নবকুমারের নামকরণটি মধুসূদন ব্যঙ্গ্যার্থেই প্রয়োগ করেছেন। সমালোচক প্রমথনাথ বিশী বলেছেন—“নবকুমার যে-কোনো ব্যক্তির নাম নয়, ইংরাজি পড়া নূতন নবকুমার দল বা ইয়ং বেঙ্গল তাহা তৎকালীন লোকেরাও বুঝিয়াছিলেন। তবে মধুসূদনের কৃতিত্ব এই যে প্রতিনিধি স্থানীয় হলেও চরিত্রটিকে তিনি ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল করে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। একজন নিষ্ঠাবান ভক্ত বৈবের পুত্র হওয়া সত্ত্বেও বৈশ্ববীয় কোনো গুণ তার চরিত্রে লক্ষ করা যায় না, বরং যুগধর্মের প্রভাব জনিত লাম্পট্য, স্বেচ্ছাচার, মদ্যপান, বেশ্যাসক্তি তার চরিত্রের ভূষণ হয়ে উঠেছে। বেপরোয়া স্ফূর্তি ও মধ্যপানের জন্য সে সিকদার পাড়ায় পতিতাপল্লিতে ‘জ্ঞানতরঙ্গিনী সভা প্রতিষ্ঠা করেছে। এটা তার চূড়ান্ত ভণ্ডামির পরিচয়।

নবকুমার ‘জ্ঞানতরঙ্গিনী সভার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও পরিচালক। প্রধানত তারই অর্থে এই সভার ভোগ বিলাসের যাবতীয় উপকরণ সংগৃহীত হত। ফলে খুব স্বাভাবিকভাবেই সভা পরিচালনার ভার তার ওপর ন্যস্ত হত। পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েই সে একটা নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিয়েছে। বক্তৃতার সারমর্ম শুনে মনে হওয়া স্বাভাবিক, সে একজন সমাজ-সংস্কারক। আসলে সেই সময়ে বাংলাদেশে যে সংস্কার আন্দোলন চলছিল তার কিছু কিছু সংবাদ তার কানে এসে পৌঁছাত, আর সেগুলির প্রতি তার না ছিল কোনো বিশ্বাস, না ছিল কোনো আন্তরিক টান। ফলত বক্তৃতার পরেই বাঈজীদের সঙ্গে নাচ গানে মেতে উঠে মদের পেয়ালায় তুফান ছোটাত ও বেলেল্লাগিরিতে মত্ত হত।

জ্ঞানতরঙ্গিনী সভায় যে অর্থ সে জোগাত সেই অর্থ তার স্বোপার্জিত অর্থ নয়। সে অর্থ পিতৃদত্ত অর্থ। হঠাৎ বড়লোক হওয়া ধনী পিতার বখাটে ছেলের প্রতিভূ এই নবকুমার। এদের কাছে স্বাধীনতার অর্থ আকণ্ঠ মদ্যপান, নিষিদ্ধ মাংস ভক্ষণ, পতিতা নারীদের সঙ্গলাভ। দুরস্ত ভোগবিলাসে জড়িয়ে এরা ছুটে যেত বেশ্যা পল্লিতে, সারারাত সেখানে আনন্দে স্ফূর্তিতে কাটিয়ে মধ্যরাতে বাড়ি ফিরত, সায়েবী কায়দায় বোনকে চুম্বন করত, বৃদ্ধ পিতাকে ‘ওল্ড ফুল’ বলে অবজ্ঞা করত।

