নয়া-উদারনীতিবাদকে অনেক সময় নয়া ক্ল্যাসিক্যাল (neo-classical) উদারনীতিবাদ হিসাবে অভিহিত করা হয়। রাষ্ট্রতত্ত্বের আলোচনায় উদারনীতিবাদের পুনরুত্থানই হল নয়া-উদারনীতিবাদ। নয়া-উদারনীতিবাদ হল আর্থনীতিক উদারনীতিবাদের পুনরুত্থান। বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশক থেকে নয়া-উদারনীতিবাদের আবির্ভাব ঘটেছে। নয়া-উদারনীতিবাদ হল প্রতিবিপ্লবী প্রকৃতির। বিংশ শতাব্দীব্যাপী সরকারের ক্রিয়াকর্ম ও কর্তৃত্ব এবং রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের পরিধি অতিমাত্রায় প্রসারিত হয়েছে। নয়া-উদারনীতিবিদ সরকারী ক্ষেত্রের ক্রমসম্প্রসারণকে আটকাতে চায় এবং সম্ভব হলে সরকারী ক্ষেত্রের ক্রমসম্প্রসারণের এই গতিটাকে বিপরীতমুখী করতে চায়। অ্যান্ড্রু হেউড তাঁর Political Ideologies শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বলেছেন: “Neo-liberalism is counter-revolutionary: its aim is to halt, and if possible reverse the trend towards “big” government and state intervention that had characterized much of the twentieth century.”
বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে নতুন সমাজব্যবস্থা এবং প্রযুক্তি পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রের উপর নতুন ও ব্যাপক দায়-দায়িত্ব ন্যস্ত হল। উদারনীতিবাদের নতুন ব্যাখ্যা দেওয়া হল এবং জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা বলা হল। অথচ চূড়ান্ত বিচারে এই কল্যাণব্রতী রাষ্ট্র সদর্থক রাষ্ট্র হিসাবে সাফল্য অর্জনে সক্ষম হয়নি। এই ইতিবাচক উদারনীতিক রাষ্ট্রের কাছে মানুষের আশা এবং বাস্তব অবস্থার মধ্যে ব্যাপক ব্যবধানের পরিপ্রেক্ষিতে হতাশা দেখা দিল। বিংশ শতাব্দীর উদারনীতিবাদী রাষ্ট্র সংকটের সম্মুখীন হল। এই অবস্থায় পরিবর্তন ও পরিমার্জনের প্রয়োজনীয়তা প্রতিপন্ন হল। এই পরিবর্তিত উদারনীতিবাদই হল নয়া উদারনীতিবাদ। পশ্চিমের দেশগুলিতে বিংশশতাব্দীর ষাট ও সত্তরের দশক থেকে এই উদারনীতিবাদের প্রয়োগ পরিলক্ষিত হয়।
বস্তুত বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশক থেকে এক শ্রেণীর আধুনিক সমাজবিজ্ঞানী-গবেষক বহুত্ববাদ, মানবিক কল্যাণ, গণতান্ত্রিক আদর্শ, সামাজিক ন্যায়, নয়া-সামাজিক আন্দোলন প্রভৃতির দ্বারা প্রভাবিত হন। এই পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে এই শ্রেণীর চিন্তাবিদ্রা নতুনভাবে রাষ্ট্রতত্ত্বের আলোচনায় আগ্রহী ও উদ্যোগী হন। নতুন যুগের চাহিদা ও আশা-আকাঙ্ক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের সমস্যাদি সম্পর্কে নয়া উদারনীতিবাদে আলোচনা করা হয়েছে। আগেকার দিনে যুদ্ধ ও আর্থনীতিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে শক্তিধর জাতীয় রাষ্ট্রের ধারণাকে স্বীকার ও সমর্থন করা হয়েছে। পরবর্তীকালে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রতত্ত্বের ক্ষেত্রে ধারণাগত সংস্কার সাধিত হয়। আবার সীমিত রাষ্ট্রের ধারণার কথা বলা হয়। এ হল ‘সীমিত কল্যাণ রাষ্ট্র’। নয়া উদারনীতিবাদ হল রাষ্ট্রতত্ত্বে অতীতের উদারনীতিবাদের পুনরুত্থান। এ হল উদারনীতিবাদের মুক্তি বা ‘লিবারটারিয়ানিজম’ (Libertarianism)। উদারনীতিবাদের এই সংশোধিত ভাষ্যই হল নয়া উদারনীতিবাদ। এই নয়া উদারনীতিবাদের প্রবক্তা হিসাবে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলেন হায়েক (F. A. Hayak), বারলিন (Isaiah Berlin), ফ্রীডম্যান (Milton Friedman), রলস (John Rawls), নজিক (Robert Nozick) প্রমুখ।
