বিপ্লবী ভাবনা ও আঙ্গিকের বৈচিত্র্যে বার্নার্ড শ’য়ের নাটকাবলী ইংরেজী নাট্যসাহিত্যে অনন্য মর্যাদায় ভূষিত।—বিচার করো।
বার্নার্ড শ’ নাট্যকার হিসেবেই বিশ্ববিখ্যাত। কিন্তু তাঁর অন্যান্য গদ্য রচনার সঙ্গে প্রায় প্রতিটি নাটকের ভূমিকা (Preface) রূপে গদ্যে লিখিত যে আলোচনা রয়েছে তাতে গদ্য শিল্পীরূপে তাঁর বৈশিষ্ট্যও কম নয়। তাঁর মূল নাটক ও নাটকের ভূমিকা (Preface) কৌতূহলী পাঠকের কাছে সমান আকর্ষণীয়। নিরলস পরিশ্রমী, চিন্তাশীল এই বিতর্কিত মানুষটি তাঁর সময়েই প্রবাদ পুরুষ হয়ে উঠেছিলেন।
শেক্স্পীয়রের এবং শেকস্পীয়রের পরবর্তীকালের নাটক যে পথে চলছিল, বার্নার্ড শ’র নাটক সেখানে এক নতুন ব্যতিক্রমের সৃষ্টি করল। প্রশ্ন তুললেন সমাজ সমস্যার বিভিন্ন দিক নিয়েই নয়, প্রশ্ন তুললেন নাটকের প্রচলিত আঙ্গিক নিয়ে। নাট্যক্রিয়া সৃষ্টিতে শুধু বহিরঙ্গ ক্রিয়া নয়, আলোচনাও যে মানসিক ক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে, তিনি হাতে কলমে তা দেখালেন, তাঁর হাতে Drama of action হল Drama of discussion।
সাহিত্যে নন্দনতত্ত্বেরও তিনি পৃষ্ঠপোষক ছিলেন না। ‘আর্ট ফর আর্টস সেক’ (art for arts sake) বা ‘শিল্পের জন্যই শিল্প’ এ জাতের তিনি সমর্থক ছিলেন না। ‘ম্যান এন্ড সুপার ম্যান’ নাটকের ভূমিকায় তিনি বলেছেন, শুধু শিল্পের খাতিরে আমি একটি লাইন লেখার কষ্টও স্বীকার করতে রাজী নই’। তাঁর মতে সাহিত্য জীবনের জন্য, সমাজ ও মানুষের মঙ্গলের জন্য। শিল্পের জন্য জীবন নয়, জীবনের জন্যই শিল্প। সমস্ত নাটক ও প্রবন্ধাবলীর মধ্য দিয়ে এই সমাজ ও মানুষের মঙ্গলচেতনায় উদ্দীপিত মানুষটি চলিত নীতি-নিয়ম সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন, বুদ্ধি ও মঙ্গলচেতনার কষ্টিপাথরে তাকে যাচাই করে নিয়েছেন এবং এইভাবেই ভিক্টোরিয় যুগের অন্ত্যপর্বে এবং বিশ শতকের প্রথম পাদে যে জিজ্ঞাসার যুগ (age of interrogation) শুরু হয়েছিল তিনি সেই যুগের একজন প্রতিনিধিমূলক নাট্যকার হয়ে উঠেছিলেন।
অন্তর্ভেদী দৃষ্টি নিয়ে সমাজের অন্তররূপটিকে প্রকাশ করে নিপুণ শল্য চিকিৎসকের মতো তাকে সামনে নিয়ে এসেছেন এবং নিরাময় করতে চেয়েছেন। তিনি তার্কিক, সমাজ-সংস্কারক ও দার্শনিক। কিন্তু সর্বোপরি তিনি নাট্যশিল্পী। রঙ্গমঞ্চ ও এর অঙ্গ রূপায়ণেও তিনি অসাধারণ নিপুণ। বক্তব্য পরিবেশনেও রয়েছে তাঁর মৌলিকতা। এর মধ্য দিয়েই তিনি জাতিকে তাঁর মতে দীক্ষিত ও উদ্দীপিত করতে চেয়েছেন। অবশ্য এর ফলে শ’-র নাটকগুলি হয়ে উঠেছে সমস্যামূলক নাটক (Problem Play)।
‘আমর্স এ্যান্ড দ্য ম্যান’ (Arms and the Man) নাটকে যুদ্ধ ও প্রেমের যথার্থ স্বরূপ নিরূপিত। যুদ্ধ প্রয়োজনীয় কিন্তু ভয়ঙ্কর। যুদ্ধের মধ্যে মহত্ব, বীরত্ব ও আদর্শের সন্ধান মানবচিত্তের নিদারুণ মৃঢ়তাকেই প্রকট করে। ‘মিসেস ওয়ারেন্স প্রফেসন্’ (Mrs. Warren’s Profession) নাটকে পতিতা সমস্যার স্বরূপ নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থনীতিগত তাড়নাই নারীকে দেহ বিক্রয়ে বাধ্য করে। এই পতিতাবৃত্তি সামন্ততান্ত্রিক ও ধনতান্ত্রিক