কোন নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক যুগে নাগরিকতার ধরন ও গঠন সেই যুগের প্রাধান্যকারী সামাজিক-অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তির বিন্যাস দ্বারা নির্ধারিত হয়। তাই কোন নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক যুগে নাগরিকতা সম্বন্ধে সঠিক ধারণা পেতে হলে এই প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজতে হবে কারা নাগরিক? কাদের নাগরিকতা থেকে বাদ দেওয়া হয় এবং সেই বাদ দেওয়ার পদ্ধতি বা ভিত্তি কি? নাগরিকতার প্রকৃতি কি? নাগরিকতা কি শুধুমাত্র একটি আইনগত মর্যাদা নাকি এটি রাজনৈতিক জীবনে সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়? এই সমস্ত প্রশ্নের যথাযথ উত্তর পাওয়া গেলে নাগরিকতার ধারণাটির ঐতিহাসিক বিবর্তন এবং এ সম্পর্কে বর্তমান বিতর্কের উত্তর পাওয়া সম্ভব।

প্রাচীন গ্রীসে (বিশেষত এথেন্সে) নাগরিকতার ধারণার মধ্যে দায়িত্ব বা কর্তব্যই প্রাধান্য পেত। কিন্তু বর্তমানে নাগরিকতার ধারণায় কর্তব্য পালনের পাশাপাশি নাগরিকদের অধিকারের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পায়। আধুনিক ধারণায় নাগরিকতা হল এমন একটি অধিকার যা নাগরিকদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়ার পাশাপাশি তাদের ব্যক্তিগত দায়-দায়িত্ব পালনের স্বাধীনতাও দেয়। আধুনিককালে নাগরিকতা হল একটি মর্যাদা যা নাগরিকদের কিছু দায়-দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি কিছু অধিকার দেয়, একইসঙ্গে এটি হল একটি পরিচয় (identity) যা ব্যক্তিকে রাজনৈতিক সম্প্রদায়ের সদস্যপদ প্রদান করে। সমাজে অবস্থিত বিভিন্ন গোষ্ঠী এই সম্প্রদায়ের সদস্য; ফলে নাগরিকতা সমাজে একটি সংহতিসাধনকারী ধারণা হিসাবে কাজ করে। নাগরিকতার ধারণা ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে সমস্ত মানুষকে সমান মর্যাদা ও অধিকার প্রদান করে (আইনের দৃষ্টিতে)। নাগরিকতার ধারণার যত সম্প্রসারণ ঘটেছে ততই বিভিন্ন গোষ্ঠী এর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে (যারা আগে এর বাইরে ছিল), যেমন শ্রমজীবি সম্প্রদায়, নারীরা প্রভৃতি। বর্তমানে নাগরিকতা হল একটি সদস্যপদ যার মাধ্যমে নাগরিকরা নিজস্ব সরকার পরিচালনা, সরকারের গঠন প্রভৃতি ক্ষেত্রে যৌথভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে।

প্রাচীন যুগে নাগরিকতা ছিল একটি বিশেষাধিকার যা সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল না, কিন্তু বর্তমানে গণতন্ত্র এবং অবাধ সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার চালু হবার পর নাগরিকতাও সর্বজনীন হয়েছে। বর্তমানে অবস্থা ও মর্যাদা নির্বিশেষে সমস্ত নাগরিকই সমান এবং সবাই আইনের চোখে অভিন্ন। সাধারণভাবে নাগরিকতা হল একগুচ্ছ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক অধিকার ও দায়-দায়িত্বের সমষ্টি। নাগরিকতার ধারণা বর্তমানে জটিল হচ্ছে এবং এ সম্পর্কে নতুন নতুন মাত্রা যুক্ত হচ্ছে। নাগরিকতা হল পরিচয়, মূল্যবোধ এবং রাষ্ট্রীয় কাজে অংশগ্রহণের অধিকার। P. Enslin গণতন্ত্রে নাগরিকতার পাঁচটি অর্থ বা বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেছেন— 