নয়া-উদারনীতিবাদে রাষ্ট্রের ভূমিকাকে পুনরায় স্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু এ রাষ্ট্র ক্ষমতাকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান বা স্বৈরী প্রতিষ্ঠান নয়। এ রাষ্ট্রের প্রয়োজন হল ব্যক্তি স্বাধীনতার উদার পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য, ব্যক্তি স্বাধীনতার পরিধিকে অধিকতর প্রসারিত করার জন্য। নয়া উদারনীতিবাদে আর্থনীতিক ও রাজনীতিক জীবনে ব্যাপক স্বতঃস্ফূর্ততার পরিপূর্ণ স্বাধীনতা ও স্বাধীন উদ্যোগের কথা বলা হয়। নয়া-উদারনীতিবাদ ‘ন্যূনতম রাষ্ট্র’ (Minimal state) ও ‘মুক্ত বাজার সমাজ’ (Free Market Society) ব্যবস্থার নীতিতে বিশ্বাসী। নয়া-উদারনীতিবাদের মুখ্য বক্তব্য হল জনগণতন্ত্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের সাযুজ্য সম্পাদন এবং যুক্তিবাদের সঙ্গে মানবতাবাদী ধর্মের সংযোগ সাধন। নয়া-উদারনীতিবাদে সদর্থক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে স্বাধীনতাকে গ্রহণ করার কথা বলা হয়। তবে প্রগতির দাবির সঙ্গে স্বাধীনতাকে খাপ খাওয়াতে হবে। স্বাধীনতার ভাবনা সমাজের যুক্তিসঙ্গত ও বাস্তব পুনর্গঠনের সঙ্গে সম্পর্কহীন হবে না। রাষ্ট্র হবে ন্যূনতম। এই রাষ্ট্র বিদ্যমান বাজার-সমাজের অসম ও কঠোর প্রকৃতির বিধি-ব্যবস্থা ও বণ্টন ব্যবস্থা, মজুরি ও মুনাফার ব্যবস্থা, বাজার দাম, ব্যক্তির মৌলিক প্রয়োজন পূরণ প্রভৃতির দিকে নজর রাখবে এবং প্রয়োজনবোধে হস্তক্ষেপ করবে।
গ্রেট ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নয়া-উদারনীতিবাদের প্রাথমিক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। কারণ ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে এই দুটি দেশে উন্মুক্ত বাজার অর্থনীতি বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠা পায়। যুক্তরাজ্যে প্রধানমন্ত্রী থেচারের আমলে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতি রেগানের আমলে নয়া-উদারনীতিবাদের ভিত্তিতে ব্যাপকতর নতুন দক্ষিণপন্থী মতাদর্শ ভিত্তিক কার্যক্রম গৃহীত হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল অবাধ আর্থনীতিক ব্যবস্থার সঙ্গে মূলত রক্ষণশীল সামাজিক দর্শনের সাযুজ্য সম্পাদন। নয়া-উদারনীতিবাদ নতুন দক্ষিণপন্থীদের একটি হাতিয়ার বিশেষ। এই উদারনীতিবাদ ব্যাপকতর শক্তিসমূহের দ্বারা সংগঠিত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল আর্থনীতিক বিশ্বায়ন। উদারনীতিক, সমাজতান্ত্রিক এবং রক্ষণশীল রাজনীতিক দলসমূহের উপর এর প্রভাব পড়ে। অতঃপর ইংল্যাও-আমেরিকার সীমানা ছাড়িয়া দক্ষিণপন্থী নয়া-উদারনীতিবাদের প্রভাব-প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়তে থাকে। হেউড এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন : “However, in the case of both Thatcherism’ in the UK and ‘Reganism’ in the USA, neo-liberalism formed part of a larger, new right ideological project that sought to fuse laissez-faire economics with an essentially con servative social philosophy.”
