নজরুলের বহু প্রশংসিত কবিতার মধ্যে ‘দারিদ্র্য’ ও একটি। এ কবিতা যখন লেখা হয়, তখন নজরুল থাকতেন কৃষ্ণনগরে। দিনেশ রঞ্জন দাশ কবিকে মনিঅর্ডারে ১০ টাকা পাঠিয়ে ছিলেন এবং সেই সঙ্গে তাঁর একখানি কবিতা চেয়ে পাঠিয়েছিলেন। সেই উপলক্ষ্যেই কবিতাটি রচনা করেন কবি। এ কবিতা সম্বন্ধে কবির নিজস্ব স্বীকারোক্তি—‘এই কবিতাটি বড়ো দুঃখে লিখেছি। ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের অগ্রাহয়ণ মাসে (খৃষ্টীয় হিসাবে ১৯২৬ সালের নভেম্বর মাস) ‘কল্লোল’ পত্রিকায় এ কবিতাটি ছাপা হয়েচ্ছিল। তার কয়েকদিন আগেই কবিতাটি রচিত। এই সময় কবির পারিপার্শ্বিক অবস্থা কেমন ছিল তা আলোচনা করলে এ কবিতা রচনার পটভূমি স্পষ্ট হয়ে ওঠে—১৯২৬ সালে নজরুল কৃষ্ণনগর থেকে ব্রজবিহারীকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন—“…টাকার বড়ো দরকার। যেমন করে পার পঁচিশটি টাকা আজই মানি অর্ডার করে পাঠাও।…ভুলো না যেন।…” মানুষের একাকীত্ব মানুষের অসহায় পথ চলা তাকে জীবনের কঠোর বাস্তবতার প্রথম পাঠ শেখায়। মানুষের জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের তাকে তার সৃষ্টির রসদ জোগায়। আর এই সৃষ্টি হয়ে ওঠে তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। কারণ, এর ভেতর নিহিত থাকে তার নিজ অভিজ্ঞতা সঞ্জাত বাস্তবতা। নজরুলের ‘দারিদ্র্য’ কবিতাটিও কবির জীবনের একান্ত বাস্তব অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধিজাত সৃষ্টির একটি শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।
‘দারিদ্র্য’ কবিতা সম্পর্কে মোহিতলাল বলেছেন, ‘এযুগে পৃথিবী জুড়িয়া অন্নাভাবের হাহাকার উঠিয়াছে। —মনুষ্য সমাজে কুবিধি প্রবল হওয়ায় বঞ্ছিত বুভুক্ষের দলই সর্বত্র বৃদ্ধি পাইয়াছে। মানুষের সেই দুর্বল দারিদ্র্য পীড়িত অবস্থাকে কবি একরূপ বিষজ্বালার উদ্দীপনরূপে— এক মহাশক্তিরূপে বন্দনা করিয়াছেন। বাস্তবিকই তাই। দারিদ্র্যের সীমাহীন যন্ত্রণা কবিতাটিতে আগুনের লেলিহান শিখা সঞ্চার করেছে। দারিদ্র্যকে অভিনন্দন জানিয়ে কবি শুরু করেছেন তাঁর কবিতা—
“হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে ক’রেছ মহান !
তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীষ্টের সম্মান
কণ্টক-মুকুট শোভা!…….”
এরপর থেকেই দারিদ্র্যের তীব্র জ্বালা কবিকে কীভাবে পরিবর্তিত হয়ে উঠতে বধ্য করেছে তা একে একে ব্যক্ত হয়েছে। কবির জীবনে দারিদ্র্যের করাল গ্রাস কবির সামগ্রিক জীবনযাপন, দৈনন্দিন কাজকর্ম, কবির মনমানসিকতা, স্বভাবধর্ম, সামগ্রিক জীবনচেতনার উপরে কি কি প্রভাব ফেলেছে তা ব্যক্ত করতে কবি বেশ দীর্ঘ আকারের বাক্য একের পর এক ব্যবহার করেছেন যেমন—
“দিয়াহ্, তাপস,
অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস;
উদ্ধত উলঙ্গ দৃষ্টি, বাণী ক্ষুরধার,
বাণী মোর শাপে তব হ’ল তরবার।
অথবা,
‘দুঃসহ দাহনে তব হে দর্পী তাপস,
অম্লান স্বর্ণেরে মোর করিলে বিরস,
অকালে শুকালে মোর রূপ রস প্রাণ!