  • নাগরিকতা ব্যক্তিকে একটি রাজনৈতিক এককের মধ্যে সদস্যপদের মর্যাদা প্রদান করে। নাগরিকতার ধারণা ভূ-খণ্ডগত। 
  • ব্যক্তিকে আত্মপরিচয়ের সুযোগ দেয়। 
  • নাগরিকতা একগুচ্ছ মূল্যবোধের সমষ্টি, যে মূল্যবোধের মূল বিষয় হল সাধারণের মঙ্গলের জন্য প্রচেষ্টা।
  • নাগরিকতা ব্যক্তিকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের জন্য উৎসাহিত করে। 
  • নাগরিকরা দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশের আইনকানুন, রাজনৈতিক সংগঠন এবং প্রশাসনব্যবস্থা সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করে। (P. Enslin Education and Democratic Citizenship in New York, Falmer Press)

নাগরিকতার ধারণা যুগে যুগে বিবর্তিত হয়েছে। গ্রীক ও রোমান যুগে নাগরিকতা সকলের ভাগ্যে সহজলভ্য ছিল না—এটা কোন সর্বজনীন অধিকার ছিল না, ছিল একটি বিশেষ সুযোগ যা মাত্র কিছু সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা ভোগ করতেন। কিন্তু ধনতন্ত্র যত প্রসারিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ততই সর্বজনীন নাগরিকত্বের ধারণা বিস্তার লাভ করেছে। নাগরিকতা সম্পর্কে আলোচনায় সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নাম হল T. H. Marshall। তিনি তার বিখ্যাত গ্রন্থ Citizenship and Social Class (1963)-এ নাগরিকতার সংজ্ঞা দিয়েছেন এইভাবে নাগরিকতা হল একটি মর্যাদা যা কেবলমাত্র দেওয়া হয় দেশের পূর্ণ সদস্যদের, যারা এই মর্যাদাপ্রাপ্ত হয় তারা অধিকার ও কর্তব্যের দিক থেকে সমান হয়। যদিও নাগরিকরা কি অধিকার পাবে সে সম্পর্কে কোন সর্বজনস্বীকৃত নীতি নেই। তাহলেও এটা বলা যায় যে সমস্ত সমাজে নাগরিকতা একটি প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে উঠেছে সেখানে আদর্শ নাগরিকের প্রাপ্তি এবং সামাজিক কল্যাণের মধ্যে সম্পর্কটি দ্বন্দ্বমূলক নয়। মার্শাল নাগরিকতার ধারণার মধ্যে এক সামাজিক ঐক্য বা যোগাযোগের (bond) উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন যেখানে সম্প্রদায়গত সদস্যপদের প্রতি নাগরিকের প্রত্যক্ষ আগ্রহ বা আনুগত্য থাকবে। এই আনুগত্য হবে স্বাধীন মানুষের স্বেচ্ছা আনুগত্য যার ভিত্তিমূলে থাকবে অধিকার যা সংরক্ষিত হবে সাধারণ আইনের মাধ্যমে। বাজার অর্থনীতি ও নাগরিকতার সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে মার্শাল দেখিয়েছেন যে নাগরিকতার ভিত্তি হল সাম্য। এই সাম্যভিত্তিক নাগরিকতা বাজারী ধনতন্ত্রের (যা অসাম্যের উপর প্রতিষ্ঠিত) দুর্বলতা বা দোষত্রুটিগুলিকে অনেকাংশে প্রতিহত করতে সমর্থ হয়। সর্বজনীন নাগরিকতার ধারণার বিকাশের ফলে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার শ্রেণীভিত্তি নষ্ট হয়ে যায় না, শ্রেণীব্যবস্থা রয়েই যায় কিন্তু নাগরিকতা শ্রেণীবৈষম্য কমাতে অনেকটাই সাহায্য করে। নাগরিক অধিকারের প্রতিষ্ঠা ও আইনের চোখে সমতা নিম্নশ্রেণীর ব্যক্তিদের সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে সাহায্য করে।

