সূচনা: টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে যে ছােট্ট দেশটি অবস্থিত ছিল প্রাচীন গ্রিকরা তার নাম দিয়েছিল মেসােপটেমিয়া। উত্তরদিকে ছিল আসিরিয়া এবং দক্ষিণদিকে ছিল ব্যাবিলনিয়া। এই ব্যাবিলনিয়ার উত্তর অংশের নাম ছিল আক্কাদ আর দক্ষিণ অংশের নাম ছিল সুমের। এই সুমেরকে কেন্দ্র করে প্রাচীন কালে যে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল তার নাম ছিল সুমেরীয় সভ্যতা।
[1] নগরজীবন
-
নগর পরিকল্পনা: সুমেরীয় সভ্যতায় একাধিক নগর ও জনপদ গড়ে উঠেছিল। খননকাজের দ্বারা প্রাপ্ত এই অঞ্চলের বাড়ি, মন্দির এবং রাস্তাঘাটগুলির ধ্বংসাবশেষ-এ সুষ্ঠু পরিকল্পনার ছাপ মেলে।
-
শাসন পরিচালনা: সুমেরীয় নগরগুলিতে রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রচলন ছিল। অনেক ক্ষেত্রে পুরোহিত শ্রেণি সুমেরীয় নগরগুলির শাসন পরিচালনা করত। প্রশাসন পরিচালনায় সাহায্যের লক্ষ্যে অভিজাতদের নিয়ে গঠন করা হয়েছিল এক কাউন্সিল।
[2] সমাজ কাঠামাে: প্রাচীন সুমেরীয় সমাজ কাঠামাে তিনভাগে বিভক্ত ছিল।
-
উচ্চ শ্রেণি: সমাজের উচ্চ শ্রেণিভুক্ত ছিল পুরােহিত, অভিজাত, বণিক, শিল্পপতি এবং উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীগণ। সমাজে অন্যান্যদের তুলনায় পুরোহিতরা বিপুল ধনসম্পদের অধিকারী ছিল।
-
নিম্ন শ্রেণি: দাস ও সাধারণ শ্রমিকরা ছিল এই শ্রেণিভুক্ত। প্রাচীন সুমেরীয় সমাজে যুদ্ধবন্দিরাই দাস হিসেবে বিবেচিত হত।
[3] অর্থনৈতিক কাঠামাে: সুমেরের অর্থনৈতিক কাঠামাে নির্ভরশীল ছিল কৃষি, পশুপালন, ব্যাবসাবাণিজ্যের ওপর।
-
কৃষি: সুমেরবাসীর প্রধান জীবিকা ছিল কৃষিকাজ। ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস নদীর মধ্যবর্তী উর্বর অঞ্চলে প্রচুর কৃষিজ ফসল ফলত তাদের প্রধান কয়েকটি কৃষিজাত ফসল ছিল গম, যব প্রভৃতি। সুমেরে বিভিন্ন শাকসবজি আর খেজুরও যথেষ্ট পরিমাণে উৎপাদিত হত। সুমেরবাসীর কাছে খেজুর ছিল মূল্যবান ফসল। খেজুর গাছ থেকে সুমেরবাসীর বিভিন্ন চাহিদা মিটত বলে তারা খেজুর গাছকে জীবনবৃক্ষ বলত।
-
পশুপালন: সুমেরবাসীর অপর একটি জীবিকা ছিল পশুপালন। ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলের পশু খাদ্যের অভাব মিটিয়েছিল। সুমেরবাসীর প্রধান কয়েকটি গৃহপালিত পশু ছিল গােরু, ছাগল, ভেড়া। এই গৃহপালিত পশুগুলি থেকে তারা দুধ, মাংস, চামড়া ও পশম পেত।
-
ব্যাবসাবাণিজ্য: সুমেরীয় বণিকগণ বিক্রেতা নিয়ােগের মাধ্যমে দূরবর্তী অঞ্চলগুলির সঙ্গে বাণিজ্য চালাত। প্যালেস্টাইন, ফিনিশিয়া, ক্লিট ও ইজিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, এশিয়া মাইনর, প্রাচীন ভারত এবং প্রাচীন মিশরের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে সুমেরীয়দের বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
[4] সাহিত্য
-
গিলগামেশ মহাকাব্য: খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দ নাগাদ সুমেরে গিলগামেশ নামে মহাকাব্যটি রচিত হয়েছিল। এটি ছিল বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন সাহিত্য। এতে রাজা গিলগামেশের বীরত্ব, সাফল্য ও ব্যর্থতার কাহিনি রয়েছে।
-
পুরাণ: সুমেরীয় সাহিত্যের মধ্যে পুরাপগুলি ছিল অন্যতম। এগুলির মধ্যে রয়েছে রাখাল বালক এতানার কাহিনি, জেলে আদ-এর কাহিনি, তামমুজ-এর কাহিনি ইত্যাদি।
[5] লিপি: পণ্ডিতদের অনুমান সুমেরীয়রাই সর্বপ্রথম লিখন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিল। তাদের লিপি ছিল দুরকম। একটি ছিল চিত্রলিপি এবং অপরটি কিউনিফর্ম লিপি।
[6] বিজ্ঞান: ধর্মীয় উৎসবগুলির সময়কাল বের করতে গিয়ে সুমেরীয়রা জ্যোতির্বিজ্ঞানের উদ্ভাবন ঘটায়। তারা জলঘড়ি ও চন্দ্রপঞ্জিকা আবিষ্কার করে। তারা বছরকে মাসে ভাগ করতে শেখে।
[7] অইিন: প্রাচীন সুমেরের অপরাধ, সম্পত্তি, বাণিজ্য, ঋণ, চুক্তি প্রভৃতি বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আইন রচিত হয়েছিল।পরবর্তীকালে সুমেরের এই আইন অনুসৃত হয়েছিল আসিরীয়, ব্যাবিলনীয় প্রভৃতি সভ্যতায়।
[8] শিল্পকলা: সুমেরীয়রা মৃৎশিল্প, ধাতু বা অলংকার শিল্প, বস্ত্রশিল্পে পারদর্শিতা দেখিয়েছিল। এ ছাড়াও তারা রােদে শােকানাে ইট দিয়ে স্থাপত্যকীর্তি নির্মাণে পারদর্শিতা দেখিয়েছিল। ধাতব দ্রব্য, খােদাই করা মূর্তি প্রভৃতি ভাস্কর্যে সুমেরীয় শিল্পকলা প্রতিফলিত হয়েছিল।
Leave a comment