জীবনানন্দ দাশ একসময় বলেছিলেন—“শ্রেষ্ঠ ধর্মসাধনা এমনকি শ্রেষ্ঠ শিল্পসাধনা কি তা নয় যা বহুর স্খলন এবং ক্ষরণ এবং অসামঞ্জস্যের বিষয় থেকে ধীরে ধীরে জ্যামিতির—এবং যেখানে মহত্তর জ্যামিতি আর জ্যামিতি নয় শুধু—সমন্বয় ও সৌন্দর্য খুঁজে নিতে পারে?” (‘কবিতার কথা’)

বস্তুতপক্ষে একথা ঠিক, ধর্ম-বিষয় মাত্রেই কাব্য নয়। Theology এবং Art— ধর্মতত্ত্ব এবং কলাকর্মে পার্থক্য আমূল। তবু ধর্মের সঙ্গে কাব্যের ঘনিষ্ঠতার কারণ— মানুষের সনাতনী চিত্তবিক্ষেপ অর্থাৎ আস্তিক্যবোধ ইত্যাদিকে লক্ষ্য করে উভয়েরই প্রথম সূচনা এবং বিকাশলাভ। দুই, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মতবাদে আবর্তিত কার্যধারার মত নানামুখী সম্প্রদায় ও তত্ত্বের উপলব্ধিতে ধর্মের মধ্যেও একটি বিবর্তনধর্মিতা দেখা যায়। তিন, কবি-হৃদয় যেমন সমাজ বা জীবন-ব্যাধির দর্শনের পর তাকে প্রকাশের দায়িত্বে উদ্বুদ্ধ হয়, তেমনি ভব-যন্ত্রণা থেকে উদ্ধারের উপায় উপলব্ধি করে সাধকও পরবর্তীজনের প্রয়োজনে তাকে প্রকাশ না করে পারেন না। আর সেইজন্যই পৃথিবীর সব দেশে কাব্যের আত্মস্ফূরণে প্রধান ভূমিকা নিয়েছে ধর্মচেতনা।

নাথসাহিত্য প্রধানত কায়াসাধনার ধর্মনৈতিক উদ্দেশ্যে রচিত। নাথপন্থের যোগ, তন্ত্রমন্ত্র, তুকতাক ইত্যাদির সঙ্গে শৈব ও বৌদ্ধতন্ত্রের নানা উপসর্গ যুক্ত হয়েছিল।

নাথযোগী সম্প্রদায় মূলতঃ শৈববাদী বলে পণ্ডিতজনের অনুমান; রুদ্রাক্ষ, ত্রিপুণ্ড চিহ্ন, ত্রিশূল, শিবরাত্রি উৎসব ইত্যাদি অনুষঙ্গ ছাড়াও দেখা যায় শিব এঁদের আদিগুরু বা আদিনাথ। তবু এই সম্প্রদায়ের ‘নাথ’ নামকরণ ইতিহাস অস্পষ্ট। এঁরা জানেন, “গুরু সাচা পিণ্ডিকাচা”, “সদ্গুরু ভজিল তবে আত্মমা পরিচয়”। তন্ত্রের প্রভাবে কৌলমাগী রূপেও এঁরা এক সময় সম্মানিত হয়েছিলেন। তন্ত্র ও যোগধর্ম দেহাশ্রিত— “ব্রহ্মাণ্ডে যে গুণাঃ সন্তি তে তিষ্ঠ্যন্তি কলেবরে।” যোগের মূল কথা, মানবদেহ ও মন। যোগীর কাছে “পিশুপাতে চ য মোক্ষঃ স চ মোক্ষঃ নিরর্থকঃ।”

তাই ‘পবনবিজয়’, ‘বিন্দুধারণ’ ইত্যাদি যোগাচারী ক্রিয়াকলাপের দ্বারা সাধক এই ‘পিণ্ডদেহ’-কে ‘সিদ্ধ’ বা ‘পক্কদেহে’ পরিণতি দানে প্রয়াসী। এর ফলে একদিকে যেমন জীব জরা-মরণের অতীত অবস্থা লাভ করে, তেমনি গুরু-নির্দেশিত ‘পবন নিশ্চাঞ্চল্য’, ‘যম’ নিয়মাদি অনুসরণের মাধ্যমে দ্বৈতানুভূতির পরপারে গিয়ে প্রাতিভাসিকে’র অতীত উপলব্ধি বা সাধকের ‘মহাজ্ঞান’ প্রাপ্তি ঘটে। “নাথধর্ম নিরীশ্বরবাদী; কিন্তু গুরুকে ইহা ঈশ্বরের তুল্য স্থানই দিয়া থাকে” (দ্রষ্টব্য : ‘গোপীচন্দ্রের গান’, ভূমিকা, ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য সম্পাদিত)।