সমাজের একটা কলঙ্কিত বৃত্তি। এই সঙ্গে তিনি মিসেস ওয়ারেনের মুখ দিয়ে স্পষ্ট ভাষায় বলিয়েছেন যে পেশা হিসেবে উনিশ শতকের কারখানার জীবন থেকে এ জীবন কোনো অংশে খারাপ নয়। এ বক্তব্য নিশ্চিত এক সাহসী ও সমাজ বিপ্লবীর বক্তব্য। ‘ইউডোয়ার্স হাউসেস্’ (Widower’s Houses) নাটকে একদিকে জীবনের ভয়াবহ দারিদ্র্য, অপরদিকে পীড়নকারীর স্ত্রী, মালিক ধনিক সম্প্রদায়ের ভদ্র জীবনযাপনের প্রয়াস তুলে ধরে সামাজিক বৈষম্যের নগ্নরূপকে প্রকাশ করেছেন। নাটকগুলির মধ্য দিয়ে সমাজের অন্তঃসারশূন্যতা দেখান ছিল। শ’-এর উদ্দেশ্য। বক্তব্যের দিক থেকে ‘ম্যান এন্ড সুপারম্যান’ নাটকটি উল্লেখযোগ্য। শ’-এর থিসিস স্বরূপ এই নাটকে নাট্যকার বলেছেন ইচ্ছাশক্তি ও জীবনীশক্তি—এই উভয়ের যোগে পৃথিবীতে একদিন অতিমানবের (Superman) আবির্ভাব ঘটবে। নাটকটিতে Life force মতবাদ প্রকাশিত। এই মতবাদই ‘ব্যাক টু মেথাসেলা’র সৃষ্টিকারক বিবর্তনের চরম প্রতিষ্ঠিত। এই ‘লাইফ্ ফোর্স’ একটা বিশেষ শক্তি যা মানুষকে উন্নততর ও পরিপূর্ণ জীবন অভিমুখে নিয়ে যায়। এরই প্রেরণায় নারী উচ্চতর জাতি সৃষ্টির জন্য অসাধারণ পুরুষকে আকর্ষণ করে। ধর্মান্ধতা ও দেশপ্রেম সম্পর্কে শ’ তাঁর সাহসী বক্তব্য তুলে ধরেছেন ‘সেণ্ট জোয়ান’ নাটকে। এইভাবেই শ’ চিরাচরিত ভাবনায় লক্ষণের গণ্ডীকে ভেঙে সমাজ ও জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজের বক্তব্যকে সুস্পষ্টভাবে দাঁড় করাতে চেষ্টা করেছেন। ফলে তাঁর বিপ্লবী ভাবনার যোগে শায়ের নাটকগুলি হয়েছে বক্তব্য প্রধান (drama of ideas)।
আঙ্গিকের দিক দিয়ে বার্নার্ড শ’ নাটকে প্রাচীন ও বিবর্তিত উভয়রূপই গ্রহণ করেছেন। নাট্যকার ইবসেনের প্রভাব তাঁর নাটকে রয়েছে। নাটকে নেপথ্য উক্তি, স্বগোতক্তি প্রভৃতি বর্জিত। আবার প্রাচীন নাট্যকলার অনুকরণে অলঙ্কার বহুল দীর্ঘ ভাবনারও প্রবর্তন করেছেন। নাটকীয় আঙ্গিকের বিচারে শ’-এর নাটকের উল্লেখ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে—(ক) নাটকের ভূমিকা (Preface) রচনা-যুক্তি-তর্ক, হাস্য-পরিহাস এবং তীক্ষ্ণ ভাষণের দ্বারা নাটকের বক্তব্য বিষয়কে সমর্থনের প্রয়াস। (খ) ক্লাসিক রীতির ত্রি-ঐক্য নীতি পরিত্যাগ। (গ) নাটকে গতি ও সংঘাতের স্বল্পতা লক্ষ্যণীয়। (ঘ) নাটকে বহির্দ্বন্দ্ব নয় অন্তর্দ্বন্দ্ব; মানসিক দ্বন্দ্ব ও আদর্শের সংগ্রামই এখানে মুখ্য। বাক্যদীপ্তি, মনচেতনা, বুদ্ধি ঝলকিত সংলাপ শ’-এর নাটকে বহির্দ্বন্দ্বের স্বল্পতা পূরণ করেছে। (ঙ) নাটকে সূক্ষ্ম মঞ্চ নির্দেশনার সহায়তায় বিষয় উপযোগী পরিবেশ মঞ্চসজ্জা প্রভৃতির সু-রূপায়ণের সংকেত রয়েছে।
কিন্তু এসব সত্ত্বেও তাঁর নাটক সবসময় প্রীতিপ্রদ হয়ে ওঠেনি। চরিত্রগুলি প্রাণময় আবেগদীপ্ত জীবনের প্রতিরূপ চরিত্র হয়ে ওঠেনি, হয়েছে নাট্যকারের মতবাদের বাহন—টাইপ চরিত্র। নাটকে যতটা চমক রয়েছে ততটা পরিতৃপ্তি নেই। তবুও ইংরেজী সাহিত্যে নাটকের বিবর্তনের ইতিহাসে নাট্যকার জর্জ বার্নার্ড শ’ এক স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব এবং অনস্বীকার্য প্রতিভা।
Leave a comment