চীনে ১৯১৯ সালের ৪ঠা মের আন্দোলনের মাধ্যমে ‘নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব’-এর ধারাটি পরিলক্ষিত হয়। পরবর্তী পর্যায়ে শ্রমিক কৃষকের নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত হয়। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা, সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে এই আন্দোলন পরিচালিত হতে থাকে। এই নতুন পর্যায়ের আন্দোলনের মাধ্যমে নতুন সাংস্কৃতিক বিপ্লবেরও সূত্রপাত ঘটে। ১৯৪৯ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠিত হয়। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির পরিচালনায় শ্রমিক-কৃষকের মৈত্রী ও বুর্জোয়াদের সহযোগিতায় বিপ্লবের এই পর্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। আধা-সামন্ততান্ত্রিক ও আধা-ঔপনিবেশিক সমাজব্যবস্থা এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার অন্তর্বর্তী একটা উত্তরণশীল পর্যায় হল নয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লব। এ হল নতুন এক গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে পরিচালিত বিপ্লব।
‘নয়া-গণতন্ত্র প্রসঙ্গে’ (On New Democracy) শীর্ষক একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় ১৯৪০ সালের জানুয়ারি মাসে। প্রবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয় ‘Chinese Culture’ নামে একটি সাময়িক পত্রিকার প্রথম সংখ্যায়। রাষ্ট্রদর্শনের ইতিহাসে এই প্রবন্ধটি মাও-এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবদান। গণতন্ত্র সম্পর্কিত মাও এর ভাবনা তাঁর বিপ্লব সম্পর্কিত ধ্যান-ধারণারই পরিপুরক। নয়া চীন গড়ে তোলার অঙ্গীকারই অভিব্যক্তি লাভ করেছে নয়া গণতন্ত্রের ধারণায়। মাও-এর ‘নয়া-গণতন্ত্র প্রসঙ্গে’ শীর্ষক প্রবন্ধে প্রকাশিত হয়েছে নয়া গণতন্ত্রের রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং জাতীয় বৈজ্ঞানিক ও গণ-সংস্কৃতি সম্পর্কিত ধ্যান-ধারণা।
মাও-এর মতানুসারে নতুন চীন গড়ে তোলাই হল লক্ষ্য। কমিউনিস্টরা রাজনীতিক, আর্থনীতিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের স্বার্থে দীঘদিন ধরে বিপ্লবের সামিল হয়েছেন ও থেকেছেন। দীর্ঘকালীন এই বিপ্লবেরই ফল হল চীনের মানুষজনের জন্য নূতন এক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সমাজব্যবস্থা। নতুন এই রাষ্ট্র ও সমাজে থাকবে নয়া-রাজনীতি, নয়া অর্থনীতি ও নয়া-সংস্কৃতি। পুরাতন রাজনীতিক আর্থনীতিক ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সামন্ততান্ত্রিক সমাজ বদলে ফেলতে হবে। বিদেশি পুঁজিবাদি আক্রমণের ফলে উদ্ভূত ঔপনিবেশিক, আধা ঔপনিবেশিক এবং আধা-সামন্ততান্ত্রিক সমাজ পাল্টে ফেলতে হবে। তারপর গড়ে তুলতে হবে নয়া সমাজ, নয়া-রাজনীতি, নয়া-অর্থনীতি ও নয়া-সংস্কৃতি।
দুটি স্তরের ভিতর দিয়ে চীনের বিপ্লব অগ্রসর হবে। এই দুটি স্তর হল— গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। বিপ্লবের প্রথম স্তরের কাজ হল ঔপনিবেশিক, আধা-ঔপনিবেশিক ও আধা-সামস্ততান্ত্রিক প্রকৃতির সমাজকে গণতান্ত্রিক সমাজে বদলে দেওয়া। বিপ্লবের দ্বিতীয় স্তরের কাজ হল বিপ্লবকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা।
নয়া গণতন্ত্রের রাজনীতি:
মাও-এর একটি বিশিষ্ট রচনা হল ‘The Chinese Revolution and the Chinese Communist Party’। রচনাটি ১৯৩৯ সালে প্রকাশিত হয়। নয়া-গণতন্ত্রের রাজনীতি সম্পর্কিত মাও-এর স্থুল ধারণাটি এই রচনার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। মাও-এর মতানুসারে নয়া-গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হল এক ধরনের গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। এই গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র সর্বহারার নেতৃত্বে পরিচালিত। এই রাজনীতিক ব্যবস্থা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী এবং সামন্ততন্ত্র বিরোধী জনগোষ্ঠীর যৌথ একনায়কত্বের অধীনে পরিচালিত। মাও-এর অভিমত অনুযায়ী সর্বহারা, কৃষক, বুদ্ধিজীবী এবং পাতি বুর্জোয়াশ্রেণীর অংশবিশেষ হল চীনের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে মূল শক্তি। মাও-এর অভিমত অনুযায়ী ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্যগত বিচারে চীনের বিপ্লব গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র এই দুটি পর্যায়ে বিভক্ত। মাও তাঁর On New Democracy শীর্ষক এক প্রবন্ধে মাও লিখেছেন: “The historical characteristic of the China Revolution is that it is divided into two steps that of democracy and that of socialism.” বিপ্লবের গণতান্ত্রিক পর্যায়টি হল এক বিশেষ এবং নতুন ধরনের গণতন্ত্র (New Democracy)। এই গণতন্ত্র কোন সাধারণ গণতন্ত্র নয়, এ হল চৈনিক ধাঁচের বিশেষ গণতন্ত্র। মাও বলেছেন: “The democracy of the first step is not democracy in its general sense, but a new special type of a chinese style, the ‘New Democracy’.” মাও বলেছেন: চীনের বিপ্লব দুটি ঐতিহাসিক পর্যায়ে বিভক্ত; প্রথম পর্যায়টি হলো নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব। এই হলো চীনের বিপ্লবের নতুন ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্য।’
জনগণের গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব:
নয়া গণতন্ত্রে ‘জনগণের গণতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্র’ (People’s Democratic Dictatorship) প্রতিষ্ঠিত হয়। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠনের জন্য নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব প্রয়োজন। এই বিপ্লব সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক স্তর হিসাবে কাজ করে। ইউরোপ ও মার্কিন বিপ্লবের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় বুর্জোয়া ও একনায়কত্বের অধীন পুঁজিবাদী গণতন্ত্র। পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু চীনের নয়া গণতন্ত্রে জনগণের গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। চীনের আধা-সামন্ততান্ত্রিক ও আধা-ঔপনিবেশিক সমাজব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এ হল এক নতুন ধরনের একনায়কত্ব। মাও তাঁর ‘নয়া গণতন্ত্র’ শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “এই ধরনের নয়া-গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র একদিকে যেমন পুরনো ইউরোপ আমেরিকার বুর্জোয়া একনায়কত্বাধীন পুঁজিবাদী প্রজাতন্ত্র থেকেও স্বতন্ত্র, যা হচ্ছে পুরনো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র এবং ইতিমধ্যে যা সেকেলে হয়ে গেছে; অন্যদিকে তেমনি তা সোভিয়েত ধরনের সর্বহারা