নাথসাহিত্যের তাই দেহের অস্বীকারে নয়, ঈশ্বরবোধের প্রবল বিশ্বাসেও নয়, কামদ্বীপে নির্বাসিত সত্তাকে জাগাতে শুধু শোনা যায় ‘কায় সাধ কায় সাধ’ ডাক; ঈড়া পিঙ্গলা-সুষুম্নার পাকদণ্ডী পথে ‘নাদবিন্দুর’ খোঁজে চিত্তবৃত্তি সংযমের একাগ্রতায় নাথযোগী মূলতঃ ব্যক্তি-মুক্তি সন্ধানী। কাহিনীটি ভারতীয় শাস্ত্রের ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। ড. সুকুমার সেন জানিয়েছেন : “The story of the beginning of the creation according to the traditions of the Natha cult, shows remarkable affinity with the Rigvedic-hymn of creation (R.V.X. 129) and the opening lines of the Manu Sanihita (“The Natha Cult”, The Cultural Heritage of India’. Ibid p. 281)” এই নাথ-সম্প্রদায়ের কাহিনী থেকেই জানা যায়, পুরাণ-কথিত ভাসম্ভ, এক অলৌকিক বিকৃত শবের ভস্ম থেকেই নাথধর্মের পাঁচজন ‘আদিসিদ্ধা’র উদ্ভব হয়েছিল। মীননাথ প্রথম ‘নাথ’ বলে স্বীকৃত।

নাথ সম্প্রদায়ের উদ্ভব ও শাখা:

ভারতের উত্তর এবং বিশেষত উত্তরবঙ্গ অঞ্চল থেকেই এই গোষ্ঠীর উৎস উপাদান প্রাচীন এবং মধ্য বাংলা সাহিত্যে পাওয়া যায়। এমন কি পরবর্তীকালে বিহার, উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব, সিন্ধু, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান প্রভৃতি অঞ্চলে প্রাপ্ত এই সম্প্রদায়েরই বিভিন্ন উপাদানেও দেখা যায়, ধর্মাচার্যরা অধিকাংশতই বাঙালী। বাংলাদেশে নাথসাহিত্য প্রধানত তিনটি ধারায় বিস্তারলাভ : গোরক্ষনাথ বৃত্ত, গোবিন্দচন্দ্র আখ্যান এবং যুগী-কোচদের স্মৃতি-নির্ভর ধারণা।

গোরক্ষনাথ বৃত্ত: “তুমি কেন তর গোঁসাই আমি কেন মরি’”—গৌরীর নাথধর্মের “সভানের গুরু শিবের” কাছে এই তাত্ত্বিক কৌতূহল থেকেই কাব্যে গল্পের ‘গতি ‘চৌদ্যুনে’ চলেছে, তারপর মীননাথের গোপনে মীনরূপে জ্ঞানার্জন, মহাদেবের বিস্মৃতির অভিশাপ, গৌরীর পরীক্ষায় সিদ্ধাচার্য, মীননাথ, হাড়ীপা, কানুপার ইন্দ্রিয়াশক্তি ও শাপবদ্ধ জীবনযাপন করে, গোরক্ষনাথের গুরু-উদ্ধার ইত্যাদি ঘটনার বহুমুখী বৈচিত্র্য দেখা যায়। কাহিনীটি পূর্ণাবয়ব, সুগঠিত এবং সঙ্গতিপূর্ণ। মহৎ কাব্যসৃষ্টির কাহিনীগত সম্ভাবনা লক্ষ্য করা যায়।