মার্শালের নাগরিকতার অধিকার ও প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত ত্রিবিধ ধারণা নাগরিকতা সম্পর্কে যে-কোন আলোচনার প্রাথমিক ভিত্তি হিসাবে কাজ করে। তার মতে নাগরিকতার তিনটি ভাগ আছে— পৌর, রাজনৈতিক ও সামাজিক। নাগরিকতার পৌর ভাগটি হল অধিকার যা ব্যক্তিগত স্বাধীনতার পক্ষে অপরিহার্য এবং এর মূল ভিত্তি হল আইনের অনুশাসন ও আইনগত ব্যবস্থা। নাগরিকতার রাজনৈতিক ভাগটি হল দেশের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের অধিকার একমাত্র গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নাগরিকরা এই অধিকার পেতে পারে। নাগরিকতার সামাজিক দিকটি হল নাগরিকতা ব্যক্তিকে অধিকার দেয় সামাজিক সুফলগুলি ভোগ করার এবং এইভাবেই একটি সামাজিক সম্প্রদায়ের অংশ হবার। আঠারো শতকের মধ্যভাগ থেকে বিংশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত ব্রিটেনে নাগরিকতার ধারণার বিকাশ পর্যালোচনা করতে গিয়ে মার্শাল বলেছেন যে সর্বজনীন রাজনৈতিক ও পৌর স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতিগুলির পূরণের জন্য সামাজিক অধিকার এর প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন সর্বাগ্রে। পৌর, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা হলেই কেবলমাত্র ব্যক্তি নাগরিক রাষ্ট্রীয় বা অন্যান্য নাগরিকদের স্বেচ্ছাচারিতা বা বাধ্যতার কবল থেকে মুক্ত হতে পারে। তার মতে নাগরিকতার মর্যাদা ব্যক্তিকে আইনের চোখে সমান অধিকারভোগীর পর্যায়ে উন্নীত করে, বন্ধ হয়ে যায় যে কোন ধরনের ক্রমোচ্চ স্তরবিন্যাসের।

মার্শাল যে নাগরিকতার কথা বলেছেন সেখানে গুরুত্ব পেয়েছে দুটি বিষয় – (ক) সমতা (equality) এবং (খ) সর্বজনীনতা (universality) – এই দুটি বিষয় আবার উদার বা বুর্জোয়া নাগরিকতারও কেন্দ্রীয় বিষয়। মার্শাল নাগরিকতার সংজ্ঞা দিয়েছেন এইভাবে যে “নাগরিক হল রাজনৈতিক সম্প্রদায়ের পূর্ণ ও সমান মর্যাদাপ্রাপ্ত সদস্য”। এই সংজ্ঞা থেকে নাগরিকতার দুটি বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করা যায়। 

  • নাগরিকতা এক অনুভূমিক সমতা বা বন্ধুত্বের ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত যা ক্রমোচ্চ স্তরবিশিষ্ট অসম সামাজিক ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিরোধী। 

  • নাগরিকতার ধারণা এক সংহতি বা সংযুক্তির প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন ঘটায় যেখানে নাগরিকতার ক্রমবিস্তারমান বৃত্তের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয় সেই সমস্ত শ্রেণী বা বর্গের মানুষ যারা এতকাল এর বাইরে থাকতে বাধ্য হত। 

এই সমস্ত শ্রেণী বা বর্গের মানুষ হল প্রধানত প্রান্তিক বা পিছিয়ে পড়া মানুষ (যেমন শ্রমিক, কৃষক, নারী প্রভৃতি)। মার্শালের মতে নাগরিকতা যে সমতার প্রতিশ্রুতি বহন করে আনে তা সমাজে চলে আসা সংস্কৃতিগত, জাতপাত, লিঙ্গভিত্তিক অসাম্যগুলিকে দূরে সরিয়ে দিয়ে এক সাম্যভিত্তিক মর্যাদাপুর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে। যেমন রাষ্ট্র কর্তৃক সকল নাগরিকের সমান অধিকারের প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্রীয় আইনের দ্বারা সকল নাগরিকের সমান সংরক্ষণ প্রভৃতি (ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, অবস্থা নির্বিশেষে) -র মূলে আছে এক নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ধারণা। যে রাষ্ট্রের কাছে সকল নাগরিকই সমান এবং যে রাষ্ট্র সমস্ত নাগরিককে সমান মাপকাঠিতে বিচার করবে বা দেখবে তা সেই নাগরিক যে শ্রেণীগত অবস্থান থেকেই আসুক না কেন। মার্শালের মতে সামাজিক নাগরিকত্বের বিস্তার বুর্জোয়া বা উদারনৈতিক রাজনৈতিক ব্যবস্থাতেই ঘটেছে, এর আগে অন্য কোন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সামাজিক নাগরিকত্বের বিস্তার ঘটেনি।