একনায়কত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র থেকেও স্বতন্ত্র, যে প্রজাতন্ত্র ইতিমধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নে বিকশিত হয়ে উঠেছে, এবং যা সমস্ত পুঁজিবাদী দেশগুলিতে প্রতিষ্ঠিত হবে। আর সমস্ত শিল্পোন্নত দেশের রাষ্ট্রীয় ও সরকারী কাঠামোয় এটাই নিঃসন্দেহে হবে সর্বপ্রধান রূপ। কিন্তু একটা নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক সময়কালে ঔপনিবেশিক ও আধা-ঔপনিবেশিক দেশের বিপ্লবের জন্য এই ধরনের প্রজাতন্ত্র উপযুক্ত নয়। তাই একটি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক সময়কালে সমস্ত ঔপনিবেশিক ও আধা-ঔপনিবেশিক দেশের বিপ্লবে তৃতীয় ধরনের রাষ্ট্ররূপই কেবল গ্রহণ করা যায়, সেই রাষ্ট্ররূপই হলো নয়া-গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। এটা এক নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক সময়কালের রাষ্ট্ররূপ, তাই এটা হচ্ছে অন্তবর্তী রূপ; কিন্তু এটা অপরিহার্য রূপ, এটাকে বাদ দেওয়া যায় না।”
মাও নয়া-গণতন্ত্রে ‘জনগণের গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব’-এর ধারণা সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। মাও-এর অভিমত অনুযায়ী নয়া গণতন্ত্রের জনগণ হল শ্রমিক-কৃষক, শহরের পাতি বুর্জোয়া এবং জাতীয় বুর্জোয়ারা। এদের একনায়কত্বই হল নয়া গণতন্ত্রে জনগণের একনায়কত্ব। জনগণের জন্য গণতন্ত্র এবং প্রতিক্রিয়াশীলদের জন্য ‘দমনমূলক ব্যবস্থা’ –এই দু’-এর সমাহারই হল জনগণের গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব। মাও লিখেছেন: “The combination of these two aspects, democracy for the people and dictatorship over the reactionaries, is the People’s Democratic Dictator ship.” মাও বলেছেন: “…চীনের সর্বহারা শ্রেণী, কৃষক, বুদ্ধিজীবী ও অন্যান্য পাতি বুর্জোয়ারাই হচ্ছে মূলশক্তি যা দেশের ভাগ্য নির্ধারণ করবে। …যে চীনা গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র আজ আমরা গঠন করতে চাই তা সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে সকল সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী ও সামন্তবাদ-বিরোধী জনগণের যুক্ত একনায়কত্বাধীন গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রই কেবল হতে পারে। এটাই হবে নয়া গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, খাঁটি বিপ্লবী তিনটি মহান কর্মনীতিসহ নতুন তিন গণনীতির প্রজাতন্ত্র।”
তিন ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থা:
রাজনীতিক ক্ষমতার শ্রেণীগত বৈশিষ্ট্যের পরিপ্রেক্ষিতে মাও দুনিয়ার রাষ্ট্রব্যবস্থাসমূহকে তিন ভাগে বিভক্ত করেছেন। এই তিন প্রকার রাষ্ট্রব্যবস্থা হল:
-
(১) বুর্জোয়াশ্রেণীর একনায়কত্বাধীন প্রজাতন্ত্র,
-
(২) সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বাধীন প্রজাতন্ত্র এবং
-
(৩) কয়েকটি বিপ্লবী শ্রেণীর যুক্ত একনায়কত্বাধীন প্রজাতন্ত্র।
প্রথম প্রকার হচ্ছে পুরোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। দ্বিতীয় প্রকারের রাষ্ট্রব্যবস্থা পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রব্যবস্থা। এবং তৃতীয় প্রকারটি হল ঔপনিবেশিক ও আধা-ঔপনিবেশিক দেশসমূহের বিপ্লবের অন্তর্বর্তী রাষ্ট্ররূপ। মাও বলেছেন: “আজকের চীনে এই নয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্ররূপ হলো জন-বিরোধী যুক্তফ্রন্টের রূপ। এটা জাপান-বিরোধী ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী; এটা আবার কয়েকটি বিপ্লবীশ্রেণীর মৈত্রীবন্ধন এবং একটি যুক্তফ্রন্টও বটে।”