কবির শব্দ ব্যবহার ও বাক্য বিন্যাস, বাক্যের গঠন কাঠামো সবটাই কবিতার বিষয়োপযোগী হয়েছে। কোথাও কোথাও রয়েছে অর্ধসমাপ্ত বা অসম্পূর্ণ বাক্য। যেমন—’টলমল ধরণীর মত করুণায়!’
দীর্ঘবাক্যগুলি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ক্রিয়াপদ দিয়ে শুরু। যেমন—
….দিয়াছ, তাপস,
অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস ;
উদ্ধত উলঙ্গ দৃষ্টি, বাণী ক্ষুরধার,
বাণী মোর শাপে তব হল তরবার!
অথবা
“শুনিতেছি আজো আমি প্রাতে উঠিয়াই
‘আয় আয়’ কাঁদিতেছে তেমনি সানাই!
বা,
“নেচে ফেরে প্রজাপতি চঞ্চল পাখায়
দুরস্ত নেশায় আনি, পুষ্প-প্রগল্ভায়
চুম্বনে বিবশ করি’ !”
এছাড়া, খুব ছোটো বাক্যও ব্যবহার করেছেন। যেমন— ‘কে বাজাবে বাঁশী?’ বা ‘কোথা পাবপুষ্পাসব’ জাতীয় প্রশ্ন বাক্য।
‘তাপস’ শব্দটি কবি আর ব্যবহার করেছেন দারিদ্র্যের বিশেষ অভিধা হিসেবে। ‘দারিদ্র্য’ একটি অবস্থা স্বরূপ যাকে কবি ‘তুমি’ নামক এই প্রাণীবাচক সর্বনাম দিয়ে নির্দেশায়িত করছেন। এছাড়াও কবি ‘নির্মম’, ‘বুভুক্ষু’, প্রভৃতি শব্দ দিয়ে দারিদ্র্যকে সম্বোধন করেছেন। ‘হে’ এই সম্বোধনসূচক পদটিও বেশ কয়েকবার ব্যবহৃত। এই সব বিশেষণ প্রয়োগ করে তিনি দারিদ্র্যের জ্বালা যে ; কতটা নিষ্ঠুর নৃশংস তাঁকেই পাঠকের কাছে প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছেন আবরণবিহীনভাবে। কবি, এ কবিতায় তদ্ভব, তৎসম, অর্ধতৎসম, বিদেশি, দেশী সবধরণের শব্দই প্রয়োগ করেছেন।
‘অগ্নি’, ‘আঁখি’ প্রভৃতি শব্দের পাশে কবি খুব সহজেই ‘গেলাস’ শব্দটির মতো একাধিক বিদেশি শব্দকে প্রয়োগ করেছেন। যেমন—‘ধুতুরা গেলাস’ শব্দটি। এছাড়াও, দেখছি কবি এখানে কিছু দিশাব্দিক ও বিশাব্দিক সমাসবদ্ধ ব্যবহার করেছেন। যেমন—সুরভি-বিথার শিশির-সজল, বিলাস-কুঞ্জ।
অনশন—ক্লীষ্ট, মৃত্যুদণ্ড, অমৃতসাধনা ধুতুরা গেলাস ইত্যাদি দ্বিশাব্দিত সমাসবদ্ধপদ আর বেদনা—হলুদ-বৃত্ত, করুণা-ধনীকার বিন্দু ইত্যাদি ত্রিশাব্দিক সমাজবদ্ধ পদ ছোটো বড় মাঝারি সব মিলিয়ে মোট ১৬টি স্তবকে ‘দারিদ্র্য’ কবিতাটি রচিত। সবচেয়ে ক্ষুদ্রাকৃতির স্তবকগুলি দুটি বা ৪টি পক্তি নিয়ে গঠিত। এরকম স্তবক মোট ৪টি। ষষ্ঠ, নবম, একাদশতম ও ষোড়শতম স্তবকগুলি এই ধরনের। এর ভেতর কেবল একাদশতম স্তবকটি ৪টি পঙ্ক্তি নিয়ে গঠিত, বাদ বাকিগুলি ২টি করে পক্তি নিয়ে গঠিত। উদাহরণ হিসেবে আমরা এই ধরনের একটি স্তবককে নিতে পারি। যেমন—
“গাহি গান, গাঁথি মালা, কণ্ঠ করে জ্বালা
দংশিল সর্বাঙ্গে মোর নাগ নাগ-বালা…..’
