‘সঞ্চিতা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত ‘গানের আড়াল’ কবিতাটি কবির ‘চক্রবাক্’ কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতা। এই কাব্যের প্রধান উপজীব্য বিষয় প্রেম ও বিরহজাত রোমান্টিক অনুভূতির প্রকাশ। নজরুলের সমগ্র সাহিত্যকর্ম পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, তিনি “যদৃষ্ট্যং তদ্লিখিতং”। বাস্তব জীবনাভিজ্ঞতাকে তিনি তাঁর সাহিত্যকর্মের মধ্যে প্রকাশ করেছেন। তিনি সুস্পষ্ট ভাবে লেখেন, “দেখিনু সেদিন রেলে,/বুলি বলে এক বাবুসাব তারে ঠেলে দিল নিচে ফেলে—”। শুধু প্রতিবাদী মনোভাব প্রকাশের ক্ষেত্রেই নয়, রোমান্টিক মনোভাব প্রকাশের ক্ষেত্রেও তাঁর বাস্তব চর্চিত জীবনের ছায়াপাত লক্ষ্য করা যায়। আর এখানেই মোহিতলাল মজুমদারের সঙ্গে তাঁর কাব্যলক্ষণের পার্থক্য ঘটে গেছে। মোহিতলাল তাঁর কল্পনার মানসকে (মানসসুন্দরী) বাস্তব জীবনের ওপর আরোপ করেছেন, আর নজরুল বাস্তবের অভিজ্ঞতায় বিরহবলতর হয়েছেন।
‘গানের আড়াল’ কবিতায় রোমান্টিক প্রেম-ভাবনার পটভূমিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ফজিল তুন্নেসা এবং রাণু সোমের একটা ভূমিকা রয়েছে বলে সমালোচকগণ মনে করেন। ১৯২৮ সালে মুসলিম সাহিত্য সমাজের ২য় বার্ষিক সম্মেলনে যোগদানে এসে কবি ফজিল তুন্নেসার প্রতি আকৃষ্ট হন। কিন্তু ফজিল নজরুলের আহ্বানে সাড়া দেননি। আর সেকারণে কবির অন্তরে এক তীব্র বিরহবোধ জেগে ওঠে। ‘এ মোর অহংকার’ কবিতায় যেমন, তেমনি ‘গানের আড়াল’ কবিতাতেও এই ঘটনার নিশ্চিত কিছু প্রভাব পড়েছে। এর পাশাপাশি রয়েছে রাণু সোম (প্রতিভা বসু)-এর ঘটনা। কবি রাণু সোমকে গজল শেখাতেন। কিন্তু একজন মুসলমান-এর কাছে হিন্দু মেয়ের গান শিখতে যাওয়াটা অনেকেই মেনে নিতে পারেনি, আর এই না মেনে নেওয়া থেকে সৃষ্টি হয় এক জটিল সামাজিক সমস্যা। যাইহোক, রাণু সোমকে গান শেখাতে শেখাতে কবির মনে কি রাণু সোম সম্পর্কে কোনো বিশেষ ভাবনা তৈরি হয়েছিল ? অন্তত সেরকমইতো একটা ইঙ্গিত আছে কবিতার শুরুতে—
“তোমার কণ্ঠে রাখিয়া এসেছি মোর কণ্ঠের গান-
এইটুকু শুধু রবে পরিচয় ?”
‘গানের আড়াল’ কবিতার মূল সুর রোমান্টিক বিষণ্ণতা। প্রেম প্রত্যাখ্যাত হওয়ার বেদনা এখানে প্রকাশ পেয়েছে। কবি নিজেকে উজাড় করে যাকে গান শিখিয়েছেন, সেই প্রেমিকার কাছেই তিনি প্রশ্ন রাখেন, তোমার কাছে কি শুধু এইটুকু পরিচয় থেকে যাবে, আর সবকিছুর অবসান ঘটবে ? কবির অন্তরতলে যে প্রত্যাশা লুকিয়েছিল, তা তো গান শেখানোর অধিক কিছু। গানের আড়ালে সেই প্রত্যাশা চিরকালের মতো ঢাকা পড়ে গেছে। এই কথার মধ্যে দিয়ে কবি এক গূঢ় তত্ত্বের প্রকাশ ঘটিয়েছেন, কবিরা কবিতা লেখেন, গান রচনা করেন। সেই কবিতা বা সেই গান মানুষে গ্রহণ করে ধন্য ধন্য করে, কিন্তু রচয়িতার অনুভূতিটুকু বোঝার চেষ্টা করে না। এই ট্র্যাজেডি শুধু নজরুলের ক্ষেত্রেই নয়, সব কবির ক্ষেত্রেই সত্য। নজরুল তাই বলেন, “গানের বাণী সে শুধু কি বিলাস, মিছে তার আকুলতা?”
হৃদয় সমুদ্র আকুলতার ঢেউ আছড়ে পড়ে উপকূলে যারা বসে থাকে, তারা সেই ঢেউয়ের প্রতিধ্বনি শুনতে পায় ঠিকই, কিন্তু উদ্ভবের ইতিহাসটুকু অনুভব করে না, ফলে তাদের হৃদয়ে আকুলতার বাণী কোনো সাড়া জাগায় না। একটি খুব সুন্দর উপমার দ্বারা কবি তাঁর অন্তরের বিরহ বেদনার রূপটিকে প্রকাশ করেছেন। চাঁদের আকর্ষণে সাগরে জোয়ার আসে, কিন্তু চাঁদই শোনে না সাগরের ফুলে ফুলে ওঠা ক্রন্দনধ্বনি। কবির সুরের মূর্ছনা তার প্রেমিকার কাছে পৌঁছয় না। তার গানের মালার সুবাস প্রেমিকার হৃদয়কে স্পর্শ করে না। ফলে কবির বুকের বাণী যেন তাঁর কণ্ঠের ফাঁসী হয়ে উঠেছে। গোলাপের আপাত বহিরঙ্গ রূপে মানুষ আনন্দ পায়, কিন্তু কবির মনে হয় গোলাপের প্রতিটি পাপড়িতে রক্ত লেখায় হৃদয় বেদনার কথাই লেখা থাকে। প্রেমিকের কাছে প্রত্যাখাত হওয়ার পর কবির মনে হয়েছে, “তুমি খেলিয়াছ বাজাইয়া মোর বেদনার ঝুমঝুমি।”
কবিতার শেষ স্তবকে কবির কণ্ঠও যেন বেদনায় ভেঙে পড়েছে। তিনি বলেছেন—
“ভোলো মোর গান, কি হবে লইয়া এইটুকু পরিচয়
আমি শুধু তব কণ্ঠের হার হৃদয়ের কেহ নয়।”
কবি শুধু বহিরাবরণ হয়েই তাঁর প্রেমিকার কাছে থাকতে চান না। হৃদয়ের অন্তরস্থলে যদি প্রবেশ করিতে নাই পারেন, তাহলে প্রেমের মূল্য কী ? এখানে এক প্রবল নিরাশার মধ্যে কবি যেন ডুবে গেছেন। তবে আশার বাণী নিয়ে তিনি শেষ করেছেন তাঁর কবিতা—
“জানায়ো আমারে, যদি আসে দিন, এইটুকু শুধু যাচি
কণ্ঠ পারায়ে হয়েছি তোমার হৃদয়ের কাছাকাছি।”
Leave a comment