হিন্দু থিয়েটার বা প্রসন্নকুমার ঠাকুরের থিয়েটারের পরেই বাঙালির প্রচেষ্টায় কলকাতায় শ্যামবাজারে প্রতিষ্ঠিত হয় আরও একটি নাট্যশালা। উত্তর কলকাতার বাসিন্দা নবীনচন্দ্র বসুর উৎসাহ ও আগ্রহে ১৮৩৩ খ্রিঃ এটি প্রতিষ্ঠিত হয় তাঁর নিজ বাড়িতে। শ্যামবাজার ট্রামডিপোর কাছে বাড়ির সংলগ্ন ছিল সুরম্য উদ্যান, দীঘি ও ঠাকুরবাড়ি। এখানে বাংলায় নাটক অভিনয়ের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় এবং ১৮৩৫-এর অক্টোবর মাসে ভারতচন্দ্রের ‘বিদ্যাসুন্দর’-এর কাহিনি নিয়ে এখানে যে অভিনয় হয় তার বিবরণ সংবাদপত্রে পাওয়া যায়। এখানে পরপর চার পাঁচটি নাটকের অভিনয় হয়। বাংলা ভাষায় ইংরেজি রীতিতে হিন্দুদের অভিনীত এটি একটি স্বদেশি থিয়েটার। আর সবথেকে বড়ো কথা হল এখানে হিন্দু স্ত্রীলোকেরা স্ত্রী-ভূমিকায় অভিনয় করতেন। ৬ অক্টোবরের পূর্ণিমা রাত্রিতে এই অভিনয় দেখে একজন প্রত্যক্ষদর্শী বিবরণ দিয়েছেন—’এক হাজারের ওপর হিন্দু-মুসলমান কিছু ইউরোপীয় ও আরও নানাজাতীয় দর্শক এখানে ভিড় করেছিল। রাত্রি ১২ টায় শুরু হয়ে অভিনয় সকাল সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত চলেছিল।

মূলত ভারতচন্দ্রের বিখ্যাত বিদ্যাসুন্দর কাব্যের বিষয়টি ‘ট্র্যাজিকমিডি’ রূপেই উপস্থাপিত হয়েছে। শেকসপিয়রের ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েটের’ অভিনয়ের সঙ্গে এর তুলনা করা যায়। সেতার, সারেঙ্গী, পাখোয়াজ প্রভৃতি দেশীয় যন্ত্র—যা হিন্দু ব্রাহ্মণেরা বাজিয়েছিলেন তা অত্যন্ত শ্রুতিমধুর হয়েছিল। বেহালা বাদক ব্রজেন্দ্রনাথ গোস্বামী প্রচুর করতালি লাভ করেন। যবনিকা উত্তোলনের পর প্রত্যেক দৃশ্যের পূর্বে অভিনয়ের বিষয় আবৃত্তি করে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এখানে পুরুষ চরিত্র অপেক্ষা স্ত্রীচরিত্রের অভিনয়, সবচেয়ে বেশি সার্থক হয়। বিদ্যার ভূমিকায় ষোলো বছরের রাধামণি আর রানি ও মালিনী দুয়েরই ভূমিকায় প্রৌঢ়া জয়দুর্গার অভিনয় খুব প্রশংসনীয় হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে – এই অভিনয় দেশে স্ত্রী শিক্ষার প্রসারে বিশেষ সহায়তা করবে। এখানকার অভিনয়ের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল—কৃত্রিম দৃশ্যপট ছাড়াও নবীন বসুর গৃহসংলগ্ন পুষ্করিণী ও উদ্যানের বৃক্ষাদিও নানাদৃশ্যে ব্যবহৃত হয়েছিল।

হেমেন্দ্র কুমার দাশগুপ্ত জানিয়েছেন—বজ্র বিদ্যুতের বিষয় দর্শনীয় করে তোলার জন্যে নবীন বসু প্রচুর অর্থব্যয়ে ইংল্যান্ড থেকে কৃত্রিম যন্ত্র আনিয়েছিলেন। বীর সিংহ ও বর্ধমান রাজার রাজসভা নবীনবাবুর বৈঠকখানায়, মালিনীর কুঁড়েঘর তাঁর বাড়ির আর এক অংশে দেখানো হয়েছিল। দেশে তখন ‘বিদ্যাসুন্দর যাত্রা’ খুব প্রচলিত ছিল। তার জনপ্রিয়তার কথা মনে রেখে বিদ্যাসুন্দর কাব্যকে সংস্কার করে নবীন বসু অভিনয়ের উপযোগী করে নিয়েছিলেন। দেশে তখন নাটক নেই, সুতরাং এই শৃঙ্গার রসাত্মক কাহিনিটির অভিনয় বেশি জনসমাদৃত হবে তাতে বিশেষ আশ্চর্যের কিছু নেই। প্রসঙ্গক্রমে এই থিয়েটারের কৃতিত্বগুলি সূত্রাকারে এমনভাবে সাজানো যেতে পারে।

কৃতিত্ব :

১। বিদেশি থিয়েটারের মঞ্চ।

২। মঞ্চে নাটক উপস্থাপনা।

৩। বাংলা নাটকের থিয়েটারি অভিনয়।

৪। নাট্য বিষয়ে যাত্রার অনুসরণ ও উপস্থাপনায় যাত্রার কিছু অনুষঙ্গ ব্যবহার। 

৫। বাঙালির মঞ্চে প্রথম অভিনেত্রী গ্রহণ। 

৬। বাঙালির উদ্যোগে প্রথম বাংলা নাটক অভিনয়ের কৃতিত্ব নবুন বসুর।

৭। বিদ্যাসুন্দরের প্রযোজনা যাত্রা নয়, থিয়েটারও নয়। এ এক অভিনব রীতি। 

৮। যাত্রার আসর বর্জন করে বিদ্যাসুন্দরের পালা নাটকাকারে পরিবেশন করেন ইত্যাদি।