অনেকের অভিমত অনুযায়ী নয়া-উদারনীতিবাদ অনেকাংশে বাজার মৌলবাদে পরিণত হয়। নীতিগতভাবে এবং কার্যগত বাজারকে সরকার এবং যে কোন ধরনের রাজনীতিক নিয়ন্ত্রণের থেকে উর্ধ্বর্তন মনে করা হয়। অ্যান্ড্রু হেউড তাঁর Political Ideologies শীর্ষক গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন: “In that sense, neo-liberalism goes beyond classical economic theory.” নয়া-উদারনীতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের ত্রুটি-বিচ্যুতি বহু ও বিভিন্ন। ফ্রেডরিক হায়েক (Friedrich Hayek) প্রমুখ উন্মুক্ত বাজার অর্থনীতিবিদরা এবং মিলটন ফ্রিডম্যান (Milton Friedman)-এর মত মার্কিন অর্থনীতিবিদ্রা সরকারের আর্থনীতিক ভূমিকার তীব্র বিরূপ সমালোচনা করেছেন।
নয়া-উদারনীতিক ধ্যান-ধারণা ও কাঠামোসমূহের বিকাশ ও বিস্তারের পিছনে আর্থনীতিক বিশ্বায়নের সদর্থক অবদান অনস্বীকার্য। বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার প্রভাবে জাতীয় অর্থনীতি পরস্পর সংবদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতির অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছে। বিশ্ব আর্থনীতিক ব্যবস্থায় উৎপাদন প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিক প্রকৃতি প্রাপ্ত হয়। বিভিন্ন দেশের মধ্যে স্বাধীন ও স্বতস্ফূর্তভাবে মূলধনের আদান-প্রদান ঘটে। নয়া-উদারনীতিবাদ ও বিশ্বায়ন হাত ধরাধরি করে এগিয়েছে। বিংশ শতাব্দীর শেষের দশকে এই প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত বিকাশ পরিলক্ষিত হয়। এই সময় বাজার ভিত্তিক অর্থনীতির পুনর্গঠন ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়। বিশেষত পূর্ব ইউরোপের উত্তর কমিউনিস্ট রাষ্ট্রসমূহে, লাতিন আমেরিকায় এবং উন্নয়নশীল বিশ্বের অধিকাংশ অঞ্চলে এই প্রক্রিয়া প্রবহমান। অধ্যাপক হেউড মন্তব্য করেছেন: “Neo-liberalism’s unreserved endorsement of market oriented global capitalism shows how far it draws from a narrow economic liberalism that ituninterested in other matters.”
নয়া-উদারনীতিবাদের প্রবক্তা হিসাবে জন রলস (John Rawls), রবার্ট নজিক (Robert Nozick) ও এফ. এ হায়েক (F. A. Hayek) প্রমুখ চিন্তাবিদদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এঁরা সকলে এ বিষয়ে একমত যে, উদারনীতিবাদের মূল নিহিত আছে স্বাধীনতা, সাম্য ও ব্যক্তির সমমর্যাদার মধ্যে। স্বভাবতই সরকারের ভূমিকা নিরীক্ষণ হওয়া দরকার। উল্লিখিত তিন নয়া-উদারনীতিবাদীর বক্তব্য সংক্ষেপে আলাদাভাবে আলোচনা করা দরকার।
জন রলস: ১৯৭২ সালে প্রকাশিত তাঁর A Theory of Justice শীর্ষক গ্রন্থে ন্যায় ও নয়া উদারনীতিবাদ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত তাঁর Political Liberalism শীর্ষক গ্রন্থটিও এপ্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রলসের এই গ্রন্থটি রাজনীতিক দর্শনের একটি বিশিষ্ট গ্রন্থ হিসাবে পরিচিত। রলস স্বাধীনতার নৈতিক স্বতঃসিদ্ধতার কথা বলেছেন। স্বাধীন ও স্বতঃস্ফূর্ত জীবন যাপনের স্বার্থে অপরিহার্য কতকগুলি মূল স্বাধীনতার উপর জন রলস জোর দিয়েছেন। এই স্বাধীনতাগুলি হল: বাক্য ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা, সংঘ-সমিতি গঠনের স্বাধীনতা, গমনাগমনের স্বাধীনতা, বৃত্তি ও জীবিকার স্বাধীনতা প্রভৃতি। তিনি সর্বাধিক সাম্যভিত্তিক স্বাধীনতার নীতির উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এ ধরনের স্বাধীনতার সংরক্ষণের জন্য সদর্থক সরকারী ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। মানুষের পছন্দের ভিত্তি হিসাবে রলস সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কথা বলেছেন। নাগরিকদের সমান সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির ব্যবস্থা এবং মৌল স্বাধীনতাসমূহের সমান সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাষ্ট্রের মধ্যে থাকা দরকার। সমাজের শক্তি নিহিত আছে সমান ও স্বাধীন নাগরিকের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সুন্দর সহযোগিতার মধ্যে। রলস ন্যায়ভিত্তিক সমাজের কথা বলেছেন। এ ধরনের সমাজে গুরুত্ব পাবে স্বাধীনতা, সুযোগ-সুবিধা, ব্যক্তি মানুষের আত্মমর্যাদা, সম্পত্তি ও রুজি-রোজগার। ন্যায়নির্ভর সমাজে এসবের সঠিক ও সম বণ্টন সুনিশ্চিত হবে। জন রলসের মতবাদের মূল কথা হল ন্যায়। সঠিক ও ন্যায্য নীতির স্বার্থে সহমত বা সমঝোতাকেই তিনি ন্যায় হিসাবে প্রতিপন্ন করেছেন। তাঁর অভিমত অনুযায়ী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত হবে। সমাজবিজ্ঞানী রিচার্ড বেল্লামি (Richard Bellamy) তাঁর Leberalism শীর্ষক এক রচনায় মন্তব্য করেছেন: “Rawl’s theory tries to combine the liberal values of liberty and equality with a concern for social justice tempered, in characteristic social-liberal fashion, by the requirements of efficiency.”
রবার্ট নজিক: রবার্ট নজিক-এর Anarchy, State and Utopia শীর্ষক গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৭৪ সালে। নজিক বাজার ব্যবস্থা ও ন্যূনতম রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সমর্থন করেছেন এবং যে কোন জনকল্যাণমূলক নীতির বিরোধিতা করেছেন। নজিক নয়া-উদারনীতিবাদের একজন বিশিষ্ট প্রবক্তা হিসাবে পরিচিত। নজিক সীমাবদ্ধ রাষ্ট্রের কথা বলেছেন। রাষ্ট্রকে তিনি নিরাপত্তামূলক ভূমিকার অধিক কোন দায়িত্ব দিতে চাননি। রাষ্ট্রে ব্যক্তির প্রয়োজনীয়তা ব্যক্তি নিজেই নির্ধারণ করবে, এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কোন রকম হস্তক্ষেপ নজিক স্বীকার বা সমর্থন করেন নি। তাঁর অভিমত অনুযায়ী রাষ্ট্র বা রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানের যথার্থতা নিহিত আছে ব্যক্তির অধিকার ও স্বাতন্ত্র্য বা ব্যক্তি-স্বাধীনতা সংরক্ষণের মধ্যেই। রাষ্ট্রের কাজ হবে ন্যায়সঙ্গতভাবে অর্জিত ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে সুরক্ষা প্রদান। ব্যক্তির সঙ্গে সমঝোতা করে চলে যে সংগঠন তাকেই তিনি বৈধতার মর্যাদা প্রদানের পক্ষপাতী। কারণ নজিকের মতানুসারে ব্যক্তি বা ব্যক্তিজীবনের বাইরে কোন রকম সামাজিক অগ্রাধিকারের অস্তিত্ব অস্বীকৃত। ব্যক্তি ব্যতিরেকে অন্য কোন সামাজিক বা রাজনীতিক সত্তার অস্তিত্বকে নজিক স্বীকার করেন নি। রিচার্ড বেল্লামি বলেছেন: “In common with other contemperary liberal thinkers…the central commitment of his (Nozick’s) theory is to a particular framework which provides scope for people to live according to diverse conceptions of the good.” বেল্লামি আরও বলেছেন: “…although his (Nozick’s) theory accords best with laissez faire capitalist society, he draws on the anarchist and utopian traditions to suggest that it could be compatible with any form of social organisation provided it was voluntarily entered into.”
