নাগরিকতা সম্পর্কে উদারনৈতিক ধারণা
ওয়ালজারের মতে নাগরিকতার উদারনৈতিক ধারণার সূচনাপর্ব হল রোমান সাম্রাজ্য ও পরের পর্বের রোমান আইন (Walzer Citizenship, 1989 Cambridge University Press)। রোমান সাম্রাজ্য যতই বিস্তারলাভ করল ততই বিজিত জনগোষ্ঠীকে নাগরিক অধিকার প্রদান করা হতে থাকল, আর এভাবেই নাগরিকতার ধারণায় এক সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন দেখা দিল। এই সময় নাগরিকতার ধারণায় যে পরিবর্তন আসে তা হল প্রজাতান্ত্রিক নাগরিকতার ধারণায় রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় সক্রিয় অংশগ্রহণ নাগরিকতার অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হিসাবে গণ্য হত। কিন্তু নাগরিকতার উদারনৈতিক ধারণায় নাগরিক হল সেই ব্যক্তি যে রাষ্ট্রীয় আইনের দ্বারা সংরক্ষিত হয় ও রাষ্ট্রের দেওয়া অধিকার ভোগ করে। ওয়ালজারের মতে এই ধারণায় নাগরিকতা হল একটি প্রধানত আইনগত মর্যাদা (legal status), রাষ্ট্র বা সরকারের পদাধিকারের সঙ্গে তার কোন অঙ্গাঙ্গী যোগ নেই। এই নাগরিকতা একটি যৌথ সম্প্রদায়ের সদস্যপদকে বোঝায় যারা একটি সাধারণ আইনের অধীন। নাগরিকতার উদারনৈতিক পরম্পরা, যা সপ্তদশ শতক থেকে ধীরে ধীরে বিস্তারলাভ করে তা নাগরিকতাকে প্রধানত একটি আইনগত মর্যাদা হিসাবে দেখে যেখানে ব্যক্তির রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়। এখানে ব্যক্তির ব্যক্তিগত স্বাধীনতা রক্ষিত হয় প্রধানত দুটি উপায়ে—
-
(ক) সহ-নাগরিকদের অযথা হস্তক্ষেপ থেকে ব্যক্তিকে রক্ষা করে;
-
(খ) কর্তৃত্বের অন্যায় আচরণ বা কাজ থেকে ব্যক্তিকে নিরাপত্তা দিয়ে। এই দুটি কাজই করা হয় রাষ্ট্রীয় আইনের মাধ্যমে যা তত্ত্বগতভাবে সমস্ত নাগরিককে সমান চোখে দেখে।
নাগরিকতা বা দেশের সমস্ত মানুষের সম অধিকারের যে ব্যবস্থা আজ গোটা পৃথিবীতে চালু হয়েছে তার সূচনা হয়েছিল ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফরাসী বিপ্লবের পরবর্তীকালে। কালক্রমে উদারনীতিবাদ ও ধনতন্ত্র যত বিকশিত ও প্রসারিত হয়েছে ততই শ্রেণী, বর্ণ, লিঙ্গ, ধর্ম নির্বিশেষে নাগরিকতার অধিকার সুদৃঢ় হয়েছে। বর্তমান inclusion বা অন্তর্ভুক্তিই নাগরিকতার মূল নীতি; ফলে নাগরিকতার যে সংকীর্ণ ধারণা গ্রীক যুগে ও কিছুটা রোমান যুগে চালু ছিল তার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। বর্তমানে তত্ত্বগতভাবে রাষ্ট্রীয় কাজকর্মে অংশগ্রহণের সুযোগ দেশের সব নাগরিকের কাছে সমানভাবে উন্মুক্ত। সমতা ও সর্বজনীনতা এই নাগরিকত্বের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য।
নাগরিকতার অধিকারের এই সর্বজনীন বিস্তৃতির পিছনে কতকগুলি কারণ নির্দেশ করা যায়—
- একটি উন্নততর দর্শন হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা, অন্য প্রতিদ্বন্দ্বী দর্শন (যেমন সমাজতন্ত্র) থেকে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার জন্য এরূপ একটি সমতাপূর্ণ-নাগরিকতার ধারণা প্রচার ও প্রতিষ্ঠিত করা উদারনীতিবাদ বা ধনতন্ত্রের বিশেষ প্রয়োজন ছিল।