সরকারের শাসন প্রণালী:
মাও নয়া-গণতন্ত্রে সরকারের শাসন প্রণালী সম্পর্কেও বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। মাও বলেছেন: “রাষ্ট্রব্যবস্থা হলো সকল বিপ্লবী শ্রেণীগুলির মিলিত একনায়কত্ব এবং সরকারের শাসনপ্রণালী হলো গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা। এই হলো নয়া গণতন্ত্রের রাজনীতি…।” মাও চীন দেশে জনগণের কংগ্রেস সমন্বিত ব্যবস্থা প্রবর্তনের কথা বলেছেন। জাতীয় গণকংগ্রেস থেকে শুরু করে নিচের দিকে প্রদেশ, জেলা, মহকুমা ও থানার গণকংগ্রেস পর্যন্ত সকল স্তরে এই কংগ্রেস থাকবে। প্রত্যেক স্তরেই এগুলি নিজেদের সরকারী সংস্থাসমূহ নির্বাচন করবে। প্রকৃত সার্বজনীন ও সমান ভোটাধিকারের ভিত্তিতে পরিচালিত একটি নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হবে। এই ব্যবস্থা রাষ্ট্রের মধ্যে বিভিন্ন বিপ্লবী শ্রেণীর যথাযথ অবস্থানের জনগণের সত্যিকার মতপ্রকাশের, বিপ্লবী সংগ্রাম পরিচালনার এবং নয়া গণতন্ত্রের মনোবৃত্তির পক্ষে সম্যকভাবে উপযুক্ত। এই ব্যবস্থাই হল গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার ব্যবস্থা।
মাওয়ের মতানুসারে কেবলমাত্র গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সরকারই সকল বিপ্লবী জনগণের মতামতকে সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করতে পারে এবং বিপ্লবের শত্রুর বিরুদ্ধে সর্বাধিক কার্যকরীভাবে সক্রিয় হতে পারে ও সংগ্রাম করতে পারে। মাও বলেছেন: “মুষ্টিমেয় লোকের একচেটিয়া অধিকারে নয়, এই মনোভাব সরকারের মধ্যে ও সৈন্যবাহিনীতে থাকতে হবে; খাঁটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছাড়া এই লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে না এবং সরকারের শাসন প্রণালী ও রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে সামঞ্জস্য থাকবে না।”
নয়া গণতন্ত্রের অর্থনীতি:
মাও কেবলমাত্র রাজনীতিক ক্ষেত্রে নয়, আর্থনীতিক ক্ষেত্রেও নয়া-গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। রাজনীতিক ব্যবস্থার মত আর্থনীতিক ব্যবস্থাকে নয়া-গণতান্ত্রিক হতে হবে। নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবে বৃহৎ একচেটিয়া প্রতিষ্ঠানসমূহের জাতীয়করণের কথা বলা হয়। বলা হয় যে, নয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বড় ব্যাঙ্ক, বড় বড় শিল্প ঠান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রের মালিকানাধীনে থাকবে। এর উদ্দেশ্য ছিল ব্যক্তিগত পুঁজি যেন জনগণের জীবনযাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে। তাই যে সমস্ত পুঁজি জনগণের জীবনযাত্রাকে পরিচালিত করে না তার উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়নি। মাও বলেছেন: “যে প্রতিষ্ঠানগুলি একচেটিয়া চরিত্রের অথবা ব্যক্তিগত ব্যবস্থাপনার পক্ষে অত্যন্ত বড় – যেমন ব্যাঙ্ক, রেলপথ, বিমানপথের মত প্রতিষ্ঠানসমূহ—সেগুলি রাষ্ট্র কর্তৃক পরিচালিত ও শাসিত হবে, যাতে ব্যক্তিগত পুঁজি জনগণের জীবনযাত্রার ওপর আধিপত্য না করতে পারে; এই হচ্ছে পুঁজি নিয়ন্ত্রণের মৌলিক নীতি।” মাও আরও বলেছেন: “পুঁজিনিয়ন্ত্রণ’ এবং ‘ভূমিস্বত্ব সমীকরণে’র পথ ধরে চীনের অর্থনীতিকে চলতে হবে এবং কোন মতেই তাকে ‘মুন্ডিমেয় লোকের একচেটিয়া অধিকারে থাকতে দেওয়া হবে না; ।”