এফ. এ. হায়েক: নয়া-উদারনীতিবাদের অন্যতম বিশিষ্ট প্রবক্তা হিসাবে পরিচিত। ১৯৬০ সালে প্রকাশিত The Constitution of Liberty শীর্ষক গ্রন্থে হায়েক তাঁর নয়া-উদারনীতিবাদী বক্তব্য ব্যক্ত করেছেন। হায়েক প্রতিনিধিমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে স্বীকার ও সমর্থন করেছেন। কিন্তু তাঁর অভিমত অনুযায়ী এ ধরনের রাষ্ট্র নিজেই কোন লক্ষ্য নয়, লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার উপায় মাত্র। হায়েক স্বাধীনতাকেই চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসাবে নির্দিষ্ট করেছেন। স্বভাবতই রাষ্ট্রের কাজ হল স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত করা। তিনি আইনের অনুশাসনের উপর জোর দিয়েছেন। তাঁর মতানুসারে আইনের অবসান ঘটলে স্বৈরাচারিতার সৃষ্টি হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন হলেও তিনি স্বৈরী ও পীড়নমূলক শাসনের বিরোধিতা করেছেন। এই কারণের তিনি জনগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বিপদ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। এ ধরনের গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের ক্ষমতা শেষপর্যন্ত মুষ্টিমেয় এজেন্টের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ার আশংকা থাকে। তারফলে স্বৈরী ক্ষমতার পীড়নমূলক ভূমিকা অনিবার্য হয়ে পড়ে। হায়েক জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রব্যবস্থার ধারণাকে স্বীকার বা সমর্থন করেন নি। অনুরূপ প্রকৃতির সমাজ-পরিকল্পনা বা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাকেও হায়েক সমর্থন করেন নি। তার কারণ হিসাবে তিনি বলেছেন যে, এ ধরনের পরিকল্পনা বা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিরা ও আমলারা প্রভাব-প্রতিপত্তি কায়েম করার সুযোগ পায়। হায়েকের অভিমত অনুযায়ী ব্যক্তি মানুষের ব্যক্তিগত সামর্থ্যের ক্ষেত্রে সরকারী হস্তক্ষেপ অনভিপ্রেত। এ ধরনের হস্তক্ষেপমূলক আইন পীড়নমূলক প্রকৃতির। ব্যক্তি মানুষ যাদের সঙ্গে কাজকর্ম করে তারাই বিচার করতে পারে ব্যক্তির কাজের মূল্য ও ব্যক্তির পাওনা। সামাজিক বা বণ্টনমূলক ন্যায় নির্ধারণের ক্ষেত্রে হায়েক ব্যক্তি মানুষের বাস্তব অবস্থানকে অগ্রাহ্য করাকে সমর্থন করেননি। তার অভিমত অনুযায়ী স্বৈরী বা পীড়নমূলক ক্ষমতার প্রকাশকে আটকাতে হলে গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ আবশ্যক। সাধারণ গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থা ও উপায়-পদ্ধতির মাধ্যমে রাষ্ট্র ও শাসনকে শৃঙ্খলিত করা দরকার। অর্থাৎ উদারনীতিক ব্যবস্থার স্বার্থে আইনের বাঁধনে গণ-তান্ত্রিক রাষ্ট্রকে বাঁধা দরকার। হায়েক মুক্ত বাজার ব্যবস্থার উপর জোর দিয়েছেন। তিনি এ ধরনের বাজারকে একটি সাংবিধানিক রাষ্ট্রের দ্বারা সুরক্ষিত করার পক্ষপাতী। ব্যক্তি মানুষের চাহিদা এবং প্রত্যাশা ও পাওনা মুক্ত বাজারেই নির্ধারিত হওয়া দরকার। অ্যান্ড্রু হেউড তাঁর Political Ideologies শীর্ষক গ্রন্থে হায়েকের নয়া-উদারনীতিবাদ সম্পর্কে বলেছেন: “Hayek (1944) advanced a damning economic and political critique of central planning in particular and economic intervention in general. …. In his view, economic intervention is the single most serious threat to individual liberty because any attempt to control economic life inevitably draws the state into the other areas of existence, ultimately leading to totali tarianism.”