- রাজনীতিতে বা সরকার পরিচালনার সুযোগ তত্ত্বগতভাবে সমস্ত শ্রেণীর মানুষের (নাগরিকের) কাছে উন্মুক্ত করে দিয়ে উদারনীতিবাদ একদিকে যেমন প্রতিদ্বন্দ্বী দর্শন (সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদ) থেকে বেশ কয়েক কদম এগিয়ে গেছে, অন্যদিকে তেমনই এই সুযোগ পেয়ে সমাজের দুর্বলতর অংশের মানুষদের ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি বিদ্বেষ বা পুঞ্জীভূত অসন্তোষ অনেকটাই কমে গেছে। ফলে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থা একধরনের স্বাভাবিক বৈধতা (natural legitimacy) লাভ করেছে।
নাগরিকতা সম্পর্কে সম্প্রদায়গত ধারণা
নাগরিকতা সম্পর্কে সম্প্রদায়গত ধারণা নাগরিকতার একটি আদর্শ ধারণা কারণ এখানে সম্প্রদায়গত মানসিকতার উপর সর্বাধিক গুরুত্ব (community belonging) প্রদান করা হয়। এই মানসিকতার ধারণাকে সঠিকভাবে বুঝতে গেলে মনে রাখতে হবে সমাজ কিভাবে গঠিত হয়। সমাজ হল কতকগুলি সম্প্রদায়ের সমষ্টি, যে সম্প্রদায় আবার তৈরী হল ব্যক্তিবর্গ নিয়ে। নাগরিকতার এই ধারণার সমর্থকদের মতে যখন ব্যক্তিরা ভাবে যে, তারা শুধু ব্যক্তি নয় একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের সদস্য তখনই কোন সমাজের প্রকৃত উন্নতি হওয়া সম্ভব। Communitarians-দের মতে একজন ব্যক্তির আত্মপরিচয় তখনই সম্পূর্ণ হয় যখন সে নিজেকে একটি সম্প্রদায়ের অংশ হিসাবে ভাবতে শেখে, কারণ সমাজ সম্প্রদায়ের বাইরে ব্যক্তির কোন অস্তিত্ব থাকতে পারে না। গ্রীক দার্শনিক প্লেটো, অ্যারিষ্টটল সমাজের সম্প্রদায়ের সদস্য হিসাবে ব্যক্তিকে দেখেছেন, বিচ্ছিন্ন সত্ত্বা হিসাবে নয়। তাই অ্যারিষ্টটল-এর মন্তব্য “যে ব্যক্তি সমাজে বা রাষ্ট্রে বসবাস করে না হয় সে ভগবান, নয় উন্মাদ”। এ কথার অর্থ হল স্বাভাবিক মানুষের জীবনের বিকাশের জন্য সমাজ/সম্প্রদায়, রাষ্ট্রের প্রয়োজন হয়। নাগরিকতার সম্প্রদায়গত ধারণার সূচনাপর্ব এই চিন্তা-ভাবনা থেকেই। এই ধারণা অনুযায়ী সামাজিক মনোভাবাপন্ন নাগরিকই হল প্রকৃত নাগরিক যে ক্ষুদ্র স্বার্থের ঊর্ধ্বে সমাজ/সম্প্রদায়কে স্থান দেয়, যে সাধারণের কল্যাণের জন্য আত্মনিয়োগ করে, দেশের অর্থনৈতিক প্রগতির জন্য কাজ করে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকৃত নাগরিকের দায়িত্ব নিতে এগিয়ে আসে। এককথায় সামাজিকভাবে সক্রিয় নাগরিকই প্রকৃত নাগরিক—এটাই সম্প্রদায়গত নাগরিকত্বের মূলকথা।
