ভূমিকা: বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে বিশ্বরাজনীতির পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পরিমার্জিত, আধুনিক উদারনীতিবাদের পরিবর্তে কিছুটা সাবেকি ধ্যানধারণাপুষ্ট নয়া উদারনীতিবাদের উদ্ভব ঘটে। প্রথমে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮ খ্রি.) এবং পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের (১৯৩৯-১৯৪৫ খ্রি.) ক্ষতিকর প্রভাব এবং সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সাবেকি, পরিমার্জিত উদারনীতিবাদ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। বেকারি, দারিদ্র এবং অর্থনৈতিক সংকট বৃদ্ধি পায়, এই অবস্থায় নতুন যুগের দাবিতে জগতে যে নতুন রাষ্ট্রচিন্তা এবং দর্শনের আবির্ভাব ঘটে, তাকে বলা হয় নয়া উদারনীতিবাদ।

নয়া উদারনীতিবাদের প্রধান বক্তা: নয়া উদারনীতিবাদের অন্যতম প্রধান প্রবক্তা হলেন ফ্রেডারিক হায়েক এবং রবার্ট নজিক। এ ছাড়াও অন্যান্য প্রবক্তা হলেন মিলটন ফ্রিডম্যান, কার্ল পপার, জে এল ট্যালমন, জন রলস্ প্রমুখ রাষ্ট্রচিন্তাবিদ।

নয়া উদারনীতিবাদ অনেকক্ষেত্রে নয়া ক্ল্যাসিকাল উদারনীতিবাদ হিসেবে বিবেচিত হয়। রাষ্ট্রতত্ত্বের আলােচনায় সনাতন উদারনীতিবাদের পুনরুত্থান হল নয়া উদারনীতিবাদ। নব প্রজন্মের উদারনীতিবাদী চিন্তাবিদরা রাষ্ট্রের কর্মপরিধিকে পুনরায় সীমিত করে এক ন্যূনতম কর্মসূচিসম্পন্ন রাষ্ট্র বা সীমিত রাষ্ট্রের ধারণাকে ফিরিয়ে নিয়ে এসে নয়া-উদারনীতিবাদের পত্তন করেন। নয়া উদারনীতিবাদ প্রতিবিপ্লবপন্থী। এই প্রতিবিপ্লবপন্থী নয়া উদারনীতিবাদের আবির্ভাব ঘটে বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকে। বস্তুত সেইসময় থেকে একশ্রেণির আধুনিক সমাজবিজ্ঞানী ও গবেষক বহুত্ববাদ, মানবকল্যাণ, গণতন্ত্র মূলক আদর্শ, সামাজিক ন্যায়নীতি প্রভৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নতুন যুগের চাহিদা ও আশা-আকাঙ্ক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের সমস্যা সম্পর্কে নয়া উদারনীতিবাদ আলােচনা করে। উদারনীতিবাদের এই সংশােধিত ও পরিমার্জিত ধারা হল নয়া উদারনীতিবাদ। এ হল প্রচলিত উদারনীতিবাদের মুক্তি বা লিবারটারিয়ানিজম’ (Libertarianism)।

