নব্য ভারতীয় আর্যভাষা ভৌগােলিক অঞ্চল ভেদে যে বিশেষ বিশেষ রূপ লাভ করেছিল তাদের পরিচয় দাও।

ঐতিহাসিক এবং ভৌগােলিক দিক থেকে প্রাচীন এবং মধ্যভারতীয় আর্যভাষার মতাে নব্য ভারতীয় আর্যভাষারও বর্গীকরণ সম্ভবপর। প্রাচীন ও মধ্যযুগে ভাষা যেমন উত্তরদেশীয়া বা ‘উদীচ্যা’, দক্ষিণদেশীয়া বা ‘অবাচ্যা’, পূর্বদেশীয়া বা ‘প্রাচ্যা’, পশ্চিমদেশীয়া বা ‘প্রতীচ্যা’ এবং ‘মধ্যদেশীয়া’- মােটামুটি এই প্রধান পাঁচটি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল, নব্য ভারতীয় আর্যভাষাও তেমনি এই প্রধান পাঁচটি ধারাতেই বিন্যস্ত হয়েছে। আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তার অসাধারণ গবেষণামূলক গ্রন্থ O.D.B. L’-এ (Origin and Development of Bengali Lan guage) সিদ্ধান্তরূপে গ্রহণ করা হয়। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযােগ্য যে তৎপূর্বে হর্নলে গ্রীয়ার্সন-প্রচারিত মতবাদে ‘অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গ মণ্ডলীয় বিভাগ’ নীতি গৃহীত হয়েছিল। তারা হিন্দী ভাষাগুচ্ছ, রাজস্থানী ও গুজরাটী ভাষাগুচ্ছ এবং পাহাড়ী ভাষাগুচ্ছকে অন্তরঙ্গ মণ্ডলে স্থান দিয়ে অপর সমস্ত ভাষাগুচ্ছকে বহিরঙ্গমণ্ডলে স্থাপিত করে তাদের স্বপক্ষে বিভিন্ন যুক্তি উপস্থাপিত করেছিলেন। আচার্য সুনীতিকুমার তথ্য ও যুক্তি দ্বারা তাদের বক্তব্যকে খণ্ডন করে স্বীয় মত প্রতিষ্ঠা করেন। আচার্য-কর্তৃক নির্দেশিত এই পঞ্চবর্গের প্রতিটি প্রধান শ্রেণীতেই একাধিক আঞ্চলিক ভাষা স্থান লাভ করেছে। নিম্নে তাদের বিস্তৃত পরিচয় দেওয়া হলাে।

(ক) উত্তরদেশীয়া/উদীচ্যা : উদীচ্যা ভাষাগােষ্ঠীতে দুটি প্রধান শ্রেণী—একটিতে আছে। সিন্ধী ও পাঞ্জাবী ভাষাগুচ্ছ, অপরটিতে কুমায়ুন, গাড়ায়ালী, নেপালী প্রভৃতি পাহাড়ী ভাষাগুচ্ছ।

কচ্ছ এবং বর্তমান পাকিস্তানের অন্তর্গত সিন্ধু অঞ্চলে প্রচলিত ভাষাই সিন্ধী ভাষা। সিন্ধী ভাষায় প্রাচীনতম সাহিত্য রচিত হয় সপ্তদশ শতাব্দীতে। এ ভাষার উচ্চারণে ত-বর্গ স্থলে ট- বর্গের প্রবণতা এবং সঘােষ মহাপ্রাণ বর্ণের কণ্ঠনালীর উচ্চারণ লক্ষ্য করা যায়। সিন্ধু অঞ্চলের অধিবাসীরা প্রধানতঃ মুসলমান বলে সিন্ধী ভাষার আরবী ফারসী শব্দের প্রাধান্য বর্তমান। সিন্ধী। ভাষাও লেখা হয় আরবী অক্ষরে।