কিংবা,
“বিনয়ের ব্যভিচার নাহি তব পাশ,
তুমি চাহ নগ্নতার উলঙ্গ প্রকাশ”
মাঝারি আকারের স্তবক মোটামুটিভাবে ছয় পক্তির প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম, দশম—এই কটি স্তবক মাঝারি আকারের। কবিতাটিতে এ জাতীয় স্তবকের আধিক্যই বেশি। যেমন—
“বেদনা-হলুদ-বৃত্ত কামনা আমার
শেফালির মত শুভ্র সুরভি-বিথার
বিকশি উঠিতে চাহে, তুমি হে নির্মম
দলবৃত্ত ভাঙ শাখা কার্টুরিয়া-সম!
আশ্বিনের প্রভাতের মত ছলছল
ক’রে ওঠে সারা হিয়া’ শিশির-সজল!”
সবচেয়ে দীর্ঘ আকারের স্তবকগুলি বেশির ভাগই ৮ পক্তি নিয়ে গঠিত। তবে ১টি ১০ পত্তির ও ১টি ১২ পঙ্ক্তির স্তবকও আছে। দ্বিতীয়, দ্বাদশতম, ত্রয়োদশতম ও পঞ্চাদশতম স্তবক চারটি ৮ পক্তির। আর সপ্তম ও চতুর্দশতম স্তবকদ্বয় যথাক্রমে ১০ ও ১২ পক্তি নিয়ে গঠিত। স্তবকের বৈচিত্র্যপূর্ণ গঠন কাঠামো আকৃতি ও স্তবক বিন্যাস এর রীতি কবিতার বিষয়বস্তুর সঙ্গে সঙ্গতি বজায় রেখেই নির্মিত।
ছেদ, যতির ব্যবহার–কবিতাটির বেশির ভাগ বাক্যই সমাপ্ত হয়েছে বিস্ময়বোধক চিহ্ন দিয়ে। প্রায় প্রতি স্তবকেই কমবেশি ২ থেকে ৩টি করে বিস্ময়বোধক চিহ্নের ব্যবহার আমরা লক্ষ্য করি। যেমন—ত্রয়োদশ স্তবকটির ৩টি চরণের শেষে ব্যবহৃত হয়েছে বিস্ময়সূচক চিহ্ন। উদাহরণ-এর সাহায্যে ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়—
‘শুনিতেছি আজো আমি প্রাতে উঠিয়াই
‘আয় আয়’ কাঁদিতেছে তেমনি সানাই !
ম্লানমুখী শেফালিকা পড়িতেছে ঝরি
বিধবার হাসি-সম—স্নিগ্ধ গন্ধে ভরি!
নেচে ফেরে প্রজাপতি চঞ্চল পাখায়
দুরস্ত নেশায় আজি ; পুষ্প-প্রগল্ভায়
চুম্বনে বিবশ করি’! ভোমোরার পাখা
পরাগে হলুদ আজি, অঙ্গে মধু মাখা!
স্তবকটিতে ২ একটি চরণের মাঝামাঝি স্থানে কমা (,) চিহ্ন ব্যবহৃত হলেও বিস্ময়বোধক চিহ্ন ব্যতীত অন্য কোনো যতি চিহ্ন চরণ সমাপ্তির জন্য ব্যবহৃত হয়নি। চতুর্দশ স্তবকেও অনেকটা এরই অনুরূপ প্রয়োগ চোখে পড়ে। এক্ষেত্রে দারিদ্র্যের অকস্মাৎ অভিঘাত মানুষকে মুহূতুই কতখানি অসহায়, আর্ত করে তুলতে পারে তাইই, কবি অনুভব করেছেন বাস্তব অভিজ্ঞতার বিপাকে পড়ে। আর শোকার্ত কবি ক্রমশই বিস্ময়বোধে অভিভূত হয়েছেন। তাই এই জাতীয় যতি চিহ্নের প্রয়োগ কবিতার ভাববস্তুর সঙ্গে অসঙ্গত কখনোই নয়৷ এছাড়াও, কোথাও কোথাও দীর্ঘ সংযোগ চিহ্ন (ইংরেজি শব্দ ‘ড্যাশ’)-এর ব্যবহার কবিতার ভাবের টানা-পোড়েনকে যথার্থভাবে ব্যক্ত করেছে। যেমন একেবারে শেষ স্তবকে দেখি—’ও যেন কাঁদিছে শুধু নাই, কিছু নাই !