এরা বলেন, নাগরিকদের এটা সবসময় মনে রাখতে হবে তাদের একে অপরের প্রতি/সমাজ ও সম্প্রদায়ের প্রতি অধিকার ও কর্তব্য আছে। এরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন এরকম সমাজ/সম্প্রদায় সচেতন সক্রিয় নাগরিক গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন নাগরিকতার প্রশিক্ষণের (citizenship education)। নাগরিকতার শিক্ষা তরুণদের মনে সম্প্রদায়ের/সমষ্টির আদর্শ ও নীতিবোধকে সঞ্চারিত করবে, পরিণত করবে, তাদের এক দায়িত্বশীল নাগরিক হিসাবে গড়ে তুলবে। প্লেটো ও অ্যারিষ্টটল নাগরিকদের শিক্ষার উপর প্রচণ্ড গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তারা মনে করেছিলেন সামাজিক মনোভাবাপন্ন নাগরিক একমাত্র প্রকৃত ও কার্যকরী শিক্ষার মাধ্যমেই গড়ে উঠতে পারে। এই শিক্ষা নাগরিকদের ক্ষুদ্র স্বার্থ ও দুর্নীতিপরায়ণতা থেকে মুক্ত করে তাদের বৃহত্তর সামাজিক প্রেক্ষিত অনুধাবন করতে সাহায্য করবে। তারা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এই শিক্ষাদানের পক্ষপাতী ছিলেন, কোন বেসরকারী উদ্যোগ এক্ষেত্রে একেবারেই বাঞ্ছনীয় নয় – এই ছিল তাদের মত।
বিখ্যাত ভারতীয় দার্শনিক মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী সম্প্রদায়গত নাগরিকতার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। গান্ধীর মতে ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থে চালিত ব্যক্তি সমাজের পক্ষে বিপজ্জনক। এদের স্বার্থপরতা সমাজকে বিপন্ন করে। তিনি ব্যক্তিস্বার্থের উপরে সমষ্টিগত স্বার্থকে স্থান দিয়েছেন। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল এই যে সমষ্টির কল্যাণেই ব্যক্তির কল্যাণ। তাই তিনি সামাজিক দায়বদ্ধতাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। তার সর্বোদয়ের ধারণার মাধ্যমে সবার উদয় বা কল্যাণের কথা বলেছেন। অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন প্রান্তিক মানুষদের উন্নতির উপর।
সম্প্রদায়গত নাগরিকত্বের ধারণা ব্যক্তিকে ক্ষুদ্র সংকীর্ণ স্বার্থের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে এসে সমাজ/সম্প্রদায় ও সমষ্টির স্বার্থে আত্মনিয়োগ করার কথা বলে। এটা তখনই সম্ভব যখন ব্যক্তি সমষ্টির কল্যাণেই নিজের কল্যাণ, এটা অন্তর থেকে উপলব্ধি করবে। এটাই সম্প্রদায়গত/সমষ্টিগত মানসিকতা। এই মানসিকতার সৃষ্টি না হলে এই ধরনের নাগরিকতারও সৃষ্টি হবে না। এই ধরনের নাগরিকের যে সব গুণাবলী বা চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য থাকা প্রয়োজন তা হল (ক) ব্যক্তিস্বার্থের উপরে সম্প্রদায়ের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া, (খ) সহনাগরিকের ও দেশ/সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা ও ভালবাসা; (গ) দেশের কল্যাণের জন্য সেই সমস্ত কাজে আত্মনিয়োগ করা যাতে দেশের কল্যাণ হবে; (ঘ) সমষ্টির উন্নতির জন্য উৎসাহ ও উদ্দীপনা অনুভব করা প্রভৃতি। এককথায় সমষ্টিগত/সম্প্রদায়গত মানসিকতা সম্পন্ন সক্রিয় নাগরিক হল এই নাগরিকতার ধারণার প্রাণভোমরা।
নাগরিকতা সম্পর্কে প্রজাতান্ত্রিক তত্ত্ব