পাঞ্জাবী ভাষার দুটি প্রধান শাখা—একটি পশ্চিমা পাঞ্জাবী বা লহন্দী এবং অপরটি পূর্ব পাঞ্জাবী বা হিন্দকী। লহন্দী ফারসী লিপিতে লিখিত হয়। গ্রাম গীতির অতিরিক্ত কোন সাহিত্য এ ভাষায় রচিত হয়নি। হিন্দকী লিখিত হয় গুরুমুখী লিপিতে। যােড়শ শতকে শিখ ধর্মগুরুদের রচিত ‘আদিগ্রন্থ’ বা ‘গ্রন্থসাহেব’ এ ভাষার প্রাচীনতম সাহিত্য। পাঞ্জাবী ভাষার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্যস্বর-মধ্যবর্তী যুগ্ম ব্যঞ্জন একক ব্যঞ্জনে পরিণত হয় নি। অপর প্রায় যাবতীয় নব্য ভারতীয় আর্যভাষারই কিন্তু এই পরিণতি ঘটে থাকে। এই ধারাটির মূলেও সম্ভবতঃ ‘গান্ধার’ প্রাকৃত। তবে পূর্বী পাঞ্জাবী বা হিন্দকী ভাষার শৌরসেনী প্রাকৃতের প্রভাব বর্তমান।

হিমালয়ের মধ্য ও পশ্চিম অঞ্চলে প্রচলিত ভাষাগুলি সাধারণভাবে ‘পাহাড়ী ভাষা’ নামে পরিচিত। এর প্রধান তিনটি শাখা-পূর্বাঞ্চলীয়, মধ্যদেশীয় ও পশ্চিমাঞ্চলীয়। পূর্বী পাহাড়ী ভাষা নেপালী-গুরখালি বা খুশকুরা নামেও এটি প্রচলিত। আধুনিক কালে নেপালী ভাষায় সাহিত্য রচিত হচ্ছে। মধ্যপাহাড়ী কুমায়ুনি এবং গাড়ােয়ালি ভাষাতেও কিছু কিছু সাহিত্য রচিত হচ্ছে। চম্বলী, জেনিসারি প্রভৃতি ৩০টি ভাষা উপভাষা পশ্চিমা পাহাড়ীর অন্তর্ভুক্ত। ‘খশ্’ অপভ্রংশ থেকেই পাহাড়ী ভাষাগুলির উদ্ভব অনুমান করা হয়।

(খ) দক্ষিণী/অবাচ্য: দক্ষিণী ভাষাগােষ্ঠীতে একটিই উল্লেখযােগ্য ভাষা-মারাঠা। মারাঠা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন ১২৯১ খ্রীঃ রচিত ‘জ্ঞানেশ্বরী’ নামক গীতার টীকা। মারাঠার অন্যতম উপভাষা ‘কোঙ্কণী’ প্রায় স্বতন্ত্র ভাষার স্বীকৃতি লাভ করে। গােয়ার খ্রীষ্টান পাদ্রীরাই এই ভাষার চর্চা শুরু করেন। বর্তমানে সেখানে কোঙ্কণী ভাষার স্বাতন্ত্র ক্রমশঃ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। প্রাচীনতর ‘অবাচ্য’ বা ‘দাক্ষিণাত্য প্রাকৃত’ থেকে উদ্ভূত ‘মাহারাষ্ট্রী প্রাকৃত’ ও ‘মাহারাষ্ট্রী অপদ্রংশে’র বংশধর রূপে একমাত্র মারাঠী ভাষায়ই সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে।

