“ভারতবর্ষে লৌকিক সংস্কৃত সাহিত্যের প্রকৃত প্রবর্তক-এর মর্যাদা প্রাপ্য মহাকবি কালিদাসেরই” বলেছিলেন প্রখ্যাত ভারত তত্ত্ববিদ মহামনীষী ম্যাক্সমুলার। বৈদিক যুগের থেকে সুদীর্ঘকাল ছিল সাহিত্যের ‘বন্ধ্যা যুগ’। কালিদাসের কাল থেকেই দেখা যায় পুনর্জাগরণ এবং কালিদাসের রচনার গুণেই তা সমৃদ্ধ যুগে রূপান্তরিত হয়। সংস্কৃত সাহিত্যের প্রবাদ-পুরুষ কালিদাস কথাটা সর্বান্তকরণেই স্বীকৃত, কারণ প্রবাদ প্রচলিত ও ইতিহাস স্বীকৃত-রাজা বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভার অন্যতম রত্নরূপে কালিদাস সুপ্রতিষ্ঠিত। কাব্য রচনার সাথে সাথে নাট্যকার রূপেও বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, নাটক সম্বন্ধে একালের যে ধ্যান-ধারণা, সেই মানদণ্ডে কালিদাসের নাটককে বিচার করলে অবিচার করা হবে। কারণ একালের নাটক বা পাশ্চাত্যের নাটক বিচার পদ্ধতিতে ঘটনা সংঘাত নাটকীয়তা আদি যে ভূমিকা গ্রহণ করে, প্রাচীন ভারতীয় নাটকে তাদের স্থলবর্তী হয়েছে ভাবাবেগ ও রসোদ্বেলতা, প্রাচ্যমতে, নাটকও কাব্য শ্রেণিভুক্ত—’কাব্যেষু নাটকংরম্যম’ কাজেই নাটকের কাব্যগুণ প্রাচ্য আলংকারিকদের নিকট যেভাবে প্রশংসিত হয়, আধুনিক কালে তা হয় না। অতএব এ বিষয়ে সচেতন থেকেই কালিদাসের নাটক বিচারে অগ্রসর হওয়া উচিত।

কালিদাস মূলত তিনখানি নাটক রচনা করেছিলেন। তাঁর প্রথম নাটক হল—

মালবিকাগ্নিমিত্রম : বিদর্ভের রাজ্যভ্রষ্ঠ রাজা মাধব সেন স্বীয় ভগিনী মালবিকাকে বিদিশাধিপতি অগ্নিমিত্রের হস্তে সমর্পণের উদ্দেশ্যে তাকে বিদিশায় প্রেরণ করলে পথিমধ্যে তিনি দস্যু হস্তে আক্রান্ত হন, বিদিশার সেনাপতি বীর সেন তাঁকে দস্যুহস্ত থেকে উদ্ধার করে রাজমহিষী ধারিণীর পরিচারিকারূপে নিযুক্ত করেন। অগ্নিমিত্র মালবিকা দর্শনে তার প্রতি আকৃষ্ট হলে রাজমহিষী তা জানতে পারেন এবং মালবিকাকে কারারুদ্ধ করেন। বিদষকের সহায়তায় রাজা অগ্নিমিত্র মালবিকাকে কারাগার থেকে উদ্ধার করেন। ওদিকে রাজ্যচ্যুৎ মাধব সেনও রাজ্য পুনঃপ্রাপ্ত হন। মহিষী ধারিণী মালাধিকার প্রকৃত পরিচয় অবগত হয়ে স্বেচ্ছায় অগ্নিমিত্রের সঙ্গে তার বিবাহের ব্যবস্থা করেন। এই হল এ নাটকের কাহিনি বস্তু।

এ নাটকটিকে কেবলমাত্র একটা প্রেম কাহিনি বলে মনে করলে ভুল হবে—এই নাটকে তৎকালীন রাজঅন্তঃপুরের বিলাসময় জীবনের প্রতি ব্যঙ্গ আছে, মানব চরিত্রের সংকীর্ণতা ও মহত্বের পরিচয় আছে, আর আছে মানবজীবন, বিশেষ করে ধনী ব্যক্তিদের চরিত্র-চিত্রণে অপূর্ব দক্ষতার পরিচয়। সুতরাং সবদিক বিচার করে এই নাটকটিকে কালিদাসের অপরিণত রচনা বলা কোনোমতেই সম্ভব নয়। এটি তাঁর প্রথম রচনা হলেও পরিপক্ক হাতেরই কাজ।

বিক্রমোর্বশী (বিক্রম + উর্বশী) : শিব পূজান্তে কৈলাস থেকে প্রত্যাবর্তন কালে অপ্সরা উর্বশী দৈত্যহস্তে যখন নিপীড়িতা, তখন সূর্য পূজান্তে প্রত্যাবৃত্ত রাজা পুরুরবা তাকে দেখতে পেয়ে উদ্ধার করেন এবং অল্প দিনের মধ্যেই উভয়ে প্রেমে পড়েন। পুরুরবার প্রতি তন্ময়তা বশত অভিনয় কালে একদা উর্বশী ভুল করলে আচার্য ভরত তাকে অভিশাপ দেন স্বর্গে তার স্থান হবে না। দেবরাজ ইন্দ্র সেই অভিশাপ বরে রূপান্তরিত করে পুরুরবা পুত্রমুখ না দেখা পর্যন্ত মর্ত্যে উর্বশী তাঁর সঙ্গে সংসার জীবনে রত থাকবেন এমন নির্দেশ দিলেন। যথা সময়ে পুরুরবা পুত্রমুখ দর্শন করলে উর্বশীর শাপমোচন হওয়াতে তার স্বর্গে ফিরে যাওয়ার আয়োজন শুরু, পুরুরবা মনভরে বাণপ্রস্থ অবলম্বনে সম্মত হলেন কিন্তু নারদ সংবাদ আনলেন দেবসুরের যুদ্ধে তাঁকে সহায়তা করতে হবে। ফলত ইন্দ্র চিরকাল উর্বশীকে পুরুরবার সহধর্মিণী রূপে থাকবার আদেশ দিয়েছেন।