নাগরিকতার প্রজাতান্ত্রিক তত্ত্বটি নাগরিকতার তত্ত্বগুলির মধ্যে সবচাইতে প্রাচীন। এই তত্ত্বের জন্ম হয় প্রাচীন গ্রীসে অ্যারিষ্টটলের লেখনীর মাধ্যমে। তারপর এই তত্ত্বের প্রসারে যারা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ম্যাকিয়াভেলী, রুশো, মন্টেস্কু প্রভৃতি।
নাগরিকতার প্রজাতান্ত্রিক ধারণায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নীতি হল পৌর স্ব-শাসন (civic self-rule)। এই পৌর স্ব-শাসন আবর্তিত হয় ধ্রুপদী প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং সরকারী অফিসসমূহে নাগরিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে। অ্যারিষ্টটল তাঁর সুবিখ্যাত Politics নামক গ্রন্থে নাগরিককে এইভাবে চিহ্নিত করেছেন যে নাগরিক হল সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ যে/যারা পর্যায়ক্রমে শাসন করতে বা শাসিত হবার যোগ্যতাসম্পন্ন। তিনি আরও বলেছেন, “প্রথমে এবং সর্বোপরি নাগরিকরা হল সেই ব্যক্তিবর্গ যারা সরকারী অফিস পরিচালনা করার ক্ষেত্রে অংশীদারী।” বিখ্যাত রোমান দার্শনিক নিকোলো ম্যাকিয়াভেলীও নাগরিকতার প্রজাতান্ত্রিক ধারণাকে সবিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। ম্যাকিয়াভেলী তার নিজের রাজ্য ফ্লোরেন্সের ভঙ্গুরতা ও দুর্বলতার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে প্রাচীন রোমের শক্তি ও মহত্ত্বের প্রধান উপাদান হল তার নাগরিকদের অন্তর্নিহিত গুণাবলী। এই গুণাবলীর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল দেশপ্রেম, আত্ম-শৃঙ্খলা বা অনুশাসন, দয়াপরায়ণতা ও সমষ্টির উন্নতির জন্য ব্যক্তিগত স্বার্থকে অতিক্রম করা। তিনি পেশাদারী সৈনিকদের তুলনায় নাগরিকদের নিয়ে গঠিত সেনাবাহিনীর উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তার মতে এই সেনাবাহিনী তার দেশপ্রেম ও নিষ্ঠার জন্য পেশাদারী সৈনবাহিনীর থেকে দেশের ঐক্য ও অখণ্ডতা রক্ষায় অধিক কার্যকরী। ফরাসী দার্শনিক রুশোও তাঁর La Contract Social নামক গ্রন্থে পৌর স্বশাসনের ধারণাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। তার মতে রাষ্ট্র পরিচালনা ও আইন তৈরীর ক্ষেত্রে নাগরিক অংশগ্রহণ ব্যক্তিকে প্রকৃত নাগরিকে পরিণত করতে পারে। তাঁর ধারণা হল সাধারণ ইচ্ছার দ্বারা আইন তৈরী ও রাষ্ট্রপরিচালনার মাধ্যমে নাগরিকরা স্বাধীন হতে পারে ও রাষ্ট্রীয় আইন বৈধতা লাভ করতে পারে। তিনি মনে করেছেন, স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে ব্যক্তি প্রকৃত নাগরিক হয়ে উঠতে পারে, আর এগুলি না থাকলে ব্যক্তি নাগরিক হয়ে উঠার পরিবর্তে প্রজায় (subject) পরিণত হয়। এককথায় বলা যায় প্রজাতান্ত্রিক নাগরিকতার ধারণায় নাগরিকের রাজনৈতিক সত্ত্বার উপর অধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়।