(গ) পূর্বদেশীয়/প্রাচ্যা: মাগধী অপভ্রংশ থেকে উদ্ভূত বলে অনুমিত প্রাচ্যা ভাষাগােষ্ঠী দুটি প্রধান শাখায় বিভক্ত। পূর্বী-প্রাচ্যা শাখায় রয়েছে ‘বাঙলা-অসমীয়া ওড়িয়া ও বিষ্ণুপ্রিয়া/ভাষা’। নব্য ভারতীয় আর্যভাষার আদিযুগে অর্থাৎ খ্রীঃ দশম শতক থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে এই পূর্বী- প্রাচ্যার প্রধান শাখা বাঙলা ভাষায় রচিত হয়েছিল ‘চর্যাপদ’। অবশ্য তখন পর্যন্ত ওড়িয়া ভাষা এবং অসমীয়া ভাষা স্বতন্ত্র সত্তা লাভ করেনি বলেই অনুমিত হয়। দ্বাদশ শতকের তাম্র শাসনে ওড়িয়া ভাষার নিজস্ব পরিচয় পাওয়া যায়। ধ্বনি-পরিবর্তনের দিক থেকে ওড়িয়া ভাষা এই গােষ্ঠীর অপর ভাষাগুলি অপেক্ষা রক্ষণশীল। খ্রীঃ পঞ্চদশ-যােড়শ শতকের দিকে অসমীয়া ভাষার স্বাতন্ত্রের পরিচয় পাওয়া যায়। তবে অসমীয়া ভাষার গৌরব-নব্য ভারতীয় আর্যভাষাসমূহের মধ্যে এই ভাষাতেই সর্বপ্রথম নাটক ও গদ্য সাহিত্য রচিত হয়েছিল। বাঙলা ভাষায় রচিত ‘চর্যাপদ’ নব্য ভারতীয় আর্যভাষার সর্বপ্রাচীন সাহিত্য। ভারতের বিভিন্ন ভাষাগােষ্ঠীর মধ্যে বাঙলা ভাষায় রচিত সাহিত্যই সর্বাধিক উন্নত।

প্রাচ্যার পশ্চিমী শাখায় রয়েছে বিহারী ভাষাগুলি—মৈথিলী, মগহী ও ভােজপুরিয়া। মৈথিলী সাহিত্যের সৃষ্টি চতুর্দশ শতকে। মহান কবি বিদ্যাপতি মিথিলারই কবি। বিহারের প্রাচীন ও প্রধান সাহিত্য মৈথিলী ভাষাতে রচিত হলেও হিন্দীর আওতায় তার স্বাতন্ত্র বিনষ্ট হতে বসেছিল। সম্প্রতি মৈথিলী সাহিত্যে নবজাগরণের লক্ষণ দেখা দিয়েছে। মাগহী ভাষায় কোন লিখিত সাহিত্য রচিত হয়নি। কবীর সম্ভবতঃ ভােজপুরিয়া ভাষাতেই তার দোহা রচনা করেছিলেন।

(ঘ) পশ্চিমী/প্রতীচ্যাঃ প্রতীচ্যা ভাষাগােষ্ঠীর এক শাখায় রয়েছে গুজরাতি ভাষা, অপর শাখায় রাজস্থানী ভাষাগুচ্ছ। গুজরাতের প্রাচীনতম সাহিত্য রচিত হয়েছিল খ্রীঃ চতুর্দশ শতকে। ভীলী গুজরাতির একটি উপভাষা। রাজস্থানী ভাষা গােষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে জয়পুরী, মারােয়াড়ি, মেবারি, মালবী প্রভৃতি। মারােয়াড়ি ভাষায় প্রাচীন সাহিত্য বর্তমান থাকলেও এই গােষ্ঠীর কোন ভাষাতেই উল্লেখযােগ্য কোন সাহিত্য সৃষ্টি হয় নি। রাজস্থানীর একটি উপভাষা খান্দেশীতে প্রাচীন সাহিত্যের সন্ধান পাওয়া যায়। প্রাকৃত স্তরে ‘লাটী সৌরাষ্ট্রী, আবস্তী’-আদি উপভাবার পর্যায়েই সম্ভবতঃ ছিল; পরবর্তী স্তরে এটি ‘নাগর অপভ্রংশ’ রূপে বিশিষ্টতা লাভ করে। তার প্রধান বংশধর ‘রাজস্থানী’র দুটি প্রধান শাখার একটি গুজরাতি, অপরটি মারােয়াড়ি। অপরগুলি উল্লেখযােগ্য নয়।