সমালোচনা : মার্শালের নাগরিকত্বের ধারণা নানা দিক থেকে তীব্রভাবে সমালোচিত হয়েছে। মার্কসবাদীরা, নারীবাদীরা তো বটেই, এমনকি অনেক উদারনৈতিক তাত্ত্বিকও মার্শালের নাগরিকতার তত্ত্বের সমালোচনা করেছেন। যেমন Dahrendorf (1959) মন্তব্য করেছেন যে যদিও মার্শাল তার সামাজিক নাগরিকতার ধারণায় শিল্পগত অধিকার (industrial right)-কে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন এবং এই অধিকারের স্বীকৃতি সামাজিক সর্বজনীন নাগরিকতার বিস্তারে যথেষ্ট সাহায্য করেছে বলে মনে করেছেন তাও তিনি এই অধিকারকে নাগরিকতার অত্যাবশ্যকীয় উপাদান বলে স্বীকার করেন নি এবং নাগরিকতার ত্রিবিধ অধিকারের (পৌর, সামাজিক, রাজনৈতিক) সঙ্গে একে যোগ করেন নি। তিনি আরও বলেছেন যে যদিও মার্শাল মনে করেন। উদারনৈতিক নাগরিকতার ধারণা শ্রেণীবৈষম্য কমাতে সাহায্য করে কিন্তু বুর্জোয়া ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও সম্পদ নিয়ে তিনি কোনরকম আলোচনা করেন নি।

নাগরিকতার বুর্জোয়া তত্ত্বের বিরুদ্ধে মার্কসীয় সমালোচনা

মার্শালের তত্ত্বের বিরুদ্ধে সবচেয়ে জোরালো সমালোচনা এসেছে মার্কসবাদীদের কাছ থেকে। মার্কস দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন উদারনৈতিক বা বুর্জোয়া নাগরিকত্বের সাম্য ও স্বাধীনতার দাবী ধনতন্ত্রের সঙ্গে কখনই সঙ্গতিপূর্ণ নয়। মার্কসের মতে আধুনিক রাষ্ট্র হল বুর্জোয়া রাষ্ট্র যা বুর্জোয়া শ্রেণীর স্বার্থকে রক্ষা করার জন্য কাজ করে এবং এই ধরনের রাষ্ট্রে সম অধিকারসম্পন্ন নাগরিকতা কখনই সম্ভব নয়। মার্কসের মতে উদারনৈতিক বা বুর্জোয়া ব্যবস্থা মুখে সাম্য ও সমানাধিকারের কথা বললেও এই ব্যবস্থা ক্রমোচ্চ স্তর বিশিষ্ট। এখানে সাধারণ নাগরিকদের স্বার্থ সর্বদাই উপেক্ষিত হয়। মার্কস বুর্জোয়া ব্যবস্থায় নাগরিক অধিকারের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেছেন এই ব্যবস্থায় নাগরিক অধিকার সমাজস্থ মানুষের অধিকার নয়, এই অধিকার হল সমাজবিচ্ছিন্ন, আত্মসর্বস্ব মানুষের অধিকার। মার্কস নাগরিকতা ও নাগরিক অধিকার নিয়ে আরও গভীরে গিয়ে আলোচনা করেছেন। অ্যামি বার্থলোমিউ (Amy Bartholomew) দেখিয়েছেন মার্কস তাঁর সুবিখ্যাত On the Jewish Question নামক গ্রন্থে মানুষের অধিকার (rights of man) ও নাগরিক অধিকারের (rights of citizens) মধ্যে পার্থক্য করে তথাকথিত মানুষের অধিকারকে নস্যাৎ করে নাগরিক অধিকারকে তুলে ধরেছেন।