প্রজাতান্ত্রিক ও উদারনৈতিক নাগরিকতার ধারণা প্রকৃতপক্ষে দুটি বিকল্প মডেলের সন্ধান দেয়। নাগরিকতার প্রজাতান্ত্রিক ধারণায় নাগরিক প্রধানত একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও রূপায়ণে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে, অন্যদিকে উদারনৈতিক ধারণায় নাগরিকত্ব একটি মূলত আইনগত মর্যাদা যা ব্যক্তিকে আইনের চোখে সমতা ও রাষ্ট্রীয় অধিকারভোগের অংশীদার করে। প্রথম মডেলে নাগরিক প্রধানত একজন রাজনৈতিক প্রতিনিধি (agent) আর দ্বিতীয় মডেলে সে একজন ব্যক্তি যার ব্যক্তিগত কাজকর্ম তাকে এতটাই আচ্ছন্ন করে রাখে যে সে রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ বা ইচ্ছা কোনটাই পায় না বা অনুভব করে না, ফলে রাজনৈতিক কাজকর্ম অর্থাৎ আইন তৈরী ও রূপায়ণের কাজ সে ছেড়ে দেয় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের উপর।
প্রজাতান্ত্রিক নাগরিকত্বের সীমাবদ্ধতা:
বর্তমান সময়ে প্রজাতান্ত্রিক নাগরিকতার ধারণা সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। যেমন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বেঞ্জামিন কনস্ট্যান্ট-এর মতে প্রজাতান্ত্রিক নাগরিকতার ধারণা বর্তমান বিশ্বে অচল হয়ে পড়েছে। ওয়ালজার মত প্রকাশ করেছেন বর্তমান জটিল বিশ্বে প্রজাতান্ত্রিক নাগরিকত্বের আদর্শকে বাস্তবায়িত করতে গেলে এক মহা বিপর্যয় ঘটবে। যেমন ঘটেছিল ফরাসী বিপ্লবের সময় জ্যাকোবিয়ানদের কাজকর্মের মাধ্যমে। নাগরিকতার প্রজাতান্ত্রিক ধারণা অন্তত দুটি দিক থেকে বর্তমানে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব নয়।
-
বর্তমান আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার কাজকর্মের জটিলতা ও পরিধি এতই বেশী যে পূর্বেকার প্রজাতান্ত্রিক নাগরিকতার মডেল বর্তমানে কার্যকরী করা সম্ভব নয় আর বর্তমানে যদি রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ নাগরিকদের পক্ষে সম্ভব না হয় তাহলে তাদের পক্ষে শ্রেয় হবে অন্যান্য অ-রাজনৈতিক কাজকর্মে (তা সে অর্থনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক যাই হোক না কেন) অংশগ্রহণ করা (কনস্ট্যান্ট)।
-
বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থার বিভিন্নতা (heterogeneity) আগেকার পোলিস (polis)-এ নাগরিকদের মধ্যে যে মানসিক বা নৈতিক ঐক্য ও পারস্পরিক বিশ্বাস ছিল তা নষ্ট করে দিয়েছে; ফলে নাগরিকতার প্রজাতান্ত্রিক ধরন এখন আর বাস্তবায়িত করা সম্ভব নয় (ওয়ালজার)।
প্রজাতান্ত্রিক নাগরিকতার ধারণা বর্তমান যুগের বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ না হলেও এর উপযোগিতা এখনও পুরোপুরি নিঃশেষ হয়ে যায় নি। ডি. মিলার তাঁর Citizenship and National Identity নামক পুস্তকে মন্তব্য করেছেন যে নাগরিকতার প্রজাতান্ত্রিক মডেল এখনও একটা মূল্যবান মাপকাঠি হিসাবে ব্যবহৃত হতে পারে যার মাধ্যমে আমরা রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের কাজকর্ম ও প্রকৃতিকে বিচার করতে পারি। তাত্ত্বিকরা এই বিষয়ে একমত হয়েছেন যে যদিও বর্তমানে প্রজাতান্ত্রিক নাগরিকতাকে পুরোপুরি ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয় তাহলেও উদারনৈতিক নাগরিকতার যে নিষ্ক্রিয়তা তা অতিক্রম করার ক্ষেত্রে প্রজাতান্ত্রিক নাগরিকতা একটা বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। এই নাগরিকতা শুধুমাত্র যে নাগরিকদের রাষ্ট্রীয় কাজকর্মে সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযোগ দেবে তা নয়, রাজনৈতিক কর্তৃত্বের স্বৈরাচারী অবাঞ্ছিত অনুপ্রবেশ থেকেও নাগরিকদের সুরক্ষিত রাখবে।
নাগরিকতার ধারণার সাম্প্রতিক বিবর্তন
বর্তমানে ভূ-খণ্ডগত বা রাষ্ট্রীয় নাগরিকতার ধারণা এক নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। বিশ্বায়ন, নয়া উদারনীতিবাদ ও বহু সংস্কৃতিবাদের (multiculturalism) যুগে ভূ-খণ্ডগত বা রাষ্ট্রীয় নাগরিকত্বের পরিবর্তে বিশ্ব নাগরিকতার ধারণা ক্রমশই তাত্ত্বিকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
সর্বজনীন নাগরিকতা:
বর্তমানে পৃথিবীতে যে নাগরিকতা প্রচলিত তা হল সর্বজনীন নাগরিকতা। অর্থাৎ দেশের সীমারেখার মধ্যে অবস্থিত প্রতিটি ব্যক্তি (ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, আর্থিক অবস্থা নির্বিশেষে) দেশের নাগরিক। বিখ্যাত ব্রিটিশ তাত্ত্বিক টি. এইচ. মার্শাল তার Citizenship and Social Class গ্রন্থে এই নাগরিকতাকে বর্ণনা করেছেন একজন মানুষ একটি ভোট (one man one vote) এই নীতির মাধ্যমে। সর্বজনীন নাগরিকতার ধারণা বিকাশ লাভ করে উদারনৈতিক গণতন্ত্রে।
- এই নাগরিকতার ধারণার সমর্থকদের মতে এই ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় গুণ হল এখানে রাষ্ট্রীয় নাগরিকতার অধিকার দেশের সব মানুষের কাছে সমানভাবে উন্মুক্ত থাকে। নাগরিকতা এখানে একটি আইনগত অধিকার (যা সবাই ভোগ করতে পারে), কোন বিশেষ সুবিধা নয় (special previlege)।
- গ্রীক ও রোমান ব্যবস্থায় (অংশত) নাগরিকতার ভিত্তি ছিল বাদ দেওয়া বা exclusion, এখানে জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে (শ্রমজীবি ও ক্রীতদাস সম্প্রদায়) নাগরিকতার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হত। নাগরিকতা এইসব সমাজে ছিল বিশেষাধিকার আইনগত অধিকার বা মর্যাদা নয়। কিন্তু উদারনৈতিক গণতন্ত্র (মার্কস যাকে বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থা বলেছেন)-এ বহিষ্কৃতি নয় (exclusion), অন্তর্ভুক্তিই (inclusion) নাগরিকতার প্রধান বৈশিষ্ট্য। তৃতীয়ত, সর্বজনীন নাগরিকতার ধারণায় সমরূপতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয় (homogeneity), ভাষা, ধর্ম, বর্ণগত বিভিন্নতা এখানে স্বীকার করা হলেও এগুলিকে অতিক্রম করে দেশের সার্বিক বা সাধারণ স্বার্থ রক্ষার প্রচেষ্টা এখানে প্রাধান্য লাভ করে। ফলে এই ব্যবস্থা দেশের ঐক্য ও অখণ্ডতা রক্ষায় অধিক সহায়ক হয়। বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি বা প্রবণতাগুলি এখানে বিশেষ সুবিধা করতে পারে না।
