বঙ্গীয় নাট্যশালার ইতিহাসে নবীনচন্দ্র বসুর নাট্যশালার প্রতিষ্ঠা একটি স্মরণীয় ঘটনা। নারকেলডাঙ্গার বাগানবাড়িতে স্থাপিত প্রসন্ন কুমার ঠাকুরের হিন্দু থিয়েটার দুই বৎসর পূর্বে স্থাপিত হলেও সেই নাট্যশালা এবং সেখানকার অভিনয় অনুষ্ঠানের সঙ্গে সাধারণ মানুষের কোনই যোগ ছিল না। কারণ সেখানে যে অভিনয় অনুষ্ঠান হয়েছিল, তা’ ইংরেজি ভাষায় রচিত, কেবলমাত্র ইংরেজ এবং ইংরেজি-শিক্ষিত বাঙ্গালীরাই সেই নাটকের দর্শক ছিল। আর এই কারণেই সেই থিয়েটার মাত্র এক বৎসর পরেই উঠে যায়। কিন্তু বাঙালীর উদ্যোগে স্থাপিত এবং বাংলা নাটকের অভিনয় অনুষ্ঠান হয় সর্বপ্রথম নবীনচন্দ্র বসু প্রতিষ্ঠিত নাট্যশালায়। হিন্দু কলেজের প্রাক্তন ছাত্রদের পাক্ষিক পত্রিকা ‘হিন্দু পায়োনীয়ার’-এর ২২শে অক্টোবর, ১৮৩৫ সংখ্যায় জানা যায় যে এই থিয়েটারটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৩৩ সালে এবং এখানে বছরে চার পাঁচটি অভিনয় অনুষ্ঠান হত। “বাংলা ভাষায় ইংরেজি রীতিতে হিন্দুদের দ্বারা (সম্ভবত এদেশীয় বোঝান হয়েছে) অভিনীত এটি একটি স্বদেশী থিয়েটার।”

নবীনচন্দ্র বসু তাঁর উত্তর কলকাতার (বর্তমান শ্যামবাজার ট্রাম ডিপোর কাছে) নিজ বাড়িতে এই নাট্যশালার প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৩৩ সালে প্রতিষ্ঠা হলেও ১৮৩৫ পর্যন্ত দুই বৎসর এখানে কোন্ কোন্ নাটকের অভিনয় হয়েচিল, তা জানা যায় না। এই নাট্যশালা সম্পর্কে আরও একটি উল্লেখযোগ্য চমৎকৃতির ব্যাপার এই যে, ইহাতে আর একটি ব্যাপারও দেখা যায় যাহা আমাদের ও ভারতবর্ষের উন্নতিকামী বন্ধুমাত্রেরই নিকট অতিশয় আনন্দের বিষয়—এই নাট্যশালায় বাঙ্গালী রমণীরা সর্বদাই দেখা দিয়া থাকেন, কারণ স্ত্রীলোকের অংশের অভিনয় ইহাতে হিন্দু রমণীরাই করিয়া থাকেন।” (হিন্দু পাইওনীয়ার)।

নবীনচন্দ্র বসুর নাট্যশালায় ১৮৩৫ সালের অক্টোবর মাসে (সম্ভবত ৬ অক্টোবর)ভারতচন্দ্রের জনপ্রিয় ‘বিদ্যাসুন্দর’ কাহিনীর নাটকাভিনয় হয়েছিল। হিন্দু পাইওনীয়ার পত্রিকায় এই অভিনয় অনুষ্ঠানের একটি প্রশংসাসূচক বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল। তা থেকে জানা যায়—

(১) ৬ অক্টোবর পূর্ণিমা রাত্রিতে এই অভিনয় হয়। অভিনয় চলেছিল রাত্রি ১২টা থেকে সকাল সাড়ে ছ’টা পর্যন্ত।

(২) সেক্সপীয়ারের রোমিও-জুলিয়েটের মতই কাহিনীটিকে ট্র্যাজি-কমেডি নাট্যরূপ দেওয়া হয়েছিল।