এখানে বৃত্তাকার অংশে চিহ্নিত দীর্ঘ সংযোগ চিহ্নটি বক্তব্যের প্রবাহকে ধরে রাখবার জন্য যথাযথ হয়ে উঠেছে। অনেক কথার সংক্ষিপ্ত রূপ নির্মাণের জন্য কমা চিহ্নের ব্যবহার ও বাক্যের মধ্যে একাধিক পদকে ছোটো ছোটো সংযোগ চিহ্ন দিয়ে সংক্ষিপ্ত আকারে নির্মাণ করবার রীতিটিও লক্ষ্যণীয়। যেমন—
‘গাহি গান, গাঁথি মালা, কণ্ঠ করে জ্বালা
দংশিল সর্বাঙ্গে মোর নাগ নাগ-বালা…..’
তাছাড়াও, যেখানে যেখানে দীর্ঘ বাক্য ব্যবহৃত হয়েছে সেখানে একটি দীর্ঘ বাক্যের মধ্যে ভাবের সমাপ্তি না ঘটায় কবি সেই বাক্যটির স্বল্প বিরামের জন্য ব্যবহার করেছেন সেমিকোলন। যেমন প্রথম স্তবকে দেখি—
‘……দিয়াছ, তাপস
অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস;
উদ্ধত উলঙ্গ দৃষ্টি, বাণী ক্ষুরধার,
বাণী মোর শাপে তব হ’ল তরবার।”
যখন, ‘দারিদ্র্য অসহ/ পুত্র হয়ে জায়া হয়ে কাঁদে অহরহ/আমার দুয়ার ধরি!’ তখন নিজের দারিদ্র্য পীড়িত অবস্থার মধ্যে কবি প্রশ্ন তুলেছেন—
‘….কে বাজাবে বাঁশী ?
কোথা পাব আনন্দিত সুন্দরের হাসি ?
কোথা পাব পুষ্পাসব? ধুতুরা গেলাস
ভরিয়া করেছি পান নয়ন-নির্যাস…’
এই অংশে কবির প্রচণ্ড ক্ষোভ, তীব্র মর্মদাহ, প্রভৃতির প্রকাশ ঘটেছে একাধিক প্রশ্ন বাক্যের ব্যবহারে। কবি যেন প্রশ্ন বাণ ছুঁড়ে দিয়ে নিজের অসহ বেদনাকে প্রকাশ করলেন এক অভিনব ভঙ্গীতে। দরিদ্র্যর শূন্যতার, রিক্ততার হাহাকার এভাবেই প্রশ্নের মধ্যে দিয়ে ব্যক্ত করলেন কবি।
অলঙ্কার প্রয়োগ এ কবিতায় নানা ধরনের অলঙ্কার ব্যবহৃত হয়েছে। কবিতার ভাববস্তুকে পরিস্ফুট করতে এ জাতীয় বৈচিত্র্যপূর্ণ অলঙ্কার প্রয়োগ বিভিন্ন অর্থের দ্যেতক ও ব্যঞ্জনাবাহী হয়ে উঠে কবিতাটিকে আলঙ্কারিক চমৎকৃতি এনে দিয়েছে। যেমন—
উৎপ্রেক্ষা—
‘ধরণী এগিয়ে আসে, দেয় উপহার!
ও যেন কনিষ্ঠা মেয়ে দুলালী আমার !– ”
এখানে ধরণী–উপমেয়, উপমান-কনিষ্ঠা দুলালী, সম্ভাবনাবাচক শব্দ—যেন। উপমানকেই সত্য বলে মনে হয়েছে।
উপমা—
১) ‘শেফালির মতো শুভ্র সুরভি-বিথার’
২) ‘আশ্বিনের প্রভাতের মতো ছলছল।
সমাসোক্তি—
‘শুনিতেছি আজো আমি প্রাতে উঠিয়াই
‘আয় আয়’ কাঁদিতেছে তেমনি সানাই।
অনুপ্রাস—
১) ‘গাহি গান, গাঁথি মালা, কণ্ঠ করে জ্বালা দংশিল সর্বাঙ্গে মোর নাগ নাগ-বালা।…’
২) … তরল গরল
কণ্ঠে ঢালি তুমি বল, ‘অমৃতে কি ফল?’
চিত্রকল্পের ব্যবহার মধ্যে দিয়ে দারিদ্র্য যন্ত্রণার তীব্রতা সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। যেমন—
‘…তুমি হে নির্মম
দলবৃত্ত ভাঙ শাখা কাঠুরিয়া-সম!’
অথবা,
‘দুঃসহ দাহনে তব হে দপী তাপস
অম্লান স্বর্ণেরে মোর করিলে বিরস।
বা,
‘তুমি রবি তব তাপে শুকাইয়া যায় করুণা-নীহার-বিন্দু।
Leave a comment