মার্কস মানুষের অধিকার যেমন ধর্মের অধিকার, সাম্য, স্বাধীনতা, নিরাপত্তা, ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার প্রভৃতি যেগুলি ফরাসী বিপ্লব ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অধিকারের ঘোষণাপত্রে তুলে ধরা হয়েছিল ও নাগরিক অধিকার বলে বুর্জোয়া তাত্ত্বিকদের দ্বারা প্রচার করা হয়েছিল সেগুলি ‘প্রকৃত’ নাগরিক অধিকার বলে মানতে চান নি। তার মতে এগুলি সমাজবিচ্ছিন্ন, আত্মসর্বস্ব, স্বার্থপর ব্যক্তি মানুষের অধিকার। এইসমস্ত ব্যক্তি সমাজ ও কৌম (community) থেকে বিচ্ছিন্ন; সমাজ, কৌম ও অন্যান্য মানুষের সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক প্রতিদ্বন্দ্বিতার বলে এখানে মনে করা হয়। সহযোগিতা, সহমর্মিতার পরিবর্তে মানুষ মানুষের শত্রু বলে এখানে ধরে নেওয়া হয়। একজন ব্যক্তির ভাল তখনই হবে যখন সে অন্য ব্যক্তি বা ব্যক্তি সম্প্রদায়কে ঠকাতে পারবে। মার্কসের মতে ধর্মের অধিকার, সমতার অধিকার, ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার প্রভৃতি অধিকারগুলি সমাজবিচ্ছিন্ন, একাকী, স্বার্থসর্বস্ব ব্যক্তি মানুষের অধিকার যার সঙ্গে সামাজিক কল্যাণ, কৌমের অধিকার বা মানব প্রজাতির অস্তিত্ব রক্ষা প্রভৃতির কোনরকম সম্পর্ক নেই। মার্কস নাগরিক অধিকারের এক বিকল্প ধারণা প্রদান করেছেন। এই ধারণা অনুযায়ী নাগরিক অধিকার হল পৌর ও রাজনৈতিক অধিকার এবং গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের অধিকার। মার্কস এই নাগরিক অধিকারকে শ্রেয় মনে করেছেন কারণ এই অধিকার নাগরিকরা ভোগ করবে বিচ্ছিন্ন আত্মসর্বস্ব ব্যক্তি হিসাবে নয়, কৌমের সদস্য হিসাবে। কৌমের সদস্য বা সভ্য হিসাবে নাগরিক তার অধিকারের মাধ্যমে শুধু নিজের বিশেষ স্বার্থ নয়, সামাজিক স্বার্থ রক্ষায় অগ্রাধিকার দেবে। অধিকারের এই সামাজিক ভিত্তিকে মার্কস বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন কারণ তা ব্যক্তিকে তার স্বার্থ-সর্বস্বতা থেকে বের করে নিয়ে আসতে পারবে। মার্কস নাগরিকের গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের অধিকারকে বা রাজনৈতিক অধিকারকে বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন কারণ তা একদিকে যেমন রাষ্ট্রীয় স্বেচ্ছাচারকে রুখতে সাহায্য করবে, একই সঙ্গে তা রাজনীতিতে গণ-অংশগ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধি করে একধরনের যৌথ কর্মকাণ্ডের সূচনা করবে। তিনি বাক্য ও মতামত প্রকাশের অধিকার, সংঘ গঠনের অধিকার, সর্বজনীন ভোটাধিকার প্রভৃতিকে সমর্থন করেছেন এই যুক্তিতে যে এগুলি পুরোপুরি প্রযুক্ত হলে শান্তিপূর্ণ পথে সামাজিক পরিবর্তন সম্ভব হবে। এককথায় মার্কস মনে করেন, মানুষের অধিকার বুর্জোয়া ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ থেকে উদ্ভূত হয়েছে, যার মূলকথা হল ব্যক্তিস্বার্থ, যার সঙ্গে কৌমের বা সমষ্টির ভালমন্দের কোন সম্পর্ক নেই। তাই মার্কস এই নাগরিকতার ধারণাকে সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করেছেন।

নাগরিকতার নারীবাদী সমালোচনা

মার্কসবাদীদের মতো নারীবাদী তাত্ত্বিকরাও উদারনৈতিক বা বুর্জোয়া নাগরিকতার ধারণাকে তীব্রভাবে সমালোচনা করেছেন। মার্কসবাদীরা দেখিয়েছেন সমাজে অসাম্য বর্তমান থাকলে নাগরিকতা কখনই পূর্ণরূপে বিকশিত বা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। একইরকমভাবে, যদিও ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে, নারীবাদীরাও দেখিয়েছেন নাগরিকতার ধারণা কিভাবে সমগ্র নারীসমাজের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন। নারীবাদীরা প্রধানত দুটি দিক থেকে নাগরিকতার প্রচলিত উদারনৈতিক ধারণার সমালোচনা করেছেন।