পৃথকীকৃত নাগরিকতা:
সর্বজনীন নাগরিকতা সারা বিশ্বে স্বীকৃত ও আদৃত হওয়া সত্ত্বেও ১৯৮০-র S দশক থেকে এই ধারণার বিরুদ্ধে তাত্ত্বিকরা সোচ্চার হতে থাকেন। এই সময় থেকেই নৈতিক ও সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ স্বীকৃত হতে শুরু করে ও উদারনৈতিক গণতন্ত্রে সর্বজনীন নাগরিকতার বিকল্প তাত্ত্বিক অনুসন্ধান প্রাধান্য লাভ করতে থাকে। পৃথকীকৃত নাগরিকতার ধারণা এই বিকল্প তাত্ত্বিক অনুসন্ধানের একটি অর্থবহ প্রচেষ্টা (meaningful initiative)। যে সব তাত্ত্বিক এই বিকল্প নাগরিকতার ধারণাকে প্রচার করেছেন ও সমর্থন যুগিয়েছেন তাদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হলেন আই. এম. ইয়ং, উইল (Kymlica), নর্মান ওয়েন প্রমুখ।
পৃথকীকৃত নাগরিকতার সমর্থকরা সর্বজনীন নাগরিকতার বিরুদ্ধে যে প্রধান অভিযোগ তোলেন তা হল এখানে Shared identity বা যৌথ পরিচিতির মাধ্যমে জনগণের বিভিন্ন গোষ্ঠীর সংহতি ও সাধারণ স্বার্থ সুনিশ্চিত করার উপর জোর দেওয়া হলেও বাস্তবে এই ব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠ ও প্রভাবশালী গোষ্ঠীর স্বার্থই রক্ষিত হয়। এখানে সাধারণ নাগরিক অধিকারের কথা বলা হলেও বিশেষ কিছু গোষ্ঠী যেমন দেশীয় জনগণ (indigeneous people), আফ্রিকান, আমেরিকান, জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠী ও মহিলারা এই নাগরিকতার ব্যবস্থায় নিজেদের বঞ্চিত বা অবহেলিত মনে করেন। এইসব গোষ্ঠীর মানুষ ক্রমশই এই ধারণায় উপনীত হন যে সর্বজনীন নাগরিকতা নামে সাধারণ স্বার্থের কথা বললেও প্রান্তিক মানুষদের কণ্ঠস্বর ও স্বার্থ এখানে অবদমিত হয়। এই অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য বর্তমানে সর্বজনীন নাগরিকতার পরিবর্তে পৃথকীকৃত নাগরিকতা প্রবর্তনের জন্য অনেক তাত্ত্বিক মত প্রকাশ করেছেন। এদের মতে এই ধরনের নাগরিকতা ব্যক্তি নাগরিকতার পরিবর্তে গোষ্ঠী প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করার মাধ্যমে প্রান্তিক গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষায় অধিক কার্যকরী হবে।
আই. এম. ইয়ং তাঁর ‘সর্বজনীন নাগরিকতার আদর্শের সমালোচনা’ (A Critique of the Ideal of Universal Citizenship, 1989) নামক গ্রন্থে দেখিয়েছেন মহিলারা একটি সামাজিক গোষ্ঠী হিসাবে নানা ধরনের অবদমনের/বঞ্চনার শিকার হয়। এগুলি হল তাঁর মতে শোষণ, ক্ষমতাহীনতা, সাংস্কৃতিক বঞ্চনা, হিংসা প্রভৃতি। এগুলি থেকে বাঁচবার জন্য তাদের প্রয়োজন ব্যক্তিগত নাগরিকতার পরিবর্তে গোষ্ঠী প্রতিনিধিত্ব ( group representation)। সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদীরাও মনে করেন প্রান্তিক ও অবদমিত শ্রেণী/গোষ্ঠীগুলির নাগরিকতার ক্ষেত্রে তাদের স্বতন্ত্র ও গোষ্ঠীগত অবস্থায় থাকা প্রয়োজন।
পৃথকীকৃত নাগরিকতার প্রশ্নে উইল কাইম্লিকা ও যেন নর্মান তিন ধরনের দাবী বা অধিকারের সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। এগুলি হল
