সূচনা: নীলনদ এর তীরে গড়ে উঠেছিল সুপ্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা। মূলত মরুভূমিগ্রধান পরিবেশে উন্নত সভ্যতার বিকাশ সম্ভব হয়েছিল নীলনদের কারণেই। সভ্যতাটি নানা দিক থেকেই বিশ্বের প্রাচীন ইতিহাসে নিজস্বতার পরিচয় দিয়েছে।
[1] নীলনদের অপরিহার্যতা: নীলনদ ছিল প্রাচীন মিশরবাসীর জীবনে আশীর্বাদস্বরূপ। নীলনদের কারণেই মরুভূমি প্রধান পরিবেশ হওয়া সত্ত্বেও মিশরের বদ্বীপ অঞ্চল শস্যশ্যামলা হয়ে ওঠে।
[2] সমাজব্যবস্থা
-
নারীর অবস্থান: প্রাচীন মিশরের সমাজে নারীরা উচ্চ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত ছিল। সমাজের প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রেই তারা পুরুষদের সমপর্যায়ভুক্ত ছিল। মাতৃতান্ত্রিক নিয়মে ছেলে ও মেয়েরা মায়ের কাছ থেকেই মূলত উত্তরাধিকারসূত্রে সম্পত্তি লাভ করত। রাজপরিবারের রক্ত যাতে বাইরে না যায় তার জন্য ভ্রাতা-ভগ্নীর মধ্যে বিবাহের রীতি চালু ছিল।
[3] অর্থনীতি: কৃষি, পশুপালন ও শিল্প-বাণিজ্যের ওপর মিশরের অর্থনীতি নির্ভরশীল ছিল।
-
কৃষি: আদিম মিশরীয়রা ছিল মূলত কৃষিজীবী। নীলনদের উভয় তীরের উর্বর ভূমিতে কৃষিকাজ হত। এসময় গম, যব, তিসি, ভুট্টা, শাক-সবজি ও শণ প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হত।
-
পশুপালন: মিশরীয়দের অপর জীবিকা ছিল পশুপালন। তাদের প্রধান প্রধান গৃহপালিত পশু ছিল ছাগল, ভেড়া, গােরু, শূকর প্রভৃতি। নীলনদের উভয় তীরের তৃণভূমি অঞ্চলে পশুচারণ ও পশুখাদ্যের সুবিধে মিলেছিল।
-
শিল্প বাণিজ্য: প্রাচীন মিশরে মৃৎশিল্প, কোচ শিল্প, বস্ত্রবয়ন শিল্প এবং নৌযান তৈরির শিল্পের বিকাশ ঘটেছিল। ইজিয়ান দ্বীপ, ক্রীট ছাড়াও সিরিয়া, ফিনিসিয়া, ফিলিস্তিন প্রভৃতি দেশের সঙ্গে মিশরবাসী বাণিজ্য চালাত। বাণিজ্যের বিনিময় মাধ্যম হিসেবে তারা তামা ও সােনার মুদ্রা ব্যবহার করত। তাদের রপ্তানি দ্রব্যের মধ্যে প্রধান ছিল গম, লিনেন কাপড়, স্বর্ণালংকার, সুন্দর সুন্দর মৃৎপত্রি প্রভৃতি। আমদানি দ্রব্যের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল উটপাখির পালক, হাতির দাঁত, ধাতুর অস্র, মশলা, কাঠ, সােনা, রুপা প্রভৃতি।
[4] সংস্কৃতি
-
মৃতের বই: প্রাচীন মিশরীয়দের উল্লেখযােগ্য সাহিত্যগ্রন্থ ছিল ‘মৃতের বই (Book of the Dead )। সমাহিত মৃতদেহের পাশে প্যাপিরাস-এ লেখা এই ধরনের সাহিত্য নিদর্শন মিলেছে। এই পুস্তকগুলিতে জাদু বিদ্যা, ধর্মীয় শ্লোক ও প্রার্থনা, ঔষধপত্র প্রভৃতির আলােচনা থাকত।
-
বর্ষপঞ্জি: প্রাচীন মিশরবাসী কৃষির প্রয়ােজনে চন্দ্রের অবস্থানের ভিত্তিতে চন্দ্ৰপঞ্জিকার উদ্ভাবন ঘটায়। এই বর্ষপঞ্জিতে ছিল ১২টি মাস, প্রতিটি মাস ছিল সাড়ে ২৯ দিনে। এই হিসেবে তারা ৩৫৪ দিনে এক বছর ধরত আর বাকি ১৩ দিনকে তারা বিভিন্ন মাসের সঙ্গে প্রয়ােজনমতাে যােগ করে নিত। পরবর্তীকালে তারা সৌরপঞ্জিকার আবিষ্কার ঘটায়।
পাথর: প্রাচীন মিশরের আদি ঐতিহাসিক নথিটি হল রােজেটা পাথর পার্লেমাে পাথর। এগুলিতে মিশরের অনেক অজানা ইতিহাস ও রাজাদের রাজত্বকালের বিবরণ লিপিবদ্ধ রয়েছে।
হায়ারােগ্লিফিক লিপি: হায়ারােগ্লিফিক শব্দের সাধারণ অর্থ হল দেবভাষা বা পবিত্র ভাষা। এগুলি ছিল মূলত চিত্রলিপি। মিশরবাসী সর্বমােট ৭৫০টি এই ধরনের চিত্রলিপির ব্যবহার জানত।
-
পিরামিড: প্রাচীন মিশরের অন্যতম স্থাপত্যকীর্তি হল পিরামিড। ফ্যারাও জোসের আমলে স্থাপত্যশিল্পী। ইমহােটেপ সর্বপ্রথম জোসের সমাধিস্থলের ওপর মিশরের পিরামিডটি তৈরি করেন। মিশরের সর্ববৃহৎ পিরামিডটি হল খুফুর পিরামিড। অন্যান্য কয়েকটি বিখ্যাত পিরামিড হল নেফরা পিরামিড, মেনকুরা পিরামিড, তুতেনখামেনের পিরামিড ইত্যাদি।
-
অন্যান্য স্থাপত্যকীর্তি: প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় পরের দিকে পিরামিডের বদলে বহু ধর্ম মন্দির তৈরি হয়। এগুলির মধ্যে বিখ্যাত ছিল কার্নাক ও লাকজোরের মন্দির। মিশরের অপর উল্লেখযােগ্য শিল্প-নিদর্শন হল আবুসিম্বেল এর মন্দির এবং বিশালাকার ‘স্কিংস-এর মূর্তি।
[5] বিজ্ঞান: প্রাচীন মিশরে গণিতশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা, চিকিৎসা-বিদ্যা প্রভৃতি বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অগ্রগতি ঘটেছিল। চিকিৎসা-বিজ্ঞানে মিশরীয়দের গুরুত্বপূর্ণ অবদান হল ‘মেটেরিয়া মেডিকা (Materia Medica) বা ওষুধের সূচি প্রস্তুতকরণ। মমি তৈরির অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে তারা শারীরবিদ্যার জ্ঞান লাভ করেছিল।
Leave a comment