জাতীয় অর্থনীতির মূলভিত্তি হবে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন উদ্যোগ। নয়া-গণতন্ত্রের অর্থনীতি পুঁজির নিয়ন্ত্রণ এবং ভূমিস্বত্বের সমতার পথে পরিচালিত হবে। সমাজতান্ত্রিক উপাদান ও বৈশিষ্ট্যের উপর গুরুত্ব আরোপিত হবে। মাও বলেছেন: “এটাই হলো নয়া-গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের অর্থনৈতিক কাঠামো গঠনের নির্ভুল কর্মনীতি। সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বে পরিচালিত নয়া-গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অর্থনীতি সমাজতান্ত্রিক চরিত্র সম্পন্ন হবে। এবং এটাই হবে সমূহ জাতীয় অর্থনীতির পরিচালক শক্তি। কিন্তু এই প্রজাতন্ত্র অন্যান্য ধরনের পুঁজিবাদী ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করবে না, এবং যে পুঁজিবাদী উৎপাদন ‘জনগণের জীবনযাত্রার ওপর আধিপত্য’ করতে পারেনা—তার বিকাশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করবে না। কারণ চীনের অর্থনীতি এখনও অত্যন্ত পশ্চাৎপদ স্তরে রয়েছে।”
সমবায়ভিত্তিক উদ্যোগসমূহ সমাজতান্ত্রিক নীতির অনুগামী হবে। চীনের আর্থনীতিক কাঠামোতে মুষ্টিমেয়ের একচেটিয়া অধিকার স্বীকার করা হবে না। গ্রামাঞ্চলে সামন্ততান্ত্রিক সম্পর্কের অবসান ঘটবে। প্রকৃত চাষীকেই জমি বণ্টন করা হবে। কিন্তু চীনের অর্থনীতি অনগ্রসর হওয়ার কারণে, এই পর্যায়ে সকল ব্যক্তিগত মালিকানার বিলোপ সাধনের নীতি গ্রহণ করা হয়নি। মাও বলেছেন: “গ্রামাঞ্চলের ধনী কৃষকের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে যেমন আছে তেমনই চলতে দেওয়া হবে। এই হলো ‘ভূমিস্বত্ব সমীকরণের’ নীতি। এই নীতির সঠিক স্লোগান হচ্ছে ‘কৃষকের হাতে জমি’। এই পর্যায়ে সাধারণভাবে সমাজতান্ত্রিক কৃষিব্যবস্থা স্থাপন করা হবে না, কিন্তু ‘কৃষকের হাতে জমি’—এই নীতির ভিত্তিকে বিকশিত নানা ধরনের সমবায় অর্থনীতিতে সমাজতান্ত্রিক উপাদানও থাকবে।”
মাওয়ের ভাষ্য অনুযায়ী এই হল নয়া গণতন্ত্রের অর্থনীতি। এবং নয়া গণতন্ত্রের রাজনীতি হল এই নয়া গণতান্ত্রিক অর্থনীতির কেন্দ্রীভূত অভিব্যক্তি।
নয়া গণতন্ত্রের সংস্কৃতি:
মাওয়ের মতানুসারে নির্দিষ্ট যে কোন সংস্কৃতিই হল নির্দিষ্ট একটি সমাজের সমকালীন রাজনীতি ও অর্থনীতির ভাবাদর্শগত প্রতিফলন। সাংস্কৃতিক বিপ্লব হল গণ-বিপ্লবের শক্তিশালী হাতিয়ার। মাও বলেছেন: “Revolutionary culture is a powerful revolutionary weapon of the people.” স্বভাবতই গণ-বিপ্লবের উদ্দেশ্যের মধ্যে রাষ্ট্রব্যবস্থা ও অর্থনীতির সঙ্গে গণ-সংস্কৃতিও অন্তর্ভুক্ত। নয়া গণতন্ত্রে জনগণের স্বার্থে সাংস্কৃতিক আন্দোলন পরিচালিত হয়। নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবে বিজ্ঞানসম্মত জাতীয় ও গণসংস্কৃতির কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়। মাও বলেছেন। নতুন সংস্কৃতি হচ্ছে নতুন রাজনীতি ও নতুন অর্থনীতির ভাবাদর্শগত প্রতিফলন। নতুন রাজনীতি ও নতুন অর্থনীতির সেবা করাই এর কাজ।”
নয়া গণতন্ত্রের সংস্কৃতি হল নতুন বিপ্লবী সংস্কৃতি। এ হল এক জীবন-মরণ সংগ্রাম। এই সংগ্রাম পরিচালিত হয় চীনের সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে। এ সংগ্রাম হল প্রতিবিপ্লবের সঙ্গে বিপ্লবের সংগ্রাম। আগেকার রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি সম্ভুত বিরোধী শক্তিসমূহের সঙ্গে নয়াগণতান্ত্রিক সংস্কৃতি সংগ্রামের সামিল হয়।