(ঙ) মধ্যদেশীয়া: সাধারণভাবে মধ্যদেশীয়া ভাষা হিন্দীরূপেই পরিচিত হলেও এর কয়েকটি শাখার পৃথক স্বীকৃতি রয়েছে। প্রকৃত ‘হিন্দী’ বা ‘হিন্দুস্থানী’ ভাষাকে ভাষাতাত্ত্বিক দিক থেকে ‘পশ্চিমা হিন্দী’ নামে অভিহিত করাই সঙ্গত। এর দুটি প্রধান শাখার একটি খড়ীবােলি, অপরটি ব্রজভাষা (‘ব্রজবুলির’ সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই)। খড়ীবােলিই প্রকৃত হিন্দী, ফারসি অক্ষরে লিখিত এই ভাষাই ‘উর্দু’। মধ্যযুগে ব্রজভাষায় উৎকৃষ্ট সাহিত্য রচিত হলেও এখন আর এর কোন পৃথক মর্যাদা নেই। হরিয়ানী, বুন্দেলী প্রভৃতি পশ্চিমা হিন্দীর উপভাষা। ‘শৌরসেনী’ প্রাকৃত থেকে ‘শৌরসেনী অপভ্রংশ’ তথা অবহট্‌ঠের মধ্য দিয়ে এই শাখার আবির্ভাব ঘটে।

মধ্যদেশীয়া তথা হিন্দী ভাষার পূর্বাঞ্চলের রূপটিকে ‘পূর্বহিন্দী’ বা ‘কৌশলী’ নামে অভিহিত করা হয়। এই ভাষাগুচ্ছের অন্তর্ভুক্ত অওধী, বাঘেলী ও ছত্রিশগড়ী। খ্রীঃ দ্বাদশ শতক থেকেই অওধী ভাষায় সাহিত্য রচিত হয়ে আসছে। দীর্ঘকাল অওধী ভাষাই মধ্য ভারতের সাহিত্যের প্রধান বাহনরূপে পরিচিত থাকলেও পরবর্তীকালে হিন্দীর প্রভুত্বের নিকট আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে; ফলে পূর্বী হিন্দীর আর কোন স্বাতন্ত্র স্বীকৃত হয় না। পূর্বী হিন্দীর মূলে ছিল ‘অর্ধমাগধী প্রাকৃত’, তা’ থেকে ‘অর্ধ মাগধী’ অপভ্রংশের মধ্য দিয়ে এটি উদ্ভূত হয়।

(চ) নব্য ভারতীয় আর্যভাষার দুটি শাখা সিংহলী এবং জিপুসী বা রােমানী বর্তমানে শুধু ব্হি্ভারতেই প্রচলিত। শ্রীলঙ্কা বা সিংহলের ভাষা ‘সিংহলী’ মূলতঃ ‘প্রতীচ্য প্রাকৃত’ (অপর মতে ‘প্রাচ্য প্রাকৃত’) থেকে উদ্ভূত এলু নামক অবহটঠ-স্থানীয় ভাষা থেকে হয়েছে। এই ভাষায় রচিত সাহিত্যের নিদর্শন পাওয়া যায় খ্রীঃ অষ্টম শতাব্দী থেকে। পশ্চিম এশিয়ার আর্মেনিয়া থেকে আরম্ভ করে সমগ্র য়ুরােপ পরিব্যাপ্ত যাযাবর জিপসীদের ভাষা ‘জীপসী’ বা রােমানী মূলতঃ ভারতীয় আর্যবংশােদ্ভব, অবশ্যই এতে বিদেশী প্রভাব প্রচুরতর। সম্ভবতঃ প্রতীচ্য প্রাকৃত থেকেই এই ভাষাটির উদ্ভব ঘটলেও বাঙলা ভাষার সঙ্গে এর সাদৃশ্য বিস্ময়কর।

(ছ) ‘কাশ্মীরী’ ভাষা আর্যভাষাগােষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত মূলতঃ এটি ভারতীয় আর্যভাষাগােষ্ঠীর সন্তান নয়। সম্ভবতঃ ইন্দো-ঈরানী গােষ্ঠীর তৃতীয় শাখা ‘দরদীয় ভাষা’ থেকেই এর উৎপত্তি ঘটেছে। অনুমান করা হয়, উভয়ের মধ্যবর্তী স্তরে বর্তমান ছিল ‘পৈশাচী প্রাকৃত’। কাশ্মীরী ভাষার অপর উপভাষাসমূহের মধ্যে রয়েছে শীনা, চিত্রালি প্রভৃতি।