নয়া উদারনীতিবাদের মূল কথা হল অর্থনৈতিক এবং রাষ্ট্রনৈতিক জীবনের ভিত্তি হওয়া উচিত ব্যক্তির পূর্ণ স্বাতন্ত্র এবং স্বাধীনতা। নয়া উদারনীতিবাদের মূল উদ্দেশ্য হল মুক্ত বাজার অর্থনীতি (Free Market Economy) এবং একটি সীমিত বা ন্যূনতম রাষ্ট্র (Minimal State) প্রতিষ্ঠা। একইসঙ্গে নয়া উদারনীতিবাদ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের অনুপ্রবেশকে নিয়ন্ত্রণের পক্ষপাতী। সাবেকি উদারনীতিবাদের মতো নয়া উদারনীতিবাদের দৃষ্টিভঙ্গি হল নেতিবাচক। নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সাবেকি উদারনীতিবাদ রাষ্ট্রের ভূমিকা ও কর্মক্ষেত্রের পরিধি বিশ্লেষণ করা হয়েছে। কিন্তু নয়া উদারনীতিবাদ মনে করে রাষ্ট্রের কর্মক্ষেত্রের পরিধি প্রসারিত হলে ব্যক্তির স্বাধীনতা ও ব্যক্তির পছন্দের অধিকারের সীমানা সংকুচিত হবে। তাই নয়া উদারনীতিবাদ মনে করে যে মুক্ত সমাজ গড়ে তুলতে হলে চাই রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণবিহীন মুক্ত বাজার (Free Market) এবং ব্যক্তির স্বাধীনতা (Individual Liberty)। এই উদ্দেশ্যপূরণের জন্য নয়া উদারনীতিবাদ সকলপ্রকার সামগ্রিকতাবাদ (totalitarianism) ও সমষ্টিবাদ (collectivism)-এর বিরােধিতা করে এবং রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি ও সমাজতন্ত্রের বিরােধিতা করে। নয়া উদারনীতিবাদীরা কখনােই রাষ্ট্রের যুপকাষ্ঠে ব্যক্তিসত্তাকে বলি দিতে চাননি। তবে তারা সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রের বিরােধীও ছিলেন না। নয়া উদারনীতিবাদীরা সমাজের ভালাে প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রয়ােজনীয়তাকে স্বীকার করেছেন। এই কারণে রাষ্ট্র অশুভ (evil) হলেও নয়া উদারনীতিবাদীদের কাছে রাষ্ট্র প্রয়ােজনীয় (necessary)। কার্ল পপার এ প্রসঙ্গে বলেছেন – “….What we need is not so much good men as good institution”। একইভাবে নয়া উদারনীতিবাদীরা সর্বোৎকৃষ্ট শাসন ব্যবস্থা না হলেও গণতন্ত্রের আবশ্যিকতাকে স্বীকার করেছেন।

নয়া উদারনীতিবাদীরা কার্যত বুর্জোয়া শ্রেণির আশা-আকাঙ্ক্ষাকে তাত্ত্বিকীকরণ করেছেন। সমাজ পরিবর্তনের বিভিন্ন পর্বে বিভিন্ন ধারায় ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে সেই তাত্ত্বিকীকরণের রূপরেখা ও উদারনীতিবাদের বিভিন্ন রূপ প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বায়ন ও মুক্ত বাজার অর্থনীতির যুগে এই মতবাদ যথেষ্ট গতিশীলতা অর্জন করেছে। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে সমাজের সকল মানুষের স্বাধীনতা ও বেঁচে থাকার রসদ নিশ্চিত করা যায় কি না তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।

নয়া উদারনীতিবাদ সম্পর্কে বিভিন্ন প্রবক্তাদের মত

[1] অধ্যাপক ফ্রেডারিক হায়েক: ফ্রেডারিক হায়েক তাঁর The Constitution of Liberty’, The Road of Serfdom গ্ৰন্তে বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন যে, মুক্ত বাজার অর্থনীতির পথে সবচেয়েবড়াে বাধাবা প্রতিবন্ধকতা হল রাষ্ট্রীয় আইন, তাই রাষ্ট্রীয় আইনের নিয়ন্ত্রণ বা সংকোচন প্রয়ােজন। এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক অরিন্দম চক্রবর্তী অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে নৈতিকতার পূর্ব শর্ত বলে উল্লেখ করেছেন। কাজেই অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া বাকি সব স্বাধীনতা অর্থহীন। অধ্যাপক ধীরেশ ভট্টাচার্যের ভাষায় বলা যায়, নয়া উদারনীতিবাদ রাষ্ট্রকে একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে (Service agency) পরিণত করতে চেয়েছে।