মাওয়ের অভিমত অনুযায়ী ৪ঠা মের আন্দোলনের পরবর্তী কালে চীনের নতুন সংস্কৃতির সৃষ্টি হয়েছে। এই সংস্কৃতি নয়া গণতান্ত্রিক চরিত্রের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। এই সংস্কৃতি বিশ্বসর্বহারা শ্রেণীর সমাজতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক বিপ্লবের অংশ। এই সংস্কৃতি সব রকম সামন্ততান্ত্রিক ও কুসংস্কারমূলক ধারণার পরিপন্থী। নয়া গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির মূল কথা হল সাম্রাজ্যবাদী ও সামন্ততান্ত্রিক শাসন-শোষেণের বিরোধিতা এবং চীনের জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও জাতিগত বৈশিষ্ট্যসমূহের সংরক্ষণ। এই সাংস্কৃতিক বিপ্লব পরিচালিত হবে সর্বহারার নেতৃত্বে জনগণের ব্যাপক অংশের দ্বারা। মাও বলেছেন: “The culture of New Democracy is the anti-imperialist, anti-feudal culture of the mass and the people that led by proletariat.” মাও বলেছেন: “এই সমস্ত নতুন রাজনীতিক, আর্থনীতিক এবং সাংস্কৃতিক শক্তিই চীনে বিপ্লবী শক্তি, এগুলি পুরনো রাজনীতি, পুরনো অর্থনীতি, পুরনো সংস্কৃতির বিরোধী।” মাও আরও বলেছেন: “জনসাধারণের সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী, সামন্তবাদ-বিরোধী সংস্কৃতিকেই আমরা নয়া-গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বলছি; এই সংস্কৃতি আজ জাপ-বিরোধী যুক্তফ্রন্টের সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি পরিচালিত হতে পারে একমাত্র সর্বহারা শ্রেণীর সংস্কৃতি ও ভাবাদর্শ অর্থাৎ কমিউনিজমের ভাবাদর্শের দ্বারা; অন্য কোন শ্রেণীর সংস্কৃতি ও ভাবাদর্শের দ্বারা এই সংস্কৃতি পরিচালিত হতে পারে না। এক কথায়, নয়া গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি হলো সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্বাধীন জনসাধারণের সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী এবং সামন্তবাদ-বিরোধী সংস্কৃতি।
জাতীয় বৈজ্ঞানিক ও গণসংস্কৃতি:
পরিশেষে নয়া-গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বৈজ্ঞানিক প্রকৃতি এবং গণভিত্তি সম্পর্কে মাও আলোচনা করেছেন। মাও-এর মতানুসারে নয়া-গণতন্ত্রের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিকে সংমিশ্রিত করলেই নয়া গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রকে পাওয়া যাবে। চীনা জাতির নয়া সংস্কৃতি হল জাতীয় বৈজ্ঞানিক গণ সংস্কৃতি। মাও নয়া জাতীয় সংস্কৃতির বিকাশ সাধন এবং জাতীয় আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য আবশ্যক শর্তের কথা বলেছেন। এই শর্ত হল আগেকার সংস্কৃতির বিকাশ পর্যালোচনা করা এবং তার সামন্ততান্ত্রিক বিকাশকে বাদ দিয়ে গণতন্ত্রের সারমর্মকে গ্রহণ করা। চীনের শ্রমিক শ্রেণীর বৈজ্ঞানিক চিন্তা-ভাবনা আছে, আছে বস্তুবাদী প্রগতিশীল বুর্জোয়াদের এবং প্রকৃতি বিজ্ঞানীদের জোট গড়ে উঠার সম্ভাবনা। এখানে প্রতিক্রিয়াশীলদের জন্য কোন জায়গা নেই। নয়া-গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি সত্যের সন্ধান করে বাস্তব ঘটনার মধ্যেই। তাই নতুন এই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি হল বৈজ্ঞানিক।