নয়া উদারনীতিবাদের মূল্যায়ন
সাবেকি উদারনীতিবাদের মত নয়া-উদারনীতিবাদও বিরূপ সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। সমালোচকরা নয়া-উদারনীতিবাদের বিবিধ সীমাবদ্ধতার কথা বলেন। এ প্রসঙ্গে কতকগুলি যুক্তি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
এক: সমালোচকদের অভিযোগ অনুযায়ী সাবেকি উদারনীতিবাদের মতই নয়া-উদারনীতিবাদও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী ও ভোগবাদী ধ্যান-ধারণার সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত নয়।
দুই: নয়া-উদারনীতিবাদের কায়েমী স্বার্থের বিরুদ্ধে প্রগতির স্বার্থের কথা বলা হয়। অবার পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রতিকূল প্রভাব-প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে সতর্কতার কথাও বলা হয়। কিন্তু এই সমস্ত ক্ষেত্রে বিদ্যমান পরিস্থিতি-পরিমণ্ডলের পরিপ্রেক্ষিতে নয়া-উদারনীতিবাদের তাত্ত্বিক বক্তব্যের সঙ্গতি ও সত্যতা সম্পর্কে সংশয়ের সৃষ্টি হয়।
তিন: নয়া-উদারনীতিবাদে রাষ্ট্র সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা হয়েছে এবং রাষ্ট্রের কল্যাণমূলক ভূমিকার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব, পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ও বাজারের স্বার্থ এবং জনগণতন্ত্রের নিয়ম নীতি প্রভৃতির মধ্যে মিথস্ক্রিয়া প্রসঙ্গে সন্দেহ ও বিতর্কের অস্তিত্ব অনস্বীকার্য।
চার: নয়া উদারনীতিবাদী ভাষ্যে স্বাধীনতার ধারণা সাম্যের ধারণার সঙ্গে সংযুক্ত কিনা সে বিষয়ে সম্যকভাবে অবহিত হওয়া যায় না।
পাঁচ: প্রচলিত উদারনীতিবাদের মত নয়া-উদারনীতিবাদেও স্বাধীনতা সংরক্ষণের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়। কিন্তু এই স্বাধীনতার প্রকৃতি এবং স্বাধীনতার অধিকারীদের প্রকৃতি প্রসঙ্গে বাস্তবে সংশয় ও বিতর্ক দেখা দেয়।
ছয: নয়া-উদারনীতিবাদী আলোচনায় মুক্ত মানুষ, ব্যক্তি মানুষের অধিকার ও সমান ব্যক্তির কথা বলা হয়। কিন্তু বিদ্যমান অবস্থার সঙ্গে এই সমস্ত বক্তব্যের বড়ই অমিল। বাস্তবে জাতি-বর্ণ-বংশগত বিচারে অসাম্য-বৈষম্য এবং নারী-পুরুষের মধ্যে ভেদাভেদ বর্তমান এবং সম্পদ ও সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে অসাম্য বৈষম্য বর্তমান।
সাত: নয়া-উদারনীতিবাদীরা রাষ্ট্র ও পৌর সমাজ (Civil society) এর মধ্যে পার্থক্যের কথা বলেছেন। এই পার্থক্য প্রসঙ্গে বামপন্থী চিন্তাবিদরা সংশয়-সন্দেহ প্রকাশ করে থাকেন।
সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও নয়া-উদারনীতিবাদের প্রাসঙ্গিকতার বিষয়টিকে অস্বীকার করা যায় না। ব্যাপক বিতর্ক সত্ত্বেও বিশ্বায়নের বাস্তবতা বর্তমানে বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে। বিশেষত আর্থনীতিক ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের প্রক্রিয়ার বাইরে থাকা কোন দেশের পক্ষে এখন আর সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমানে বিশ্বায়নে যুগে নয়া উদারনীতিবাদী ধ্যান-ধারণার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনস্বীকার্য।
Leave a comment