বিক্রমোর্কশী, নাটকে কালিদাসের নাট্যকল্পনার অগ্রগতি দেখা যায়, বেদ পুরুষ, শোককথা—যেখান থেকেই তিনি উপাদান সংগ্রহ করুন না কেন কাহিনি গ্রন্থনে তিনি মৌলিকতা দেখাতে পেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ উর্বশী কবিতায় যেকথা বলেছেন তা এখানে উর্বশীর ‘বধূ’ রূপটির পরিচয় আছে বটে তবে তা অর্ধসমাপ্ত। উর্বশীর প্রেমে না আছে স্বভাবের সংযম, না আছে মাতৃত্বের গৌরব—আছে কেবল স্বার্থপরতা, নায়ক পুরুরবার প্রেমিকা সত্তার পরিচয় পাওয়া গেলেও তার রাজোচিত মহিমা প্রেম পারবশ্যতার জন্য ক্ষুণ্ণ হয়েছে। তাই সবদিক দিয়ে বিচার করেই বলতে হয়—“নাটকটি যেন বর্ণহীন অতি সরল কাহিনি রূপে পরিসমাপ্তি লাভ করেছে।”

অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ : এ নাটক কালিদাসের তথা সংস্কৃত সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ নাট্যকৃতির নিদর্শন। বিষয়বস্তু মহাভারত থেকে সংগৃহীত হলেও কাহিনি গ্রন্থন ও চরিত্র চিত্রণে কালিদাস যথেষ্ট মৌলিকতার পরিচয় দিয়েছেন। মহাভারতের সহজ সরল কাহিনি কালিদাসের দক্ষ হাতে নানারকম জটিলতার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে পরিণত লাভ করেছে। অথচ কোনো চরিত্র কোনো ঘটনাই অবিশ্বাস্য, অবাস্তব মনে হয়নি। মহাভারতের দুষ্মন্তের পূর্বকথা মনে এলেও তিনি সপুত্র শকুন্তলাকে না চিনতে পারার ভান করে মিথ্যাবাদী হয়েছেন— কালিদাস অপূর্ব উপায়ে রাজার চরিত্রটি রক্ষা করেছেন, তিনি দুর্বাসার শাপের প্রসঙ্গটি এনে নাটকে নতুন তাৎপর্য এনে দিয়েছেন, নাটকের নামকরণকালেই তিনি অভিজ্ঞান, অর্থাৎ রাজার নামাঙ্কিত অঙ্গুরীয়টির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন—এই আংটি শকুন্তলা তথা দুষ্মত্তের জীবনের সুখ, দুঃখ এবং পুনর্মিলনের আনন্দের কারণ হয়েছে। ড. সুকুমার সেন এ প্রসঙ্গে বলেছেন : “শকুন্তলার কাহিনি এই আংটির ছোঁয়াতেই অসামান্যতা পাইয়াছে।”

সমাপ্তি অংশে বলতে হয়, কালিদাস বিরচিত মালবিকাগ্নিমিত্রম, বিক্রমোর্কশীয়ম ও অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ তিনটি নাটকই রোমান্টিক প্রেমমূলক ও মিলনাস্তক, নাট্যকার রূপে কালিদাসের কৃতিত্বের কথা স্বীকার করেও বলা চলে কালিদাস জীবনের জটিল সমস্যার বিষয়ে উদাসীন ছিলেন এবং ভাগ্য বিপর্যয় দুঃখের চিত্র অংকনে বিরত ছিলেন। তিনি ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতিতে, কর্মফল, জন্মান্তরবাদ বিশ্বাসী ছিলেন এবং মানবজীবন এক শুভ দৈবের কল্পনা করে সন্তুষ্ট ছিলেন। তাঁর নাটকে তথা সংস্কৃত নাটকে কখনও বিয়োগান্তর কোনো বিপর্যয় দেখা দেয়নি, তার কারণ মঞ্চে মৃত্যু, হত্যা, যুদ্ধ প্রভৃতি দুঃখদায়ী ঘটনার প্রদর্শন সেকালে নিষিদ্ধ ছিল, তাই তিনি জীবনের রোমান্টিক অনুভূতির আনন্দময় প্রেম মিলনের পথ ধরেই অগ্রসর হয়েছে। এই স্বক্ষেত্রে বিচরণ তাঁকে চরম সার্থকতা এনে দিয়েছে যার ফলে শকুন্তলার মতো বিশ্ববন্দিত নাট্য রচনার স্রষ্টারূপে তিনি কালজয়ী অমরত্বের অধিকারী হতে পেরেছেন।