রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলােচনায় অধিকার ও কর্তব্যের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কর্তব্যহীন অধিকার বলে কিছু থাকতে পারে না। অনুরূপভাবে অধিকারহীন কর্তব্যও কাম্য নয়। রাষ্ট্রব্যবস্থায় উভয়ই একান্ত অপরিহার্য। অধিকার ও কর্তব্যের পারস্পরিক সম্পর্কের প্রধান দিকগুলি হলㅡ

[1] পরস্পর অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত: অধিকার ও কর্তব্য পরস্পরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। অধিকারের মধ্যেই কর্তব্য নিহিত রয়েছে। বস্তুতপক্ষে, অধিকার ও কর্তব্য হল একই মুদ্রার দুটি দিক। সমাজবােধের ধারণা থেকেই অধিকার ও কর্তব্য উভয়ের সৃষ্টি। সমাজবদ্ধ মানুষের দাবিগুলি রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত হওয়ার পর অধিকারে রূপান্তরিত হয়। এই দাবিগুলি স্বীকার করার সঙ্গে কয়েকটি দায়িত্বপালনের অঙ্গীকার জড়িত থাকে। এগুলি কর্তব্য হিসেবে পরিচিত।

[2] পরস্পর নির্ভরশীল: অধ্যাপক হ্যারল্ড ল্যাস্কির মতে, যে কর্তব্য পালন করবে না সে অধিকার ভােগ করতে পারবে না। তাই একজনের অধিকার ভােগ অন্যদের কর্তব্যপালনের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল বলা যায়। অধ্যাপক হবহাউস-এর মতে, ধাক্কা না খেয়ে পথ চলার অধিকার যদি কারুর থাকে তাহলে অন্যের কর্তব্য হল সেই ব্যক্তির প্রয়ােজন অনুসারে পথ ছেড়ে দেওয়া।

[3] অধিকারের ভিত্তি কর্তব্য: সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্যকে অধিকারের ভিত্তি হিসেবে অভিহিত করা হয়। হবহাউসের বক্তব্য হল, সামাজিক দায়িত্বপালনের শর্তে অধিকারভােগ সম্ভব। সমাজ ব্যক্তিকে অধিকার দেয় যাতে সে তার ব্যক্তিত্বের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের মাধ্যমে নিজেকে সমাজকল্যাণে নিয়ােজিত করতে পারে। হ্যারল্ড ল্যাস্কির মতে, আমাদের অধিকার সমাজ থেকে শুধু নেওয়ার জন্য নয়, সমাজকে কিছু দেওয়ার জন্যও। বেন ও পিটারস উল্লেখ করেছেন, কর্তব্যপালনের ওপর অধিকারভােগ নির্ভরশীল।

[4] কর্তব্যহীন অধিকার অসম্ভব: অধিকারের উৎস হল রাষ্ট্র। রাষ্ট্র অধিকারের স্বীকৃতি দিয়ে তাকে যথাযথ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে। এ হল রাষ্ট্রের কর্তব্য। ঠিক নাগ কদেরও রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্য রয়েছে, যেমন নিয়মিত কর প্রদান, আনুগত্য প্রদর্শন, রাষ্ট্রীয় আইনকানুন মান্য করা প্রভৃতি। নাগরিকরা এসব কর্তব্য পালন না করলে রাষ্ট্রযন্ত্র অচল হয়ে পড়ে। আর রাষ্ট্রহীন সমাজে অধিকার বলে কিছু থাকে না। কাজেই রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্য পালন না করে নাগরিকরা অধিকার আশা করতে পারে না। তেমনি আবার রাষ্ট্র তার কর্তব্য পালন না করে নাগরিকদের কাছে। কোনাে কর্তব্য পালন আশা করতে পারে না। এজন্য বলা হয় যে, রাষ্ট্র ও নাগরিক পরস্পরের প্রতি নিজেদের কর্তব্য সুষ্ঠুভাবে পালন করলেই একটি আদর্শ সমাজের ভিত্তি রচিত হতে পারে।

[5] অধিকার কর্তব্য দ্বারা সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত: অধিকার অবাধ ও অনিয়ন্ত্রিত হতে পারে না। সীমাহীন অধিকার স্বেচ্ছাচার ছাড়া আর কিছু নয়। অধিকার অবাধ হলে দুর্বলশ্রেণি সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে পারে। তাই অধিকারের পরিধিকে সীমিত রাখতে হয়। বস্তুতপক্ষে, অধিকারের পরিধি কর্তব্যবােধের দ্বারা সীমিত। নৈতিক অধিকার ও নৈতিক কর্তব্যবােধের মধ্যে অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক রয়েছে। বার্ধক্যে অক্ষম মাতাপিতা সন্তানের দ্বারা প্রতিপালিত হওয়ার নৈতিক অধিকার দাবি করতে পারে; সেক্ষেত্রে সন্তানের কর্তব্য হল বৃদ্ধ পিতা-মাতার সেবাযত্ন করা। তেমনই আবার সন্তানের শৈশবকালে তার উপযুক্ত লালনপালন ও শিক্ষার ব্যবস্থা করাও পিতা-মাতার কর্তব্য। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, গণসাধারণতন্ত্রী চিনের সংবিধানের ৪৯ নং ধারায় এই নৈতিক অধিকার ও কর্তব্যের উল্লেখ করা হয়েছে।

[6] কর্তব্যপালনের যােগ্যতা ও অধিকার: অনেকে মনে করেন, সুষ্ঠুভাবে কর্তব্যপালনের জন্য অধিকার প্রয়ােজন। পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকের যে নানা ধরনের কর্তব্য থাকে তা যথাযথভাবে পালনের জন্য গুণগত যােগ্যতার প্রয়ােজন। মানুষের অন্তর্নিহিত গুণাবলির পূর্ণবিকাশ এজন্য জরুরি। কাজেই অধিকারভােগের ভিত্তিতেই কর্তব্যপালনের যােগ্যতা সৃষ্টি হয়।

[7] ব্যক্তিস্বার্থ ও সামাজিক স্বার্থের সমন্বয়সাধন: কেবলমাত্র ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য কোনাে নাগরিক অধিকার ভােগ করতে পারে না। অধিকার এমনভাবে ভােগ করতে হয় যাতে ব্যক্তিগত স্বার্থ ও সামাজিক স্বার্থের মধ্যে সমন্বয়সাধন সম্ভব হয়। প্রতিটি অধিকারের সঙ্গে ব্যক্তিগত কল্যাণ এবং সামাজিক কল্যাণের সমন্বয়ের ধারণা জড়িত। সমাজের সাধারণ স্বার্থ সম্পর্কে সচেতনতা না থাকলে অধিকার ভােগ করা যায় না। এই সাধারণ সামাজিক স্বার্থ সম্পর্কে সচেতনতাই ব্যক্তিকে কর্তব্য পালনে উদ্বুদ্ধ করে।

উপসংহার: অধিকার ও কর্তব্য আধুনিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য উপাদান। অর্থাৎ, অধিকারকে বাদ দিয়ে কর্তব্য বা কর্তব্যকে বাদ দিয়ে অধিকারের ধারণা ও প্রয়ােগ পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে না। বস্তুত এই দুটি উপাদান পরস্পরের পরিপূরক।