নবকুমার কলেজে পড়া যুবক কিন্তু ইংরেজি ভাষায় অর্ধশিক্ষিত। বাংলা ও ইংরেজি মিশিয়ে এক অদ্ভুত ধরনের ভাষা সে ব্যবহার করত। দেশীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে তার কোনো অনুরাগ ও শ্রদ্ধা ছিল না, আবার নতুন সভ্যতাকে বরণ করে নেওয়ার মতো ক্ষমতা ও যোগ্যতা তার ছিল না। নতুন ও পুরাতন সভ্যতার সন্ধিপর্বে সমাজে ও সংস্কৃতিতে যে আবিলতা এসেছিল সেই আবিলতার ফসল নবকুমার। বক্তৃতার সময়ে যদিও সে বলেছে জ্ঞানের বাতি জ্বালিয়ে মনের অন্ধকার দূর করতে সে সক্ষম হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে কোনো অন্ধকারই তার দূর হয়নি। আর তার ইংরেজি জ্ঞানের বহর যে কত তা তার জ্ঞানতরঙ্গিনী সভার’ এক সদস্য মহেশের অবজ্ঞাসূচক উদ্ভিতেই ধরা পড়েছে।

নবকুমারকে ‘সধবার একাদশী’র নিমচাঁদের সঙ্গে তুলনা চলে না। নিমচাঁদ মাতাল হলেও উচ্চশিক্ষিত, কিন্তু নবকুমার শুধুই মাতাল, অন্তঃসারশূন্য ফাঁপা মানুষ। সমাজ-সংস্কার নামক উঁচু বেদীর অন্তরালে চলে তার ভোগবিলাস, লাম্পট্য ও স্বেচ্ছাচার। আর ঘরে বসে যন্ত্রণায় ছটফট করে অভাগিনী স্ত্রী হরকামিনী। পানোন্মত্ত অবস্থায় যখন সে মধ্যরাতে ঘরে ফিরে আসে তখনও চোখে লেগে থাকে রঙিন ঘোর। নিষিদ্ধ পল্লির পয়োধরী নিতম্বিনীদের ধ্যানেই তখন সে মগ্ন। নিজের স্ত্রীকেই সে পয়োধরী বলে সম্বোধন করে। স্বামীর শোচনীয় অধঃপতন দেখে হরকামিনীর মর্মান্তিক উক্তি : “এই কলকাতায় যে আজকাল কত অভাগা স্ত্রী আমার মতোই এইরূপ যন্ত্রণা ভোগ করে তার সীমা নেই।” তার এই উক্তি নবকুমারের যথার্থ স্বরূপটিকে আমাদের সামনে তুলে ধরে।

দুশ্চরিত্র মাতাল পুত্রের ন্যক্কারজনক আচরণে ক্রুদ্ধ পিতা জন্মকালেই তার পুত্রের কেন মৃত্যু হয়নি তা নিয়ে অনুশোচনা করেছেন। তাকে বংশের কুলাঙ্গার বলে অভিহিত করেছেন, পরদিন সকলকে নিয়ে বৃন্দাবনে চলে যাবেন বলে ঘোষণা করেছেন আর মাতাল নবকুমার নেশার ঘোরে বলে উঠেছে—“হিয়র হিয়র আই সেকেন্ড ‘দি রেজোলুশান’।

এমনভাবে নবকুমারের কথায় ও কাজে অজস্র অসঙ্গতি, আর এই অসঙ্গতি ও বৈষম্য প্রহসনের প্রাণ। নাট্যকার এই চরিত্রটিকে প্রহসনের উপযোগী করে তুলতে সর্বতোভাবে চেষ্টা করেছেন। তার চরিত্রের মধ্য দিয়ে পতনশীল সমাজের একটি দিক আভাসিত হয়েছে। নবকুমার ভণ্ড ইয়ং বেঙ্গলের যোগ্য প্রতিনিধি। আবার অন্যদিকে ব্যক্তি চরিত্র হিসেবে তার স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে যায়নি। নাট্যকার শ্রেণি প্রতিনিধি ও ব্যক্তি চরিত্র উভয় দিক দিয়েই চরিত্রটিকে অঙ্কন করতে চেয়েছেন এবং তিনি যে সার্থক হয়েছেন তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।