অথবা,নব্য প্রস্তর যুগের বৈশিষ্ট্যাবলি সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ দাও।
ভূমিকাঃ নতুন প্রস্তর যুগ বা নব্য প্রস্তর যুগ হচ্ছে নবােপলীয় বিপ্লবের যুগ। এ যুগে মানুষ এমন কিছু পদ্ধতি ও প্রথা সমাজে চালু করে যা পূর্বে কখনাে ছিল না। এ সকল পদ্ধতি ও প্রথার কারণে সমাজে আমূল পরিবর্তন চলে আসে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, এ যুগে মানুষ খাদ্য সংগ্রহ অর্থনীতি থেকে খাদ্য উৎপাদন অর্থনীতিতে প্রবেশ করে। ফলে তারা খাদ্য সংগ্রাহক থেকে খাদ্য উৎপাদকে পরিণত হয়। পরিবার প্রথা, স্থায়ী কৃষিকাজ, আগুনের আবিষ্কার, ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারণা লাভ ইত্যাদি নব্য প্রস্তর যুগের উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য।
নব্য প্রস্তর যুগের উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্যঃ সাধারণভাবে আমরা জানি যে, মানব সমাজ বিবর্তনের প্রথম ধাপ হলাে প্রস্তর যুগ। প্রস্তর যুগের তিনটি পর্যায়; যথা- ১। প্রাচীন প্রস্তর যুগ, ২। মধ্য প্রস্তর যুগ ৩। নব্য প্রস্তর যুগ। অর্থাৎ প্রস্তর যুগের পর্যায় হচ্ছে নব্য প্রস্তর যুগ। এ পর্যায়ে মানুষ পূর্ববর্তী পর্যায় থেকে তুলনামূলকভাবে অনেক উন্নত ধরনের জীবনযাপন শুরু করে। মানুষ খাদ্য সংহের জন্য যে কষ্ট করতাে তা অনেকাংশে লাঘব হয়। নিম্নে নব্য প্রস্তর যুগের বৈশিষ্ট্যাবলি আলােচনা করা হলাে-
(১) আগুনের আবিষ্কারঃ পাথরের সাথে পাথরের ঘর্ষণে আগুন উৎপন্ন হয়। এ প্রক্রিয়া মানুষ নব্য প্রস্তর যুগে আবিষ্কার করতে শেখে। আগুনের আবিষ্কার মানব সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ আবিষ্কার। আগুন আবিষ্কারের ফলে মানুষ ধাতু গলাতে সক্ষম হয়। ফলে হাতিয়ার ও বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করা সহজতর হয়।
(২) ধর্মীয় বিশ্বাসঃ নব্য প্রস্তর যুগে মানুষ আত্মা ও প্রেতাত্মা সম্পর্কে একটা ধারণা লাভ করেছিল। ফলে তারা পূর্বপুরুষ ও মৃত ব্যক্তির পূজা করতাে। তারা বিশ্বাস করতাে যে আত্মা ও প্রেতাত্মার উপকার ও ক্ষতি করার সামর্থ্য আছে। ফলে তাদেরকে সন্তুষ্ট করার জন্য তারা বিভিন্ন ধরনের পূজা করতাে।
(৩) কৃষিকাজঃ কৃষিকাজের মাধ্যমে শস্য উৎপাদন নব্য প্রস্তর যুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। নব্য প্রস্তর যুগের পূর্বে মানুষ বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতাে ও ফলমূল আহরণ করতাে। কিন্তু কৃষিকাজ শুরু হওয়ায় তারা উৎপাদন অর্থনীতিতে প্রবেশ করে। পর্যায়ক্রমে কৃষিকাজের মাধ্যমে উদ্বৃত্ত ফসল উৎপাদন সম্ভবপর হয়। ফলে কিছু মানুষ অন্যান্য পেশায় প্রবেশ করার সুযােগ পায়। ফলে শ্রমবিভাজন দেখা দেয়।