(৩) হিন্দু, মুসলমান, ইউরোপীয় এবং নানা জাতীয় প্রায় এক হাজার দর্শকের সমাগম হয়েছিল।

(৪) সেতার, সারেঙ্গী, বেহালা, পাখোয়াজ, প্রভৃতি দেশীয় বাদ্যযন্ত্র এদেশীয় হিন্দু ব্রাহ্মণেরা বাজিয়েছিলেন। এদের মধ্যে বেহালা-বাদক ব্রজনাথ গোস্বামী প্রচুর করতালি লাভ করেন। 

(৫) যবনিকা উত্তোলনের পূর্বে পরমেশ্বরের স্তোত্রপাঠ করা হয়। প্রত্যেক দৃশ্যের পূর্বে অভিনয়ের বিষয় আবৃত্তি করে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

(৬) সুন্দরের ভূমিকায় বরানগরের শ্যামাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ভাল অভিনয় করতে পারেন নি। তবে স্ত্রীচরিত্রের ভূমিকায় মহিলাদের অভিনয় খুবই চমৎকার হয়েছিল। বিদ্যার ভূমিকায় ১৬ বৎসরের রাধামণি এবং রাণী ও মালিনী এই দু’য়ের ভূমিকায় পৌঢ়া জয়দুর্গার অভিনয় প্রশংসনীয় হয়। এই প্রত্যক্ষদর্শী বিবরণদাতা আরও জানিয়েছেন যে, ঐ অভিনয়ে স্ত্রী চরিত্রের ভূমিকায় স্ত্রীলোকদের অভিনয়ের ফলে সমাজ সংস্কারের একটা নূতন ধারা সুচিত হয়েছে। বিবরণদাতা বলেছেন—

  • (১) এই অভিনয় দেখে দেশীয় দর্শকেরা তাদের স্ত্রী-কন্যাদের শিক্ষাদানে উৎসাহিত বোধ করবেন। 

  • (২) ভ্রমে পতিত স্ত্রীলোকদের সুপথে আনয়ন এবং তাদের চারিত্রিক উন্নতিসাধনের যে পথ ও উপায় নবীনচন্দ্র বসু দেখিয়েছেন সেজন্য তিনি ধন্যবাদের পাত্র তাঁর দৃষ্টান্ত অনুসরণযোগ্য 

  • (৩) এখানকার অভিনয়ে মঞ্চের কৃত্রিম দৃশ্যপট ছাড়াও নবীনচন্দ্র তাঁর গৃহ সংলগ্ন বাগান ও দীঘি ব্যবহার করেছিলেন। 

সমালোচক হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত ‘Indian Stage’ গ্রন্থে জানিয়েছেন—

  • (১) বজ্র-বিদ্যুতের দৃশ্যকে স্বাভাবিক করে তোলার জন্য নবীনচন্দ্র প্রচুর অর্থব্যয় করে ইংল্যান্ড থেকে যন্ত্রপাতি আনিয়েছিলেন। 

  • (২) বীরসিংহ ও বর্ধমানের রাজসভার দৃশ্য এবং মালিনীর কুঁড়েঘর যথাক্রমে নবীনবাবুর বৈঠখানায় এবং বাড়ির অন্য অংশে উপস্থাপিত হয়েছিল। 

  • (৩) মাটির নীচের সুরঙ্গ দেখানোর জন্য (রাজার প্রসাদ থেকে মালিনীর ঘর পর্যন্ত) সত্য সত্যই মাটি খুঁড়ে সুরঙ্গ কাটা হয়েছিল।

প্রকৃতপক্ষে পূর্ববর্তী প্রসন্নকুমার ঠাকুরের ‘হিন্দু থিয়েটার’ অপেক্ষা নবীনচন্দ্র বসুর এই ‘নাট্যশালা’ এদেশীয় নাট্যশালা, মঞ্চসজ্জা, দৃশ্যপট বাদ্য ও বাদন (ভারতীয় ও পাশ্চাত্য উভয়ের মিশ্রণ) এবং সর্বশেষে অভিনয়, এই সকল দিক থেকেই যথেষ্ট অগ্রগতি দান করেছিল, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।