চীনের জনগণের ব্যাপক অংশের সংস্কৃতি হল নয়া গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। বিপ্লবী মানুষের শক্তিশালী একটি বিপ্লবী হাতিয়ার হল বিপ্লবী সংস্কৃতি। মাও নয়া-গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিশেষ কিছু ভূমিকার কথা বলেছেন। এগুলি হল: শ্রমিক-কৃষক শ্রবজীবী জনতার স্বার্থ সংরক্ষণ; বিপ্লবী জনতা ও কর্মীদের সুশিক্ষিত করে তোলা; চীনের এই সমস্ত মানুষের সাংস্কৃতিক মানের উন্নতি সাধন, জনসাধারণের সঙ্গে নিবিড় সংযোগ সম্পর্ক সংরক্ষণ। চীনা সংস্কৃতির নিজস্ব রূপ হল জাতীয় রূপ। চীনের নয়া-গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে জাতীয় রূপ অর্জন করতে হবে। তারজন্য আবশ্যক হল চীন বিপ্লবের নির্দিষ্ট কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সামগ্রিকভাবে এবং সম্যকভাবে মার্কসীয় দর্শনের সর্বজনীন সত্যকে অঙ্গীভূত করা। জাতীয় সম্পদ, জাতীয় সংস্কৃতি ও সমগ্র চীন দেশের সমাজতান্ত্রিক আদর্শের সঙ্গে নয়া-গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। এই নয়া-গণসংস্কৃতি হবে বিশ্বসংস্কৃতির স্রষ্টা। পারস্পরিক আদান-প্রদান ও উন্নয়নের সহায়ক হিসাবে নয়া-গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তুলবে বিশ্ব সংস্কৃতি। নয়া-গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ধনতান্ত্রিক দেশের সংস্কৃতির দ্বারাও সমৃদ্ধ হবে। তবে সামগ্রিকভাবে পাশ্চাত্তীকরণকে স্বীকার বা সমর্থন করা হয় নি। যথেষ্ট বিচার-বিবেচনা করে পুঁজিবাদী দেশের সংস্কৃতি থেকে উপাদান নিতে হবে।
বর্তমানে চীন ‘নয়া-গণতন্ত্র’ থেকে ‘সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। মাওয়ের অভিমত অনুযায়ী চীনের বৈপ্লবিক ইতিহাস দু’টি পর্বে বিভক্ত—গণতান্ত্রিক পর্ব ও সমাজতান্ত্রিক পর্ব। সমাজতান্ত্রিক পর্বের উদ্দেশ্য ছিল বিপ্লবের গতিকে ত্বরান্বিত করা এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা। বর্তমানে চীনে জনগণের প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেশের শ্রমজীবী মানুষের নেতৃত্বে ও শ্রমজীবী মানুষের সহযোগিতায় এই রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। এ হল চীনের সর্বহারা শ্রেণীর এক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র।
নয়া গণতন্ত্র সম্পর্কে সমালোচনা:
নয়া-গণতন্ত্র সম্পর্কিত মাও-এর ধ্যান-ধারণা বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। সমালোচকরা মাও-এর নয়া-গণতান্ত্রিক ভাবনার সীমাবদ্ধতার বিবিধ দিক তুলে ধরেছেন। এ বিষয়ে আলোচনা আবশ্যক।
(১) প্রলেতারিয়েতের নেতৃত্বাধীনে নয়া-গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ সাধিত হবে—মাও-এর এই বক্তব্য বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে নয়। মূলত কৃষিবিপ্লব হল চীনের বিপ্লব। কৃষক শ্রেণীর হাতে ক্ষমতা নিয়ে আসার উদ্দেশ্যে এই বিপ্লব। মাও জাপান বিরোধী যুক্তফ্রন্টের সামিল করেছেন কৃষক, শ্রমিক, দেশপ্রেমিক, বুর্জোয়া এবং নিম্ন মধ্যবিত্তদের।
(২) সমালোচকদের অভিযোগ অনুযায়ী কমিউনিস্ট পার্টির মোহ ও দলীয় একনায়কত্বের ভাবনার দ্বারা গণতন্ত্র সম্পর্কিত মাও-এর ধারণা অল্পবিস্তর আচ্ছন্ন হয়েছে।
(৩) সমালোচকদের মতানুসারে নয়া গণতন্ত্র সম্পর্কিত মাও-এর মতবাদের মধ্যে মৌলিকত্বের অভাব আছে। লেনিনবাদী চিন্তা-ভাবনার প্রভাব এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত স্পষ্ট।