-
(ক) বিশেষ প্রতিনিধিত্বের অধিকার (অনগ্রসর সম্প্রদায়ের জন্য) ;
-
(খ) বহুসাংস্কৃতিক অধিকার (অভিবাসী ও ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলির জন্য) এবং
-
(গ) আত্ম-নিয়ন্ত্রণ বা নিজ সরকারের অধিকার (জাতীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলির জন্য)।
(ক) কাইম্লিকা ও ওয়েন নর্মানের মতে প্রথম দুটি দাবী বা অধিকার হল সমাজের মূলধারার মধ্যে অন্তর্ভুক্তির দাবী বা অনুভূতি। এদের মত অনুযায়ী বিশেষ প্রতিনিধিত্বের দাবীর মাধ্যমে সংখ্যালঘু বা ঐতিহাসিকভাবে অনগ্রসর সম্প্রদায় দেশের মূল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহে (যা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনজাতির দ্বারা চালিত হয়) তাদের কণ্ঠস্বর বা অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সংখ্যালঘুদের জন্য বিশেষ প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা এই কাজে বিশেষ সহায়ক হতে পারে। এর মাধ্যমে অনগ্রসর সম্প্রদায়গুলিকে একটু বেশি সুযোগ সুবিধা দিয়ে তাদের জাতীয় জীবনের মূল স্রোতে মিশিয়ে দেওয়া যায় বলে এরা মনে করেছেন।
(খ) বহু সাংস্কৃতিক অধিকারের মাধ্যমে অভিবাসী গোষ্ঠীগুলি সেইসমস্ত আইন বা সরকারী নীতির থেকে অব্যাহতি পেতে চায় বা পারে যা তাদের অসুবিধার কারণ হয়। এইভাবে তারা তাদের ধর্মীয় আচার আচরণ, প্রথা প্রভৃতিকে রক্ষা করতে পারে, পারে তাদের ধর্মীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে। এইসব কাজে সাফল্য লাভ করার জন্য এই গোষ্ঠীগুলি সবসময়ই চেষ্টা করে জনগণের বৃহত্তর অংশের সমর্থন/সহযোগিতা লাভ করার জন্য।
(গ) কাইম্লিকা ও ওয়েন নর্মানের মতে একমাত্র জাতীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলির নিজ সরকার প্রতিষ্ঠা বা আত্ম-নিয়ন্ত্রণের দাবী জাতীয় সংহতির ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কারণ এই দাবীগুলির লক্ষ্য হল বিদ্যমান সরকারী ব্যবস্থায় নিজেদের দাবী প্রতিষ্ঠা নয়, নিজেদের এলাকায় পূর্ণভাবে ক্ষমতাশালী হওয়া। এদের মতে এইসব দাবীগুলিকে অগ্রাহ্য করে উপর থেকে সর্বজনীন সাধারণ নাগরিকত্ব চাপিয়ে দিলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে কারণ এর ফলে অবদমিত শ্রেণী ও গোষ্ঠীগুলি সন্ত্রাসবাদী বা অন্যান্য বিপজ্জনক কাজকর্মে যুক্ত হবে যা যে-কোন দেশের ঐক্য ও সংহতিকে বিপন্ন করতে পারে ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে দিতে পারে।
পৃথকীকৃত নাগরিকত্বের ধারণা ত্রুটিমুক্ত নয়। বামপন্থী তাত্ত্বিকদের মতে পৃথকীকৃত নাগরিকতার ধারণা রাজনৈতিক ব্যবস্থার লক্ষ্য ও উদ্যমকে নষ্ট করে দেয়, দেশের জনগণের জন্য সমমাত্রিক নীতি (egalitarian principle) প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এর ফলে সম্ভব হয় না।
Leave a comment