(৪)পরিবার প্রথাঃ নব্য প্রস্তর যুগে মানব সমাজে পরিবার প্রথা গড়ে ওঠে। মূলত কৃষিকাজের সুবিধার জন্য একটি নির্দিষ্ট স্থানে স্থায়ীভাবে বসবাস করার প্রয়ােজন হয়। একটি স্থানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে গিয়েই তাদের মধ্যে পরিবার প্রথা গড়ে ওঠে। ফলে মানুষ বাবা-মা, ভাই-বােন, সন্তান-সন্তুতি ইত্যাদি বিভিন্ন পরিচয়ে পরিচিত হয়।
(৫) কর্মবৈচিত্র্যঃ নব্য প্রস্তর যুগে সমাজে কৃষক, কামার, কুমার, তাঁতী, জেলে ইত্যাদি বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ গড়ে ওঠে। তারা প্রত্যেকে বিভিন্ন ধরনের পণ্য উৎপাদন করতাে। ফলে সমাজে শ্রমবিভাজন দেখা দেয়। শ্রমবিভাজনের ফলে সমাজে আসে কর্মবৈচিত্র্য।
(৬) স্বনির্ভর অর্থনীতিঃ নব্য প্রস্তর যুগে মানুষ তাদের প্রয়ােজনীয় সকল জিনিস নিজেরাই উৎপাদন করতাে। ফলে এক ধরনের স্বনির্ভর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। মানুষ তাদের উৎপাদিত পণ্যে নিজেদের চাহিদা মেটানাের পরেও তা দ্বারা অন্যের চাহিদা মেটাতাে। ফলে অন্য সমাজর ওপর নির্ভরতা কমে আসে।
(৭) দ্রব্য বিনিময় প্রথাঃ নব্য প্রস্তর যুগে একেক ব্যক্তি একেক পণ্য দ্রব্য উৎপাদন করতাে। ফলে দ্রব্য বিনিময়ের মাধ্যমে তারা তাদের প্রয়ােজনীয় সকল পণ্য সংগ্রহ করতাে। ফলে একটি এলাকার অর্থনৈতিক পরিমণ্ডল স্বনির্ভর হলেও মানুষ ব্যক্তিগতভাবে স্বনির্ভর ছিল না। তাদেরকে বিভিন্ন প্রয়ােজনে অন্যের ওপর নির্ভর করতে হতাে।
(৮) বাজার ব্যবস্থাঃ একটি নির্দিষ্ট স্থানে দ্রব্য বিনিময় প্রথা চলতে থাকলে বাজার সৃষ্টি হয়। সাধারণত নদী তীরবর্তী অঞ্চলগুলােতে বাজার প্রতিষ্ঠিত হতাে। আবার অনেকসময় একটি বাজারকে কেন্দ্র করেই বিশাল জনবসতি গড়ে ওঠতাে। বাজারই ছিল একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের অর্থনৈতিক কার্যকলাপের মূলকেন্দ্র।
(৯) ব্যক্তিগত সম্পত্তিঃ নব্য প্রস্তর যুগে সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত মালিকানা (Private ownership) প্রতিষ্ঠিত হয়। এর আগে সম্পত্তি ছিল সামাজিক মালিকানায়। সম্পত্তিতে একটি সমাজের সকল সদস্যের সমান অধিকার ছিল। কিন্তু নব্য প্রস্তর যুগে এ অবস্থার পরিবর্তন হয়। কৃষিকাজ ও পশুপালনের ফলে সম্পত্তিতে ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়।
পরিশেষঃ পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, নব্য প্রস্তর যুগে মানব সমাজে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়। ব্যক্তিগত ও সমাজ জীবনে আসে আমূল পরিবর্তন। সমাজে নতুন ধ্যান-ধারণা ও প্রথার প্রচলন হয়। জীবনযাপনের পদ্ধতিতে আসে পরিবর্তন। সমাজ জীবনে গতিশীলতা বৃদ্ধি পায়। উৎপাদন ও ভােগ ব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তন আসে। ফলে সাংস্কৃতিক পরিবর্তনও সূচিত হয়। এ জন্যই সমাজবিজ্ঞানী ও নৃ-বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে নব্য প্রস্তর যুগ তার বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে অনেক তাৎপর্যপূর্ণ।
Leave a comment