প্রথমত, তাদের মতে নাগরিকতার ধারণা সমাজে নারী ও পুরুষের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য আছে তাকে স্বীকার না করে নাগরিকতার সাধারণ ও অভিন্নতার যে ধারণা প্রচার করে তা নারীদের বঞ্চিত করার এক পুরুষতান্ত্রিক ছক ছাড়া আর কিছুই নয়। তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন বর্তমান সমাজে পুরুষদের আধিপত্য ও বিশেষাধিকার বর্তমান। এই অবস্থায় নাগরিকতার যে সাধারণ ও অভিন্ন ধারণা প্রচার করা হয়, সাম্য ও সমানাধিকারের কথা বলা হয় তার কোন বাস্তব ভিত্তি নেই। আইনগত সাম্যের মধ্যেই নারীদের প্রতি বঞ্চনা ও অসাম্য বর্তমান।

দ্বিতীয়ত, নাগরিকতা সম্পর্কে আজ অবধি যে সমস্ত ধারণা গড়ে উঠেছে তাদের সবকটিতেই কারা রাষ্ট্রের সদস্য ও কারা সদস্য নয় – এই বিভাজনের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। নাগরিকতার ধারণায় যে আলোচনাপদ্ধতি গড়ে উঠেছে তাতে নাগরিকতাকে একটি সর্বজনীন ক্ষেত্র (Public domain) বলে ধরে নেওয়া হয়েছে সেখানে পুরুষদের একাধিপত্য থাকবে। উদারনৈতিক নাগরিকতার ধারণা যে সর্বজনীনতা ও সাধারণত্ব (universality and generality) দাবী করে তাতে ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, শ্রেণী প্রভৃতি বিষয়গুলি সর্বজনীন ক্ষেত্রের বাইরে সরে গিয়ে ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে পর্যবসিত হয়। বুর্জোয়া বা উদারনৈতিক নাগরিকত্বের মাহাত্ম্য ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য, ব্যক্তিকে স্বাধীন নাগরিক হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য এর বিশেষ প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এর ফলে ঘর, গৃহস্থালী ব্যক্তিগত ক্ষেত্র হিসাবে চিহ্নিত হল এবং নারীরা বৃহত্তর সর্বজনীন ক্ষেত্র থেকে বঞ্চিত হলেন এবং তাদের পুরুষতান্ত্রিকতার কাছে বশ্যতা স্বীকার করতে হল। তাই নারীবাদী তাত্ত্বিকরা দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করলেন যে প্রাচীন ও আধুনিক নাগরিকত্বের ধারণা দুইই নারী বিরোধী। প্রাচীনকালে নারীকে নাগরিকতা থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত করা হয়েছিল, কিন্তু বর্তমান যুগে নারীকে নাগরিকতার অধিকার দেওয়া হয়েছে। মা বা স্ত্রী হিসাবে নারীরা গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক উপযোগিতাপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, কিন্তু এইভাবে নারীকে ঘরে আবদ্ধ রেখে তাদের রাজনীতির বৃহত্তর ক্ষেত্র থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাদের ক্ষমতায়নের পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা, সম্পত্তির অধিকার প্রভৃতি থেকে নারীকে বঞ্চিত করে রাজনীতিতে বা বৃহত্তর সামাজিক সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের ব্রাত্য করে রাখা হয়েছে।

বিভিন্ন যুগে নাগরিকতার বিবর্তন

নাগরিকতার ধারণা ইতিহাসের ভিন্ন যুগে বিবর্তিত হয়েছে। নাগরিকতার উদ্ভবের প্রাথমিক পর্যায়ে নাগরিকতার ধারণা ছিল খুবই সংকীর্ণ। কিন্তু গণতন্ত্র যতই অগ্রসর হয়েছে নাগরিকতার ধারণা ততই তার সঙ্কীর্ণতা কাটিয়ে উঠে সর্বজনীন বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