(৪) মাওবাদী নীতিতে সোভিয়েত বিপ্লবী মডেলকে প্রয়োজন মোতাবেক গ্রহণ করা হয়েছে এবং বর্জন করা হয়েছে। এই বিষয়টিকে নিয়ে মার্কসবাদী চিন্তাবিদদের মধ্যে বিতর্ক দেখা দিয়েছে।
(৫) চীনের পরবর্তী কালের রাজনীতিক নেতারা সাংস্কৃতিক বিপ্লব সম্পর্কিত মাও-এর প্রস্তাবকে স্বীকার বা সমর্থন করেননি।
(৬) রাষ্ট্রদার্শনিকরা সাধারণভাবে বিশ্বাস করেন যে গণতন্ত্র ও কেন্দ্রিকতার সহাবস্থান সম্ভব নয়। গণতন্ত্রের ব্যাপারে আস্থা জ্ঞাপন করা হয়েছে, কিন্তু কেন্দ্রিকতার প্রতি কমিউনিস্ট পার্টির আগ্রহ অধিক। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নীতি গ্রহণ করেছে।
(৭) পশ্চিমী উদারনীতিক গণতন্ত্রের সমর্থকদের অভিযোগ হল যে, মাও আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরোধিতা করেছেন; একথা ঠিক। তবে মাও-এর ক্যাডার ব্যবস্থা কতটা গণতন্ত্রসম্মত ও নিরপেক্ষ, সে বিষয়ে বিতর্কের অবকাশ আছে।
(৮) সমালোচকদের অভিযোগ অনুযায়ী শিক্ষা, পরিকল্পনা এবং শোধনবাদী নীতি সম্পর্কিত বিষয়াদি নিয়ে মাও বাস্তবে বাড়াবাড়ি করেছেন। তারফলে চীন দেশে গণতন্ত্র বা সমাজতন্ত্রের ক্ষেত্রে অভিপ্রেত সাফল্য আসেনি।
(৯) বিপ্লবের প্রাক্কালে মাও চীনের জনগণের সমস্যাদি সঠিক ও সম্যকভাবে পর্যালোচনা করেছেন। এ বিষয়ে দ্বিমতের অবকাশ নেই। কিন্তু বিপ্লবোত্তর পর্যায়ের পরিস্থিতি নিয়ে মাও-এর বিচার-বিশ্লেষণ কতটা সঠিক ছিল, সে বিষয়ে বিতর্কের অবকাশ আছে।
(১০) সোভিয়েত মডেলের সমর্থক চিন্তাবিদ্রাও গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র সম্পর্কিত মাও-এর ধ্যান ধারণাকে সমর্থন করেননি।
(১১) কৃষি সংস্কার, শিল্পনীতি, সমবায় প্রতিরক্ষা কৌশল, সাংস্কৃতিক বিপ্লবের হটকারিতা, উল্লম্ফনের নীতি, শুদ্ধিকরণ প্রভৃতি বিষয়ে মাও-এর ভাবনা নিয়ে পার্টির ভিতরে ও বাইরে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। তারফলে গণতন্ত্রের বিকাশ ও সমাজতন্ত্রের বাস্তবায়ন ব্যাহত হয়েছে।
মূল্যায়ন: স্বাধীন চীনের পুনর্গঠনের কর্মসূচী প্রণয়ন ও প্রয়োগের ব্যাপারে মাও বিশেষভাবে চিন্তিত ছিলেন। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরে চীনে নতুন সমাজতন্ত্রের বিকাশ ও বিস্তারের জন্য তিনি নতুন নতুন কর্মসূচীর অপরিহার্যতা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। অনাগত সমাজতন্ত্রের উপযোগী করে নতুন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার রূপরেখা বিন্যস্ত করেছিলেন। মাও-এর নয়া-গণতন্ত্রের ভাবনা এসেছে এভাবেই। মাও-এর ইতিহাস বোধ, সমাজতাত্ত্বিক জ্ঞান, দার্শনিক চেতনা, তুলনামূলক বিশ্লেষণ প্রভৃতি ছিল অতি উচ্চমানের। এরই ভিত্তিতে তিনি নয়া-গণতন্ত্রের রাজনীতিক, আর্থনীতিক ও সাংস্কৃতিক রূপরেখা রচনা করেছেন। নয়া-গণতন্ত্রের ধ্যান-ধারণা ব্যাপক ও বহুমুখী এবং সৃজনশীল প্রকৃতির। মাও-এর নয়া-গণতন্ত্র মার্কসীয় দর্শনের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য অবদান। মাও-এর রাষ্ট্রচিন্তা ও সমাজভাবনারই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল নয়া গণতন্ত্র। সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মার্কসীয় রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে নয়া-গণতন্ত্রের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে।
Leave a comment