আন্তর্জাতিক শিক্ষা কমিশনের মতে, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির অগ্রগতি কতখানি মানব সমাজের পক্ষে কল্যাণকর হবে তা নির্ভর করে কত বেশি মানুষ এর দ্বারা উপকৃত হবে তার উপর। শিক্ষার উদ্দেশ্য নিরূপণ করতে হলে আগে তার রূপায়ণের সমস্যাগুলির দিকে নজর দিতে হবে।

(১) বিশ্বায়ন: বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় পৃথিবী যেমন গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হয়েছে, তেমনই ভােগবাদে বিশ্বাসী হয়ে পড়েছে সমাজ। অবাধ প্রতিযোগিতা, পুঁজি ও পণ্যের অবাধ চলাচল, উদার অর্থনীতি প্রভৃতির প্রভাবে জীবনবােধ বদলে গেছে। বেড়ে গিয়েছে বৈষম্য। দুটি শ্রেণি তৈরি হয়েছে—বিত্তবান (haves) এবং বিত্তহীন (have nots)। আমাদের আধুনিক জীবনযাত্রা পরিবেশের উপর চাপ সৃষ্টি করছে। ভারতের মতাে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা, সামাজিক স্তর বিন্যাস, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রায় সর্বস্তরেই বিশ্বায়নের প্রভাব স্পষ্ট। শিক্ষাই পারে বিশ্বায়নের কুপ্রভাবকে মুছে ফেলে এর সার্বিকতাকে জনজীবনে গ্রহণযােগ্য করে তুলতে।

(২) শ্রেণিবিভাজন : শিক্ষা সংকট আর-একটি দিক শ্রেণিবিভাজন। আমাদের দেশে শ্রেণিবিভাজন সমাজদেহকে পঙ্গু করে দিয়েছে। নানা সামাজিক কারণে দীর্ঘকাল অবহেলিত থাকার ফলে সমাজের একটা অংশে প্রকট হয়েছে নিরক্ষরতা, ধর্মভীরুতা এবং কুসংস্কার।

(৩) লিঙ্গ বিভাগ : লিঙ্গ বৈষম্যের ব্যাপারে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির পরিস্থিতি অতি খারাপ, যার একটা প্রকাশ দেখা যায় নারীদের অস্বাভাবিক রুগণতা ও মৃত্যুহার। যেসব দেশে স্বাস্থ্য পরিসেবা ও পুষ্টির ক্ষেত্রে নারীরা এ ধরনের বৈষম্যমূলক ব্যবস্থায় ভােগেন না, সেগুলির সঙ্গে তুলনা করলে দক্ষিণ এশিয়ার সাধারণ নারীদের জীবনযাত্রার দুরবস্থা সহজেই পরিষ্কারভাবে দেখা যায়।

(৪) সুস্থ পরিবেশ : বিশ্ব পরিবেশে শিল্প, প্রযুক্তি, আধুনিক ভোগবাদী জীবনযাত্রা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে এসেছে দূষণ, জনসংখ্যা বিস্ফোরণ, বেকারত্ব, ভােগবাদী চিন্তাধারা যা পরিবেশের সংকটকে বাড়িয়ে তুলেছে। নির্বিচারে বৃক্ষচ্ছেদন, লাগামছাড়া শিল্পায়ন, রাসায়নিক দূষণ প্রভৃতি সুস্থ পরিবেশের অন্তরায়।

(৫) সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণ : বর্তমান যুগ বিশ্ব সংস্কৃতির যুগ। আধুনিকতার প্রভাবে বিভিন্ন সংস্কৃতির সংমিশ্রণ মানুষের মনের উপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব বিস্তার করছে। আপন সংস্কৃতি এবং বিশ্ব সংস্কৃতি এই দুইয়ের দ্বন্দ্বে সংকটময় হয়ে পড়ছে মানুষের মন। ফলে শিক্ষার অন্যতম বাধা এই সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণের কুপ্রভাব।

(৬) বিশ্ব অস্থিরতা : বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি মাথাচাড়া দিচ্ছে, বিশ্বশান্তি নষ্ট করছে, বেকারত্ব, দারিদ্র্য, শ্রেণিবৈষম্য প্রভৃতির মাধ্যমে বিভেদকামী শক্তিগুলি প্রতিনিয়িত চেষ্টা চালাচ্ছে অশান্তি সৃষ্টির। প্রতি মুহূর্তে যেন যুদ্ধের বাতাবরণ, যা শুরু করেছে স্নায়ুযুদ্ধ (Cold War)। যুদ্ধের মুখ থেকে ভাবীকালকে বাঁচাতে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের অধীন দেশগুলির মধ্যে সহযােগিতা বৃদ্ধি করা দরকার। শিক্ষার এই চরম বাধাকে অতিক্রম করতে মানবিক শিক্ষা ও বিজ্ঞানের বিকাশ দরকার। 

সুতরাং শিক্ষার সংকট ও দ্বন্দ্ব গুলো মিটিয়ে শিক্ষার উদ্দেশ্য রূপায়ণের উপর আলােকপাত করে সকলের নজরে এনে তা নিরসনের চেষ্টা করতে হবে।