গ্রীকো-রোমান যুগে নাগরিকতা

গ্রীকো-রোমান যুগে নাগরিকতা সকলের জন্য উন্মুক্ত ছিল না। জনগণের এক ক্ষুদ্র অংশ কেবলমাত্র এই অধিকার ভোগ করতে পারত। গ্রীকযুগে নাগরিকতার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল নগর রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থা পরিচালনায় অংশগ্রহণের প্রশ্নটি। প্লেটো, অ্যারিস্টটলের মতে শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণের যোগ্যতা জনগণের সকল অংশের থাকে না, যাদের যোগ্যতা নেই তাদের এই অধিকার দিলে দেশের সাধারণ স্বার্থ বিপন্ন হবে। তাই গ্রীকযুগে নাগরিকতা সীমাবদ্ধ ছিল শুধুমাত্র দেশে জন্ম নেওয়া মুক্ত পুরুষ সদস্যদের মধ্যে (যারা শাসন পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ অংশ নেওয়ার যোগ্যতার অধিকারী বলে মনে করা হত), আর জনসাধারণের বৃহত্তর অংশ যেমন নারী, শিশু, ক্রীতদাস, বিদেশীরা এই অধিকারের বাইরে ছিল। সুতরাং গ্রীক যুগে নাগরিকতা কোন সাধারণ অধিকার ছিল না, তা ছিল এক ধরনের বিশেষ সুযোগ যা কেবলমাত্র শিক্ষিত সম্পত্তিবান পুরুষমানুষরা ভোগ করত। নাগরিকতার অধিকার এই শ্রেণীর মানুষদের দিত প্রচুর স্বাধীনতা ও রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণের সুযোগ, এককথায় গণক্ষেত্রে (Public domain) প্রভাব বিস্তারের অবাধ সুবিধা, অন্যদিকে নারীরা ঘরগৃহস্থালীর সঙ্কীর্ণ ক্ষেত্রে, ক্রীতদাসরা উৎপাদন ও সেবাকাজের মত অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আবদ্ধ থাকতে বাধ্য হত। নাগরিকতা বা রাষ্ট্রীয় কাজকর্মে অংশগ্রহণের গণতান্ত্রিক অধিকার তাদের কাছে অধরাই রয়ে যেত।

রোমান যুগে নাগরিকতার ধারণা অনেকটাই পরিবর্তিত হল। এই সময় গ্রীক যুগে নাগরিকদের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সক্রিয় অংশগ্রহণের যে বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব পেত তা অনেকটাই কমে গেল। এর পরিবর্তনের পিছনে যে বাস্তব কারণটি ছিল তা হল রোমান সাম্রাজের বিস্তারের ফলে অনেক নতুন জায়গা এর অন্তর্ভুক্ত হল, এখানকার জনসাধারণ ছিল মিশ্র প্রকৃতির (heterogeneous) –এরূপ এক বিরাট সাম্রাজ্যকে ধরে রাখার তাগিদে রোমানরা গ্রীক বাদ দেবার (exclusion) নীতির পরিবর্তে অন্তর্ভুক্তির (inclusion) নীতি গ্রহণ করল। রোমান এক দ্বিবিধ নাগরিকতার ব্যবস্থা চালু করল – (ক) পোলিস বা মূল রোমান শহরগুলিতে এক সমরূপ বা অভিন্ন নাগরিকতার ব্যবস্থা ছিল যেখানে নাগরিকরা সমান অধিকার বা সুযোগসুবিধা ভোগ করত, রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ তাদের কাছে উন্মুক্ত ছিল, (খ) আর মূল রোমান ভূখণ্ডের বাইরে, যে অংশগুলি রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হল (বিজিত হয়ে) সেখানে এক ধরনের নিষ্ক্রিয় নাগরিকত্ব প্রবর্তিত হল। এই নাগরিকরা রাষ্ট্রের দেওয়া কিছু সুযোগসুবিধা ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার আইনগত অধিকার বা মর্যাদা (legal status) ভোগ করলেও রাজনীতিতে বা সরকার পরিচালনায় অংশগ্রহণের সুযোগ (political status) এদের ছিল না। অতএব রোমে এক দ্বিস্তরীয় (twotier) নাগরিকতার সূচনা হল।