যৌবন বয়সের লেখা কাব্য তখন রোমান্টিক কল্পনার উচ্ছ্বাসে তাঁর মন আপ্লুত। তাই কবির অন্তরের আনন্দময় উপলব্ধিটুকু পাঠক সহসা বুঝে উঠতে পারেনি। কেননা বিষয় প্রধান বা অর্থ সমন্বিত কাব্যপাঠেই পাঠক যেখানে অভ্যস্ত, সেখানে আত্মতন্ময় কবিতার রস পরিপাক করা সহজ নয়। কবিতার গূঢ় অর্থকে ধরবার চেষ্টা করেই পাঠক কাব্যে উৎকর্ষ অপকর্য বিচার করে থাকত, সে জায়গায় কল্পনা বিলাসের ও সৌন্দর্যতত্ত্বের কথায় পরিপূর্ণ কবিতার রসাস্বাদ করা কিছু কঠিন।

কথা সাহিত্যেক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ‘সোনার তরীকে’ প্রেম কল্পনামূলক রচনা বলে মনে করতেন। আবার বলেছেন সোনার তরীর নেয়ে-ই হচ্ছেন ভগবান। তাঁদের মতে, ভগবান আমাদের কর্মফল গ্রহণ করেন, আমাদের নেন না। ভগবান পরমাত্মা, অথবা জীবাত্মা—তাই জীবাত্মাকে তিনি নেন না। এই ব্যাখ্যাও সমীচীন নয়। রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বর বিশ্বাসী কবি কিন্তু ‘সোনার তরী’ কবিতায় ঈশ্বর চিন্তা নেই, যদি তা থাকত, তবে তাঁর ব্যাখ্যাতেই তার সূত্র সন্ধান পাওয়া যেত।

‘সোনার তরী’র রূপক ব্যাখ্যায় ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, “এই তরী উহার হিরণ্য-দ্যুতিতে কবির কাব্য সার্থকতার উজ্জ্বল প্রতিকৃতির ও উহার অবিরাম চলিষ্ণুতায় কবিমনের দূরাভিসারের দ্যোতনায় নিগূঢ় অর্থবহ। তাই ‘সোনার তরী’কে রূপক কবিতা হিসাবেও ব্যাখ্যা করা যায়। কৃষক হল মানুষের প্রতীক। এই কৃষকের ক্ষেত্র হল আয়ুর দ্বারা সীমাবদ্ধ মানব জীবন। পদ্মার স্রোতকে কালস্রোত বলা যায়। সোনার ধান—যা কৃষকের দ্বারা উৎপন্ন তা হচ্ছে মানুষের শ্রমের ফসল, নাবিক হচ্ছে মহাকাল।

উপরোক্ত অভিযোগ ও বিরুদ্ধে সমালোচনা সত্ত্বেও কবিতাটি যে পাঠকের হৃদয়ে রস উপভোগে সহায়তা করেছে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বিভিন্ন সমালোচক বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এ ব্যাখ্যা করেছেন সত্য, কিন্তু এটির কাব্যমূল এর ব্যাপকতা সম্বন্ধে কোনো মতৃবিরোধ নেই। সর্বশেষে বলা যায় করিব নিজস্ব ব্যাখ্যাটি আসল ব্যাখ্যা। আমাদের ভালো কাজগুলিই এ সংসার গ্রহণ করে। যে কাজে বিশ্বের পক্ষে মঙ্গলকর সেইটিই হচ্ছে আমাদের সোনার ফসল। যুগ যুগ ধরে সোনার ফসল ফলিয়ে বিশ্বকে সুন্দর করেছে মানুষ। সমাজ সেই কাজগুলিকেই মনে রাখে, মানুষকে নয়।