শিষ্য চেষ্টায় ভ্রষ্ট গুরু-উদ্ধারের অভিনব আখ্যান শুধু নয়, চরিত্র নির্মাণে কিছু কুশলতাও ফয়জুল্লা, ভীমদাস, কবীন্দ্র, ভবানীদাস প্রমুখ গ্রাম্য কবি-গায়কদের মধ্যে দেখা যায়। মহাদেব, পার্বতী, কদলী রমণীগণ বা গর্ভেশ্বর রাজকন্যা ইত্যাদি গৌণ-চরিত্রগুলি অবশ্য রুচির শুচিতায় সর্বত্র স্মরণীয় নয়, তবু জীবনী শক্তির পরিচয়দানে প্রাণবস্তু হয়েছে। আসলে, এখানে কবিদের কাম-কল্পনা কোনো সনাতনী নৈতিকতা বা বৈষ্ণব কবির মত কোনো কার্ত্তিক বিশুদ্ধতায় নিয়ন্ত্রিত হয় নি। সমগ্র হিন্দুপুরাণেই এটি একটি বিচিত্র ব্যাপার যে, ঊর্দ্ধরেতা বলে যাঁরা শ্রদ্ধেয় (যেমন ভরদ্বাজ ও ঘৃতাচী, বিশ্বামিত্র মেনকা, ব্যাস-ঘৃতাচী ও ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর), তাঁদের এককালে কামাতুর হিসেবে দেখানো। কামচর্চা থেকে মীননাথের চিত্তমুক্তির জন্য কদলীর দেশে নর্তকীবেশে গোরক্ষনাথের কণ্ঠে তাই তত্ত্ববদ্ধ প্রহেলিকার সুর বেজে উঠছে—“নগরে মনুষ্য নাই ঘর চালে চালে। আন্ধলে দোকান দেয় খরিদ করে কালে”

এই নাথ সম্প্রদায় কাহিনী থেকেই জানা যায়, পুরাণ কথিত ভাসস্ত, “সেই অলৌকিক শবের ভস্ম থেকেই নাথধর্মের পাঁচজন আদিসিদ্ধার উদ্ভব হয়েছিল। মীননাথ ‘নাভি’ থেকে, গোরক্ষনাথ ‘খুলি’ বা অন্য ব্যাখ্যায় (ঝাড়, ঘাম বা মল থেকে), হাড়িপা ‘হাড়’ থেকে, কানু-পা ‘কান’ থেকে, এবং চৌরঙ্গিনাথ পা থেকে উদ্ভূত হন।” গোরক্ষনাথের চরিত্রটি সাধনমার্গের শ্রেষ্ঠতম আদর্শের প্রতিভূ। তবু মনে হয়, যেন কিছুটা নিয়ম-নির্মিত; তুলনায় মীননাথ-চরিত্রটি কিন্তু ধর্মাদর্শের নিছক নিদর্শন নয়, মানুষী দুর্বলতার প্রকাশে অনেক স্বাভাবিক। ‘কথাসরিৎসাগর’-এ হর-পার্বতীর গল্পের শ্রোতা পুষ্পদত্তের মত ‘মহাজ্ঞান’-অর্জনের জন্য তার অদ্ভুত প্রচেষ্টা, পার্বতীর ছলনায় পদস্খলন, তারপর নর্তকীবেশী শিষ্যকে দেখে বৃদ্ধ বয়সেও কামাসক্তি, অন্ধ পুত্রস্নেহ ইত্যাদি দুর্বলতার পরিচয়ে তার চরিত্র যোগসম্মত না হোক, জীবনসঙ্গত হয়ে উঠছে। আর সেই কারণে এই আখ্যান তত্ত্বের আবরণে বদ্ধ হয়েও অনেকখানি সাহিত্যিক স্বাদুতা এসেছে।

তবু এই আখ্যানের কয়েকটি শিল্পগত ত্রুটি অনুপেক্ষণীয়—(১) গোরক্ষনাথ এবং অন্যান্য সিদ্ধাচার্যদের যোগশক্তি প্রকাশের জন্য আখ্যানটির অষ্টাঙ্গে অলৌকিকতার কুণ্ঠাহীন প্রকাশ। (২) মীননাথ, পার্বতী ইত্যাদি মানুষ এবং দেব-চরিত্রের মধ্যে বা আখ্যানের প্রায় সর্ব-স্থানে কামাশক্তির অতিবাদ লক্ষণ সুস্পষ্ট। (৩) নারী-চরিত্র এই আখ্যানে যেন শুধু পাপ, ছলনা ও শঠতার প্রতীক; গ্রাম্য ও ধর্মান্ধ কবি-ধারণার সঙ্গে নারীর কল্যাণী ও মঙ্গলময়ী মূর্তির কোনরকম সামঞ্জস্য ঘটেনি।