[2] অধ্যাপক রবার্ট নজিক: নয়া উদারনীতিবাদ এর অপর উল্লেখযােগ্য প্রবক্তা রবার্ট নজিক তার – ‘Anarchy State and Utopia’ এবং ‘Myth of the Plan’ নামক গ্রন্থে সর্বনিম্ন রাষ্ট্রের (Minimal State) তত্ত্ব উপস্থাপন করেছেন। তিনি রাষ্ট্রকে দেখেছেন নৈশপ্রহরী রাষ্ট্র (Night Watchman State) হিসেবে। এই রাষ্ট্র হল নৈতিক দিক থেকে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী রাষ্ট্র।

[3] অধ্যাপক জন রলস্: জন রলস তাঁর ‘A theory of justice and Political Liberalism’ নামক গ্রন্থে যে ধরনের উদারনীতিবাদের কথা বলেছেন তাকে সমতাবাদী উদারনীতিবাদ বলা যায়। তিনি তার ন্যায় তত্ত্বে সাংবিধানিক গণতন্ত্রের ধারণা প্রচার করেছেন।

[4] অধ্যাপক কার্ল পপার: অধ্যাপক কার্ল পপার তাঁর ‘Open Society and its Enemies’ এবং ‘The Poverty of Historicism’ নামক গ্রন্থে বলেছেন যে নির্দিষ্ট ছক অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সমাজের আমূল পরিবর্তন বা রূপান্তর ঘটিয়ে এক নিখুঁত ও সর্বাঙ্গসুন্দর সমাজ গঠনের ধারণা পরিত্যাগ করা প্রয়ােজন। এই ধারণার পরিবর্তে খণ্ডিত সামাজিক প্রযুক্তিবিদ্যা (Piecemeal social engineering) প্রয়োগ করে ভালো সামাজিক প্রতিষ্ঠান সমূহের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সংস্কারসাধনের (the piecemeal reforms of social institutions) মাধ্যমে উন্নত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব বলে কার্ল পপার তাঁর মত ব্যক্ত করেছেন।

উপসংহার: নয়া উদারনীতিবাদকে বিভিন্ন দিক থেকে সমালােচনা করা হয়েছে। সমালােচকদের মতে, নয়া উদারনীতিবাদ একমাত্র সমাজের সম্পদশালী শ্রেণির সুরক্ষার জন্যই মতামত দিয়েছে, আপামর জনগণের সম্পত্তি রক্ষার জন্য নয়। এই মতবাদে ন্যূনতম রাষ্ট্রের ধারণাকে সাধারণ মানুষের স্বার্থের বিরােধী বলে সমালােচনা করেছেন সমালােচকরা। এত সমালোচনা সত্ত্বেও বলা হয় যে, বিংশ শতাব্দীতে মিশ্র অর্থনীতির উদ্ভব, সামগ্রিকতাবাদ, ঐতিহাসিকতাবাদ, পরিকল্পিত অর্থনীতি, সমাজতান্ত্রিক বৈপ্লবিক আন্দোলন ইত্যাদির প্রভাবে বুর্জোয়া শ্রেণির আতঙ্কিত হয়ে ওঠার যথেষ্ট কারণ ছিল। এই দিক থেকে নয়া উদারনীতিবাদের মূল্যায়ন করলে এই মতবাদের সঙ্গে শ্রেণি সম্পর্কের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই পরিপ্রেক্ষিতে একই মুদ্রার বিপরীত পিঠ হিসেবে বিদ্যমান সামাজিক প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রেখে খণ্ডিত সামাজিক বিদ্যার প্রয়োগ বা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সংস্কারসাধন, ক্রমবর্ধমান পরিবর্তন ইত্যাদি হয়ে ওঠেনা উদারনীতিবাদী চিন্তাবিদদের ইতিবাচক লক্ষ্য। যাইহােক মনে রাখতে হবে যে, নয়া উদারনীতিবাদীদের মূলভাবনা কিন্তু তিনটি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে তা হল মানবতাবাদ, সমতাবাদ এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ।